স্থপতি মাজহারুল ইসলাম (জন্ম : ২৫ জুলাই, ১৯২৩ – মৃত্যু : ১৪ জুলাই, ২০১২) বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের প্রথিতযশা স্থপতিদের অন্যতম। বাংলাদেশের স্থাপত্যচর্চার পথিকৃৎ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই স্থপতি ছিলেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রথম সভাপতি। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণসহ নানা সময়ে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থেকেছেন। ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যের পাঠ শেষে আড়াই বছর পর দেশে ফিরে একনাগাড়ে ছয় মাসের পরিশ্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট ও লাইব্রেরি ভবনের ডিজাইন করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে বৃত্তি নিয়ে ট্রপিক্যাল আর্কিটেকচার পড়তে লন্ডনের এ স্কুল অব আর্কিটেকচারে যান। ১৯৬০ সালে যান যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে পল রুডলফের অধীনে মাস্টার্স করতে। ১৯৬১-এর শেষের দিকে দেশে ফেরেন তিনি। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কনস্ট্রাকশন, বিল্ডিং অ্যান্ড ইরিগেশনে। মতের মিল না হওয়ায় ১৯৬৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে ‘বাস্তুকলাবিদ’ নামে একটি স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) স্থাপত্য অনুষদ চালু করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে তাঁর। বুয়েটে খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকর্মের মধ্যে আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাইন ও মাস্টারপ্ল্যান, নিপা ভবন, চারুকলা ভবন প্রভৃতি।


সময় ১৯৬৯। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম হাত দিলেন নতুন এক স্থাপনা তৈরিতে। স্থাপনাটি হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসনের প্রধান কার্যালয়। শুরু হলো স্থপতিদের ডিজাইন কার্যক্রম। তাঁর ‘বাস্তুকলাবিদ’ প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য ডিজাইন এটি। ১৯৬৯-এর শেষ দিকে শেষ হয় এর ডিজাইন প্রসেস।
নিপা ভবনের নির্মাণকাজ শেষে শুরু হয় একাডেমিক ভবন হিসেবে এটির নির্মাণ। আকৃতি ছিল রেক্টেঙ্গুলার। একেবারেই সলিড গ্রাফিক্স ব্যবহার করে স্থপতি খেলেছেন প্রকৃতির সঙ্গে; খেলা করেছেন আলো-বাতাসের চলাচল দিয়ে। এ যেন সহজ সাধারণ কোনো কবিতা। বুঝলে যার গূঢ় অর্থ যে কাউকেই নিয়ে যায় অনেক গভীরে।

ভবনের স্থাপত্যশৈলী বহন করে একেবারেই বাংলাদেশের নিজস্বতা। এতে নেই ডিজাইনের কোনো আতিশয্য। নেই মেটেরিয়ালস ব্যবহারে কোনো চাতুর্য। একেবারেই সোজাসাপ্টা অথচ সুন্দর এই স্থাপত্যকর্মের বাইরের অংশটি ক্যান্টিলিভার আকারে ছড়িয়ে আছে চারদিকে। তিনতলা স্ট্রাকচারের বাইরের অংশটি প্রতি তলায় ক্যান্টিলিভার হয়ে ঝুলন্ত স্ল্যাব হিসেবে অবস্থান করছে কিছু টিপিক্যাল স্ট্রাকচারের ওপর। রেক্টেঙ্গুলার কলামগুলো একই রকম একের পর এক সারিবদ্ধভাবে পুরো স্থাপত্যকর্মটিকে ধরে রেখেছে। দ্বিতীয় তলাটি প্রথম তলার চেয়ে বেশ বিস্তৃত। ফলে এটা একটা শেডেড ডাবল হাইট এনভেলপ তৈরি করেছে, যাতে ছায়া-তরুর মতো স্থাপনাটি সর্বসাধারণকে ছায়া প্রদান করে চলেছে রোদ-বৃষ্টি থেকে।
স্থাপনাটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনার মূল ক্ষেত্র ছিল প্যাভিলিয়নের প্রথমদিককার আধুনিক চিন্তাভাবনা। একটি বিশাল মনুমেন্টাল স্থাপনা, যার মধ্যে সারি সারি ফ্রিস্ট্যান্ডিং কলাম দাঁড়িয়ে আছে এবং একই ছায়াতলে একের পর এক কর্ম সম্পাদিত হচ্ছে- এমনটাই ছিল প্যাভিলিয়ন ডিজাইনের প্রথমদিককার চিন্তা। নিপা ভবনের ডিজাইনের ক্ষেত্রে স্থপতি একই রকমের চিন্তাভাবনাই করেছেন। প্রতি সারি কলামের ভাঁজে ভাঁজে একেকটি ফাংশন এমনভাবে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন, যা পুরো স্থাপনার ডায়নামিজম নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি।

