চীনের অবাক করা জলপ্রপাত ভবন

চীনের দ্রুতগামী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সহসঙ্গী হয়েছে কনস্ট্রাকশন বুম (আকস্মিক নির্মাণযজ্ঞ)। এসব ভবন যেমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন, তেমনি দৈত্যাকার। উদ্ভট ধরনের স্থাপনাও বাদ পড়েনি তাদের নির্মাণযজ্ঞে। চীনের ভবনগুলোর এমন অপ্রচলিত আদল দেখে ঠাট্টা করতেও কেউ কম যায় না। তবে তাতে চীনের স্থপতি, প্রকৌশলী, ইন্টেরিয়র ও এক্সটেরিয়র ডিজাইনাররা এতটুকুুও বিচলিত নন। বরং ভিন্নধর্মী স্থাপনা নির্মাণের ধারা অব্যাহত থাকবে, এমনই অঘোষিত ঘোষণা তাঁদের। ধরুন, ভবনে ঝরনাধারা! নিশ্চয় ভাবছেন ও তো হরহামেশাই দেখা যায় পৃথিবীর নানা প্রান্তে! কিন্তু যদি বলি আকাশছোঁয়া ভবনের শরীরজুড়ে নামছে প্রপাতের জলধারা! তাহলে কী বলবেন? চোখ কপালে ওঠার মধ্যেই জানিয়ে রাখি দক্ষিণ চীনের, গুইয়াং শহরের নির্মিত লাইবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল বিল্ডিংয়ের ১০৮ মিটার বা ৩৫৪ ফুট উচ্চতায় স্থাপন করা হয়েছে বিশাল এক কৃত্রিম জলাপ্রপাত, যেখান থেকে অবিরাম পড়ছে অবিরত জলধারা। 

লাইবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল বিল্ডিং মূলত একটি বাণিজ্যিক ভবন। লুদি ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপ এই স্থাপনাটির স্বত্বাধিকারী। ১২১ মিটার (২২ তলাবিশিষ্ট) উচ্চতার এ ভবনে রয়েছে একটি শপিং মল, অফিস, হোটেল আর একটি বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ। ভবনের ১০৮ মিটার উচ্চতায় গড়ে তোলা হয়েছে উল্লেখিত জলপ্রপাতটি। ভবনটির কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও জলপ্রপাতের ফিচারটির কাজ দুই বছর আগেই সম্পন্ন হয়েছে। ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১২ সালে, শেষ হয় ২০১৬ সালে। স্থাপনাটির পুরো নকশা বা বিবরণ কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেনি। তবে একটি জটিল ব্যাপার হলো প্রায় একই রকম দেখতে ও সমউচ্চতার আরেকটি টাওয়ার এ স্থাপনার সঙ্গেই যুক্ত করা হয়েছে।

লাইবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল বিল্ডিং মূলত একটি বাণিজ্যিক ভবন ছবি: বিজনেস ইনসাইডার

স্থাপনাটি থেকে যখন জলধারা প্রবাহিত হয় তখন একে বিশাল এক প্রাকৃতিক ঝরনার মতোই মনে হয়। ভবনের কাচের রং নীলাভ সবুজ হওয়ায় প্রকৃতির রঙের সঙ্গে মিশে যায় সহজেই। ভবনটির স্বত্বাধিকারীরা চেয়েছিলেন ভবনে একটি ঝরনাধারা থাক। তাঁদের সেই চাওয়াকে মাথায় রেখে ইতালিয়ান স্থপতি জোসেফ ডি প্যাসকুয়েল ঝরনাধারাটি গড়ে তোলেন কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে। বলা চলে, চাওয়ার থেকেও পাওয়া বেশি! স্থপতি ভবনটিতে জল এবং সবুজ রঙের এক প্রাকৃতিক অনুভূতি প্রদান করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর চেতনায় ছিল পাহাড়-বনানীঘেরা এ শহরটির সঙ্গে জলপ্রপাতযুক্ত ভবনটি দারুণভাবে মানিয়ে যায়। আর তাঁর সে চেষ্টা পুরোপুরিই সার্থক হয়, তা বোঝা যায় স্থাপনাটিকে ঘিরে দর্শনার্থীদের আগ্রহ ও ঢল দেখে। 

সুউচ্চ ভবনটিতে জলপ্রপাতের ব্যবস্থা করাটা ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। এ জন্য ভবনে চারটে দৈত্যাকার পাম্প বসানো হয় পাম্প করে ঝরনাধারা সৃষ্টির জন্য। আর পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির ধারা নিশ্চিত করতে ভবনের ভূগর্ভে স্থাপন করা হয় বৃষ্টির জল-ধারণকারী বিশাল ট্যাঙ্ক। ফলে বৃষ্টির পানি দিয়েই ঝরনাধারা সৃষ্টি করা যায়। বাড়তি পানির প্রয়োজন হয় না।  

তবে ভবনের এত উঁচু স্থান থেকে জলপ্রপাতে জল গড়িয়ে পড়ার কারণে কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। যখন ঝরনাধারাটি চালু করা হয় তখন এর জলকণাগুলো বাতাসের তোড়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ভবন কর্তৃপক্ষকে। তবে তা সব সময় নয়, বিশেষ করে কিছুটা দমকা বাতাসের সময়। এ কারণে তৈরির পর প্রপাতটি মাত্র কয়েকবার চালু করা হয়েছে। তবে এ ছাড়া অন্য কারণও রয়েছে। মালিক পক্ষ বলছে, জলপ্রপাত সৃষ্টির জন্য প্রতিবার পাম্প চালু করলে প্রতি ঘণ্টায় খরচ হচ্ছে ৮০ হাজার ইউয়ান (১৬০ মার্কিন ডলার-১৩ হাজার ৪৫০ টাকা)। যদি এটি সারা বছর ধরে চালু থাকত, তবে খরচ বছরে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেত। অযথা এত ব্যয় করতে মোটেও ইচ্ছুক নয় কর্তৃপক্ষ। 

সমালোচকদের মধ্যে অনেকেই এই প্রকল্পটিকে বিদ্রুপ করে বলছে, ‘এ প্রকল্প অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়!’ বেইজিং, এএফপির প্রতিনিধির ভাষ্যমতে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি স্কাইস্ক্র্যাপার, যা তার মালিক কর্তৃক বিশ্বের বৃহত্তম মনুষ্যসৃষ্ট জলপ্রপাত বলে অভিহিত করেছে, যদিও তা জাতীয় উপহাস অর্জনের পরও শীর্ষস্থানীয় স্থাপত্যের সর্বশেষ উদাহরণ হয়ে উঠেছে। তবে অনেকে মনে করছেন, এই জলপ্রপাত ব্যবস্থাটি স্থাপনার সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি ভবন পরিষ্কার রাখতে ধোয়ামোছা বাবদ বার্ষিক যে খরচ হতো তা অন্তত বাঁচিয়ে দিচ্ছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মনুষ্যনির্মিত ভবনের জলপ্রপাতটি নিঃসন্দেহে এক চমৎকার নিদর্শন। আর এই শিল্পকর্মটি আপনিও দেখে আসতে পারেন। কিন্তু জলপ্রপাতটি তখন চালু থাকবে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তখন ওই শহরে যদি কোনো উৎসব থাকে, তবে নিশ্চিতভাবেই আপনি তা উপভোগ করতে পারবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top