স্থপতি সাইফ উল হক স্থাপত্যে যাঁর প্রকৃতির ছোঁয়া

নির্মাণ মানেই স্থাপত্য নয়। মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে সমন্বয় ও ভারসাম্যসহ যে নির্মাণ তার অবস্থান নিশ্চিত করে, কেবল সেটাই স্থাপত্য। আর এই ধারণার ধারক ও বাহক এ দেশের সমসাময়িক স্থপতিদের অন্যতম স্থপতি সাইফ উল হক। যাঁর সামগ্রিক চিন্তাচেতনাজুড়ে রয়েছে দেশ। সাইফ উল হক তাঁর স্থাপত্য চর্চায় এ দেশের মানুষ, প্রকৃতি, জলবায়ু, আবহাওয়া, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে স্থাপত্যকে বেঁধেছেন একই সুতোয়। স্থাপত্যচর্চায় বরাবরই সচেষ্ট দেশীয় নির্মাণকৌশল ও উপকরণ ব্যবহার করেছেন স্বতন্ত্র ধারার স্থাপনা নির্মাণে।

স্থপতি সাইফ উল হক ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পেশাগত ডিগ্রি অর্জনের পর যখন পেশাজীবনে প্রবেশ করেন, তখন দেশে ছিল সামরিক শাসন। সেই সময়ে মুক্তচিন্তা ও দেশের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার যথাসম্ভব পরিষ্কার ধারণা নিয়ে শুরু করেন স্থাপত্য অনুশীলন। সহযাত্রী খালীদ আশরাফ, খালেদ নোমান ও জালাল আহমেদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ডায়াগ্রাম আর্কিটেক্টস’। এই প্রচেষ্টায় সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন অগ্রজ স্থপতি রাজিউল আহসান। তবে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলামের সান্নিধ্যে। ‘চেতনা অধ্যয়ন চক্র’-এর একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে। অল্প সময়ের মধ্যে দেশের স্থাপত্যাঙ্গনে ডায়াগ্রাম আর্কিটেক্টস আধুনিকতা ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে তৈরি করে বেশ কটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প; যার মধ্যে রংপুর ও ফরিদপুরে ব্র্যাকের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ছাতকে জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির আবাসন প্রকল্প, যশোরে বাঁচতে শেখা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও চট্টগ্রামে গোবিন্দ গুণালঙ্কার ছাত্রাবাসের প্রথম পর্যায়ের নির্মাণকাজ অন্যতম। এ ছাড়া মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান (নির্মিতব্য), রায়েরবাজার বধ্যভূমি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান ও উত্তরা ক্লাব ডিজাইন প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থাপত্য ডিজাইন প্রচেষ্টায় যুক্ত ছিল সাইফ উল হকের প্রতিষ্ঠানটি।

একটি আবাসিক প্রকল্পের প্রাথমিক স্কেচ

১৯৯৭ সালে ডায়াগ্রাম আর্কিটেক্টসের বিলুপ্তির পর প্রতিষ্ঠা করেন সাইফ উল হক স্থপতি, যার সহযোগী হন স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদ সালমা পারভীন খান। প্রতিষ্ঠানটি সব সময়ই তরুণ স্থপতিদের অংশগ্রহণে এবং অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মেলবন্ধনে যথাযথ একটি স্থান হিসেবে পেয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত, যার মধ্যে রয়েছে কারখানা, শ্রমিক আবাস, একাধিক পরিবারের আবাসস্থল, মিউজিয়াম ও ঐতিহাসিক স্থাপনার ড্রয়িং প্রস্তুতকরণ।