স্থাপনার কন্ট্রাকশন সিস্টেম ছিল রিইনফোর্সড কংক্রিট, যাতে স্থপতি ব্যবহার করেছেন ইটের খোয়া। হাতে তৈরি শাটারিং ব্যবহার করে কংক্রিটের ব্যবহার করা হয়েছে, যা স্থপতির চিন্তাশৈলীর পরিচয় দিয়েছেন।
নিপা ভবনের বাইরের দিকের সৌন্দর্য এতই সিমেট্রিক যে স্থপতি এখানে ফাংশনগুলোকে বেশ সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন। প্রতিটি ফ্লোরে সিঁড়ির স্পেস দিয়ে দুটো অংশে বিভক্ত করা। একদিকে লাইব্রেরি; অন্যদিকে অফিসকক্ষ। শিক্ষকদের বসার জায়গাগুলো একইভাবে ছড়িয়েছে তিনটি ফ্লোরজুড়ে। একেবারে ওপরের ফ্লোরটা বাইরে বেরিয়ে এসে এমনভাবে শেড তৈরি করেছে যে স্থাপনার করিডোরগুলো অনায়াসে পুরো অফিসরুমকে ঘিরে অবস্থান করছে। একেবারেই ওপরের তলার ক্লাসরুমগুলোয় স্থপতি সরু কিছু জানালা ব্যবহার করেছেন, যা দিয়ে পরিমিত পরিমাণে আলো ও বাতাস পুরো ভবনের ভেতর চলাচল করতে পারে। বর্ধিত ছাদের কারণে বৃষ্টি এসে কোনো রুমের ভেতর ভিজিয়ে দিতে পারে না।
প্রতি তলায় স্থাপনাটি মূল দুটি ফাংশনে বিভক্ত। একদিকে ডিনের অফিস অন্যদিকে টিচার্স রুম। মাঝে সরু একটা সিঁড়ি আছে, সেটা দিয়ে পুরো ভবনে ওঠানামা করা যায়। এর সঙ্গেই আছে লাগোয়া একটি ফয়ার। এর পরেই ডিনের অফিস এবং টিচার্স রুম। চারদিকে বারান্দা থাকার ফলে বাইরের শব্দদূষণ এসে স্থাপনার পরিবেশকে বিপন্ন করতে পারে না ।

সিঁড়ির মাধ্যমে পুরো স্থাপনার মাঝে চলাচল করার ব্যবস্থা আছে। যদিও আধুনিক স্থাপনার মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগের বেশি সার্কুলেশন স্পেস দেওয়া হয় না কিন্তু আজ থেকে পাঁচ বছর আগেই স্থপতি মাজহারুল ইসলাম সেই ব্যবস্থা করেছিলেন। করিডোর দিয়ে পুরো ভবন মুড়িয়ে দেওয়ার আগে ভবনের সার্কুলেশন সিস্টেম কমানোর জন্য আট ফুট করেন, আগে যা কোনো নিয়ম মেনে ডিজাইন করা হতো না। স্থপতি বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ডে এ পুরো নিপা ভবনের ডিজাইন করেছেন। এর পর থেকে অন্য স্থপতিরা এই নিয়মেই করিডোর ডিজাইন করে আসছেন।
স্থপতির মূল ডিজাইন অনুষঙ্গ ছিল স্থাপনার করিডোরগুলো। একই সঙ্গে কস্ট ইফেক্টিভ এবং কম ইনগ্রেডিয়েন্টস ব্যবহার করে দেশীয় স্থাপনা তৈরিতে তাঁর কীর্তি ছিল অসাধারণ। করিডোরগুলোতে হাঁটার সময় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের দৃশ্য দেখা যায়। কোনো সময় সলিড রেলিং, কোনো সময় স্টিল রেলিং দেখতে পাবে যে কেউ। ওপরের দিকে বিমগুলোতেও একই অবস্থা। ব্রাকেট তৈরি করে যেভাবে স্লাবগুলো উঠে গেছে, সেখানে বিমগুলো বড়ই দৃষ্টিনন্দন।
একটি লাইব্রেরি রুম আছে নিপা ভবনে। এই কক্ষে ২৫০ জন বসে বই পড়তে পারে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ভবনটির পরিবেশ স্থপতি এমনভাবে ডিজাইন করেছেন যে কোনো রকম শব্দ এখানে এসে পড়ার ব্যাঘাত ঘটায় না। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় শরীরে। কিন্তু বাইরের কোনো আওয়াজ আসে না। বিমগুলোকেই শব্দ নিরোধকের কাজে ব্যবহার করেছেন স্থপতি। ফলে এটা হয়ে উঠেছে একটি আদর্শ লাইব্রেরি কক্ষ।

এই নিপা ভবনে অনেক ভালো দিক থাকলেও চাঁদের কলঙ্কের মতোই এখানেও আছে বেশ কিছু অব্যবস্থাপনা। একটি মাত্র টয়লেট পুরো স্থাপনাটির মাঝে অপ্রতুল। এর সঙ্গে আছে বেশ কিছু ম্যানেজারিং সমস্যা। যার ফলে পুরো স্থাপনার মাঝেই আছে অদক্ষ হাতের ছোঁয়া। প্রতিটি সরকারি ভবনের মতোই নিপা ভবনও ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম আজ নেই। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট স্থাপনাগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ। এগুলো সংরক্ষণে শিগগিরই আমাদের এগিয়ে আসা উচিত। নইলে অদূর ভবিষ্যতে এগুলো হারিয়ে যাবে কালের আবর্তে।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৩ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৩