স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা কোনো রকমে ঘরে রেখেই বেরিয়ে গেছেন ঘরের বাইরে খেলার মাঠে, ঘরে ফিরতে ফিরতে যথারীতি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। খেলাধুলার প্রতি ছিল দারুণ আগ্রহ। প্রকৃতি তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করতো বলেই সব সময় ঘরের বাইরে বের হওয়ার তীব্র আকর্ষণ বোধ করতেন। তাই বলে নিয়মের বাইরে নয়, পারিবারিক মায়া, মমতা, আদর আর নিয়মের মধ্যেই বড় হয়েছেন দেশের খ্যাতিমান স্থপতি প্যাট্রিক ডি’ রোজারীও। জন্ম ১৯৭১ সালের ৭ মে পুরান ঢাকায় হলেও বেড়ে ওঠার সময়টা তথা শৈশব, কৈশোর কেটেছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। এখন কর্মরত আছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। পরিচয়টা এখানেই শেষ নয়, প্রতিষ্ঠিত আর্কিটেকচারাল ফার্ম সিনথেসিস আর্কিটেক্টসের প্রিন্সিপাল ডিজাইন অ্যাডভাইজার তিনি।
মোহাম্মদপুর সরকারি বালক বিদ্যালয়ে শুরু তার শিক্ষাজীবনের। জীবনে আজকের এ সাফল্যের ভিতটাও গড়ে উঠেছে ওখান থেকেই। তবে শুধু পড়ালেখা নিয়েই তিনি পড়ে থাকেননি, খেলাধুলাও করেছেন প্রচুর। স্কুলের বিভিন্ন খেলাধুলার পাশাপাশি একজন অ্যাথলেট হিসেবে অংশ নিয়েছেন আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ইভেন্টে। আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পেয়েছেন ব্রোঞ্জ পদক। খেলেছেন ফুটবল ও ক্রিকেট। এ ছাড়াও ছিলেন একজন সক্রিয় স্কাউট, পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য। এসব সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ফলে মানুষকে দেখা, বোঝা এবং তাদের কাছাকাছি যাওয়ার একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছে তখন থেকেই। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানোও তার কাছে একটা বড় বিষয়।

এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন নটর ডেম কলেজে। কঠোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে গড়ে ওঠায় সময়কে কিভাবে সদ্ব্যবহার করতে হয় সেটার শিক্ষা পান ওখান থেকেই। তবে জীবনের সোনালি সময় পার করেছেন বুয়েটে। এখানে কাটানো সময়গুলোকে উপভোগ করেছেন শত ভাগ। পেয়েছেন অসাধারণ কিছু বন্ধু, বড় ভাই, শুভাকাক্সক্ষী। ১৯৯৭ সালে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগ থেকে অর্জন করেছেন প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান।
ফেনীতে একটি ভবনের স্থাপত্যিক নকশার মধ্য দিয়েই কর্মজীবনের শুরু। এরপর রাজধানীর গুলশানে তার নকশায় নির্মিত হয় ওয়েস্ট উড (west wood) নামক একটি দৃষ্টিনন্দন অ্যাপার্টমেন্ট। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে ভবনটিতে স্থাপত্য শিল্পের নানান দিক ফুটে ওঠায় স্থাপনাটি নান্দনিকতায় পায় ভিন্ন এক মাত্রা। এ কাজটি ছিল তার জীবনের টার্নিং ও চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের রুমগুলোতে যেন অবারিত আলো বাতাস পৌঁছতে পারে সে জন্য ভবনটির চারপাশটাকে খোলা রাখা হয়। ভবনটিতে ঢুকলেই চোখে পড়বে খোলামেলা সিঁড়ি, যার জন্য এটিকে অ্যাপার্টমেন্ট মনে না হয়ে বাড়ি মনে হয়। এ ভবনটির ছাদে প্রায় আট কাঠা জায়গা নিয়ে রুফ গার্ডেন করা হয়েছিল যা এখন কোনো রকম লিকেজ ছাড়াই আরো বর্ণিল হয়েছে। ভবনটি এর নির্মাণশৈলীর জন্য বার্জার ইয়াং আর্কিটেক্ট অ্যাওয়ার্ড ২০০৯-এ মনোনয়ন পেয়েছিল। আর এ নির্মাণ সাফল্যই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শুরু হয় নতুন নতুন কাঠামো নির্মাণ। ওয়ার্কস ডরমেটরি, প্লাজা এআর, বে’স গ্যালারী, ব্র্যাক-আড়ং হাউজ, নাভানা এইচআর টাওয়ারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চোখ ধাঁধানো সব স্থাপনার নির্মাতা এ গুণী স্থপতি। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও তার প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে। এরই অংশ হিসেবে উজবেকিস্তানে চলছে হাউজিং প্রকল্প এবং শ্রীলঙ্কাতে রিসোর্ট নির্মাণের কাজ। এমন সব ব্যতিক্রমী আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত স্থাপনা নির্মাণে যুক্ত থাকায় কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন নানান সম্মাননা ও পুরস্কার। বে’স গ্যালারীর জন্য আইএবির উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় পেয়েছেন বার্জার ইয়াং আর্কিটেক্ট অ্যাওয়ার্ড ২০০৭। ২০০২ সালে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা প্রতিযোগিতায় তার প্রতিষ্ঠান প্রথম স্থান অধিকার করে। এ ছাড়াও জিতে নেয় ন্যাশনাল ব্যাংক হেড কোয়ার্টার ভবন নির্মাণ প্রতিযোগিতার প্রথম স্থান। আইএবি ভবনের নকশায় তার প্রতিষ্ঠান হয় তৃতীয়। ২০১১ সালে নির্মিত ব্র্যাক-আড়ং হাউজ প্রকল্পটি স্থপতি প্যাট্রিক ডি’ রোজারীওর কাছে একটি ভিন্ন মাত্রা বহন করে। কেননা চমৎকার নির্মাণশৈলীর এ ভবনে দেশের সর্ববৃহৎ এবং দেশীয় কারুশিল্পের পথিকৃৎ আড়ংকে তুলে ধরা হয়েছে সম্পূর্ণ দেশীয় সংস্কৃতির আদলে। চিরন্তন গ্রাম্য মেলার আবেদনকে শহরের ব্যস্ত জীবনে তুলে আনা হয়েছে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন স্থাপত্যিক আঙ্গিকে। উৎসব, আনন্দ ও প্রাণের মিলনের সন্ধিক্ষণ যেন এই ব্র্যাক-আড়ং হাউজ। বহতা নদীর মতো এর পরিসরগুলো বাঁক নিয়েছে নতুন নতুন সৃষ্টিশীলতায়। প্রকল্পটি মৌলিকত্বে ও উৎকর্ষে জিতে নেয় আইএবি আয়োজিত সম্মানজনক বার্জার বেস্ট আর্কিটেক্ট অ্যাওয়ার্ড ২০১১। এ ছাড়াও ২০০৯-১০ সালে অংশ নেন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। বারিধারাতে নির্মিতব্য ফ্রাংকো-জার্মান অ্যাম্বাসি ভবনের নকশায় প্রথম স্থান অধিকার করে প্রতিষ্ঠানটি। রাজউক কর্তৃক আয়োজিত মাল্টিলেভেল কার পার্কিং প্রতিযোগিতার প্রথম স্থানও দখলে রেখেছে এ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান।