প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য প্রকল্প চট্টগ্রামের গোবিন্দ গুণালঙ্কার ছাত্রাবাস। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে জোবরা গ্রামে অবস্থান ছাত্রাবাসটির। এই প্রকল্পটিতে কাজ করতে গিয়ে স্থপতির চেতনায় উদ্ভূত হয় প্রাচীন বৌদ্ধমন্দির; যাকে ঘিরে গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছাত্র ও মন্দিরে অধ্যয়নরত ভিক্ষুদের জন্য নির্মিত প্রকল্পটি। স্থপতির চেতনায় নাড়া দেয় প্রাচীন এই শিক্ষালয়ের ঐতিহ্য আর এর চারপাশের সুশান্ত পরিবেশ, মন্দিরের পাশের বেদিতে ছড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়াগাছের লাল টকটকে ফুল। ফুলগুলোও হয়ে ওঠে নতুন এ প্রকল্পের জন্য অনুপ্রেরণা। এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ শিক্ষার্থীদের একমাত্র উপাসনালয়, যার মূল আকর্ষণ লাল ইট দিয়ে নির্মিত ভবনের আলো-ছায়ার খেলা ও প্রকৃতির সঙ্গে ছন্দময়ভাবে এর বেড়ে ওঠা; সত্যিই এটি নান্দনিক এক স্থাপত্যকর্ম। ইতালির রেডক্রসের অর্থায়নে দুই তলাবিশিষ্ট এই ভবনটির প্রতিটি ব্লকের সামনে রয়েছে লাল ইটের সাজানো একটি করে উঠান। সেই উঠানটিতে রয়েছে সবুজের সমারোহ আর মৌসুমি বাতাসের নির্মল প্রবাহ, যা যেকোনো মানুষের চেতনাকে নাড়া দিয়ে যায় ঠিক বাংলাদেশের গ্রামীণ স্বদেশি বাড়ির আঙিনার মতো। এই প্রকল্পের উঠানগুলো লেখাপড়া, খেলাধুলা ও সৃজনশীলতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের কোলাহলমুখর বিচরণে। উন্মুক্ত ও আচ্ছাদিত পরিসরের সমষ্টি, ভূমির বৈশিষ্ট্য, বিদ্যমান মন্দির ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মিলিত হয়ে রচিত হয়েছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবেশ, যেটি ব্যবহারকারী ও অতিথিদের সঞ্চার করে অনুপ্রেরণামূলক অভিজ্ঞতার। পলেস্তারাহীন ইট, প্রলম্বিত ছাদ, বাঁধানো উঠোন, চত্বর ও সিঁড়ির ধাপ, গাছপালা, পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো ও পায়ে চলাচলের ব্যবস্থা এই সব মিলিয়ে রচিত হয়েছে চমৎকার এক পরিবেশের। একদিকে সমসাময়িক আধুনিক জীবনযাপন, অন্যদিকে প্রধানত স্থাপত্যর বৈশিষ্ট্যসমূহ এই দুই-ই উপস্থিত রয়েছে স্থাপত্যকর্মটিতে। স্থপতি সাইফ উল হক ২০০১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন ‘গোবিন্দ গুণালঙ্কার ছাত্রাবাস’ প্রকল্পটি ডিজাইনের জন্য ভারতের জে কে সিমেন্ট কর্তৃক প্রদত্ত ‘বছরের স্থপতি পুরস্কার-১৯৯৯’-এর প্রশংসাসূচক স্বীকৃতি অর্জন করেন।

গোবিন্দ গুণালঙ্কার ছাত্রাবাস, চট্টগ্রাম

একজন স্থপতির কর্ম অভিজ্ঞতার ঝুঁড়িতে যেমন থাকে নির্মিত কর্ম, ঠিক তেমনি থাকে অনির্মিত কর্মও। সাইফ উল হক স্থপতির অনির্মিত প্রকল্পসমূহের উল্লেখযোগ্য রাজশাহীর প্যারামাউন্ট স্কুল ও কলেজ। প্রকল্পটির রূপায়ণকাল ২০০৭-২০০৮। রাজশাহীর আবহাওয়া, প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের চাহিদাপত্রের সমন্বয় ঘটিয়ে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক সবার জন্য আরামদায়ক ও অনুপ্রেরণামূলক রূপ ও পরিবেশ রচনা ছিল প্রকল্পটির প্রধান চ্যালেঞ্জ। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অর্থের একটি নির্দিষ্ট সীমা। রাজশাহী অঞ্চলে গ্রীষ্মের প্রখরতা থেকে রক্ষা পেতে চারতলা ভবনটিকে চতুষ্কোণী ফাঁপা ইটের আবরণে ঢেকে দেওয়া হয়। এই আবরণটির পেছনে রয়েছে ভবনটির কাঠামো আবরণ। এই দুই স্তরের আবরণ ভবনটির অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রাকে কমাতে সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বছরের সর্বোচ্চ উষ্ণ সময়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে এই আবরণটির বিশদ রূপদান করা হয়েছে। ভবনটির একটি উঠোনসহ দক্ষিণ-পূর্ব দিকটি খোলা রাখা হয়েছে সংলগ্ন মাঠের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য। স্কুল ভবনের ভূমিতে বিদ্যমান আমগাছকে রেখে দেওয়া হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের আম্র্রবীথির শীতল ছায়ায় উন্মুক্ত পরিসরে পাঠ গ্রহণের নিমিত্তে।

সাইফ উল হক স্থপতির সাম্প্রতিক কাজের বিবরণ অবশ্যই উল্লেখের দাবিদার। বহুমাত্রিক ব্যবহারের জন্য নির্মিত কেরাণীগঞ্জে অবস্থিত আর্কেডিয়া শিক্ষা প্রকল্পটি সকালের সময় ব্যবহৃত হবে বাচ্চাদের শিক্ষালয় হিসেবে, অপরাহ্ন থেকে বিকেল পর্যন্ত মহিলাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে। প্রকল্পের নির্দিষ্ট ভূমিটি বছরের এক-তৃতীয়াংশ জলমগ্ন অবস্থায় আর বাকি সময় থাকে শুকনো, ভূমির এই বৈশিষ্ট্য ভাবনায় রেখে রূপ দেওয়া হয় ছোট্ট এই প্রকল্পটির। নির্মাণাধীন এই প্রকল্পটিতে নির্মাণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বাঁশ। প্রকল্পটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো জল ও স্থলে এর সমান কার্যকারিতা। প্লাবণ সমভূমিতে বসবাসের জন্য একটি পন্থা হিসেবে এর কার্যকারিতা পরীক্ষাই এই প্রকল্পের ভবিষৎ পর্যবেক্ষণ।

শুধু প্রকল্পের রূপদানের ভেতর নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি স্থপতি সাইফ উল হক ও তাঁর প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে গবেষণা, দেশ-বিদেশে শিক্ষকতা ও প্রকল্প পর্যালোচনা, অধ্যয়ন ও আলোচনাচক্র পরিচালনা এবং লেখালেখি; বিভিন্ন সভায় অংশগ্রহণ, প্রকাশনাসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন।

রাজশাহীর প্যারামাউন্ট স্কুল ও কলেজের প্রস্তাবিত নকশা

স্থপতি সাইফ উল হকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে আসে তাঁর স্থাপত্যিক চিন্তাধারার দারুণ সব গল্প। স্থাপত্যকে শুধু ক্ষণিকের জন্য বিবেচনায় নেন না স্থপতি সাইফ উল হক। মানুষের সঙ্গে স্থাপত্যের সম্পর্কগত গভীরতা, মৌলিক চাহিদা ও প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি কর্মকান্ডকে স্থাপত্যের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করে তোলাই ছিল তাঁর প্রতিটি কাজের, চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি মানুষ পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের অংশ, তাই মানুষের দৈনন্দিন বৈশিষ্ট্য, মানসিকতা ও কার্যক্রমে সঙ্গে রয়েছে তাঁর আবাসস্থলের গভীর সম্পর্ক। পাশাপাশি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়েও মানুষের রয়েছে প্রকৃতির প্রতি একান্ত নির্ভরতা।

কথোপকথনে: স্থপতি শফিক রাহ্‌মান, প্রভাষক, স্থাপত্য বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আলোকচিত্র: ফায়জুর রহমান
অনুলেখন ও অনুবাদ: তাহিয়া তাবাচ্ছুম তৃণা

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৩ তম সংখ্যা, মে ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top