নিজের মেধা এবং পরিশ্রমেই সম্ভব হয়েছে এমন সব অর্জন। তবে তার আজকের এ অর্জনের পেছনে রয়েছে বেশ কিছু মানুষের অবদান, যাদের কাছে তার ঋণ অনেক। এদের মধ্যে অন্যতম বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক দেশসেরা স্থপতি শামসুল ওয়ারেস। এ ছাড়াও বাবা-মা, ভাই-বোন সমানভাবে তাকে সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তবে তিনি যার প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ তিনি তার সহধর্মিণী মেরিনা সি. ডি’ রোজারীও, যিনি একই প্রতিষ্ঠানে তার অংশীদার। জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি ল্ইু আই কান তার আদর্শ। কারণ লুইয়ের কর্মদক্ষতা, দর্শন, জীবনাচরণ, কাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, সুগভীর ভাবনা ও দূরদর্শিতা তার জীবনদর্শন ও কর্মে প্রেরণা জোগায়। এ ছাড়া দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো তার কাজের অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস।
ভবন নকশা আর নির্মাণে এ স্থপতি সব সময় প্রাধান্য দেন বিল্ডিং নির্মাণে ব্যবহৃত মানসম্মত উপকরণ, নিয়মকানুন, আধুনিক টেকনোলজি, দেশী এবং আন্তর্জাতিক মানের সমন্বয়কে। চেষ্টা করেন যেন স্থাপনাগুলো প্রকৃতি, মানুষ, দেশের সংস্কৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ুর সাথে খাপ খায়। স্থাপনাগুলোতে যেন পর্যাপ্ত আলো, বাতাস এবং সবুজের ছোঁয়া থাকে সেদিকটায় বিশেষভাবে নজর দেন।

সফল এ স্থপতি একজন স্বাপ্নিক মানুষ। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। তবে তা শুধু কল্পনাতে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সর্বাত্মক সচেষ্ট। তাই জীবনে খুব বড় ধরনের একটা ইচ্ছা পূরণ করতে চান। প্রতিষ্ঠা করতে চান নিজস্ব একটি গবেষণাগার। আর এ গবেষণাগারেই দেশীয় উপকরণ, দালান তৈরির পদ্ধতি, জলবায়ুবান্ধব ভবন নির্মাণসহ নানা বিষয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করতে চান। এ ছাড়াও তৈরি করতে চান নিজস্ব একটি একাডেমি যেখানে নিজের অর্জিত জ্ঞান এবং বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে নবীন ও তরুণ স্থপতিদের বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হবে। চির তরুণ এ মানুষটি এখনও সময় পেলেই দেশে এবং দেশের বাইরে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। প্রকৃতিপ্রেমী এ স্থপতি প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসেন। শৈশবের সেই প্রকৃতি প্রেমের নেশাটা আজও রয়ে গেছে তার মাঝে। থাকবে আজীবন।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৪ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১২