৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী নগর ঢাকা। ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ নগর একসময় ছিল চিত্রকরের আঁকা ছবির মতোই সুন্দর। ছিল সবুজ বৃক্ষরাজি, নদী, খাল আর জলাশয়। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই শোভা পেত ফুল-ফলের বাগান। অনেক বাড়ির সামনে ছিল পুকুর ও প্রশস্ত উঠোন। ঢাকার এ অপার সৌন্দর্যের টানে বিশ্বের কত পর্যটক যে এ নগরে পা ফেলেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ এখনকার বৃক্ষহীন রুক্ষ নগরের সঙ্গে আগের সবুজ ঢাকার কোনো মিলই নেই। প্রতিনিয়ত খোলা জায়গা ভরাট করে ঢাকার বুকে গড়ে উঠছে ইট-কংক্রিটের কঙ্কাল। এ কারণে কাটা পড়ছে হাজারো গাছ। দেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকাকে ঘিরে কখনোই গৃহীত হয়নি কোনো মহাপরিকল্পনা, আর হলেও তা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। তাই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠাই এ নগরের ভবিতব্যতা। ফলে নগর ঢাকা দিনে দিনে বৃক্ষহীন, রুক্ষ ও বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাস অনুপযোগী নগরে পরিণত হয়েছে। এই বির্বণ দশা থেকে ঢাকাকে বাঁচিয়ে এর বাসযোগ্যতা ও সঠিক প্রতিবেশব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে একে সবুজ নগর হিসেবে গড়ে তোলা এ মুর্হূতের চরম বাস্তবতা।
সবুজ প্রকৃতি শুধু মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্যই নয়, পরিবেশবান্ধব নগরের জন্যও সমান প্রয়োজন। প্রকৃতি ও পরিবেশের রক্ষাকবছ গাছ। ঢাকায় এখন নির্মল বায়ুর পরিবর্তে দূষিত বায়ুর আধিক্যই বেশি। কলকারখানা, যানবাহন ও মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে প্রতিনিয়ত যে হারে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে, তা শোষণ করার মতো গাছ এ নগরে অবশিষ্ট নেই। তা ছাড়া রাজধানীর বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন প্রয়োজন, তা-ও পাওয়া যাচ্ছে না গাছের অভাবে। অথচ গাছপালা থাকলে শুধু অক্সিজেনই নয়, আবহাওয়াও থাকে বিশুদ্ধ ও নির্মল। প্রতিটি বড় গাছ বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের বেশি ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, বায়ুদূষণ রোধসহ শত শত টন কার্বন শোষণ করে গাছ পরিবেশকে অক্ষত রাখতে সহায়তা করে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বলছে, এক হেক্টর বনভূমি বছরে ১৮ লাখ গ্রাম কার্বন গ্রহণ করে। একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা যায়, বায়ুদূষণ মস্তিষ্কের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি পড়াশোনায় মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি কমায়। নাগরিকদের অবসাদগ্রস্ততা ও অস্থিরতার পাশাপাশি অধুনা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে উগ্রতা ও হিংস্রতা, তার অন্যতম কারণ পর্যাপ্ত গাছ অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশ না থাকা। তা ছাড়া এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সামাজিক স্বস্তিরও।
ঢাকার আয়তন অনুসারে জনসংখ্যা হওয়া উচিত ৫০ লাখ। বর্তমানে প্রায় পৌনে দুই কোটি লোক এ নগরে বসবাস করছে। অথচ নগর ঢাকায় হাতে গোনা কয়েকটি স্থান ছাড়া তেমন গাছপালা নেই, নেই খোলা পরিসরও। এখন ঢাকায় মোট পার্ক, উদ্যান আর খেলার মাঠের সংখ্যা ১০০ থেকে ১২০টি। এর মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে রয়েছে ৪৭টি পার্ক ও ১০টি খেলার মাঠ। পিডব্লিউডির অধীনে রয়েছে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ আরও কয়েকটি পার্ক ও মাঠ। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন রয়েছে ঢাকা চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেনসহ ছোট-বড় প্রায় ২৭টি পার্ক এবং খেলার মাঠ। এ ছাড়া পাবলিক স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ধানমন্ডি লেক, টিএসসি মতন জায়গা। সব মিলিয়ে ঢাকায় উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ৫০৩ দশমিক ৬৪ একর। পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকায় প্রতি এক হাজার জনে উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। গবেষণামতে, প্রতি এক হাজার জনে ছয় একর উন্মুক্ত জায়গা ও খেলার মাঠ থাকা উচিত, যার চার একর সর্বজনীন আর দুই একর ব্যক্তিগত। এ ছাড়া প্রতি এক হাজার জনে এক একর থাকবে বাগান এবং তিন একর থাকবে বিদ্যালয়ের ক্রীড়াক্ষেত্র। এভাবে সর্বমোট ১০ একর খোলা জায়গা থাকতে হবে প্রতি এক হাজার লোকের জন্য। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্রের পরিমাণ শুধু অপ্রতুল নয়, নিতান্তই অপর্যাপ্ত।
জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি বা ইউএনইপির তথ্যমতে, টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি শহরের মোট ২৫ শতাংশ উন্মুক্ত ভূমি থাকা প্রয়োজন। সাধারণত উন্মুক্ত ভূমি বলতে সবুজ এবং জলজ ভূমির সহাবস্থানকে বোঝায়। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ‘Urbanization and green space dynamics in Greater Dhaka, Bangladesh-2012’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেওয়ান, ব্যোমকেশসহ কয়েকজনের গবেষণা থেকে জানা যায়, ঢাকায় মাত্র ১৪ শতাংশ উন্মুক্ত ভূমি রয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরের কংক্রিট আচ্ছাদৃত এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে পাঁচ হাজার ৫০০ থেকে ২০ হাজার ৫৪৯ হেক্টর। কৃষিজমির পরিমাণ কমেছে ১২ হাজার ৪০ থেকে ছয় হাজার ২৩৬ হেক্টর। একই সঙ্গে জলাভূমি এবং সবুজ আচ্ছাদৃত এলাকা কমেছে যথাক্রমে ছয় হাজার ২৭ ও দুই হাজার ৮১২ হেক্টর। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় স্বল্পস্থায়ী জলজভূমির পরিমাণ ১৯৮৯ সালে ছিল ৪০ হাজার ৭৬৫ হেক্টর, যা ২০০৫ সালে কমে আসে ২৪ হাজার ২০৮ হেক্টরে। ২০১১ সালের একটি সমীক্ষামূলক গবেষণা থেকে দেখা যায়, ১৯৬০ সালে ঢাকা শহরে জলজ ও নিচু ভূমি ছিল যথাক্রমে দুই হাজার ৯৫২ এবং ১৩ হাজার ৫২৭ হেক্টর, যা ২০০৮ সালে কমে এসেছে এক হাজার ৯৯০ ও ছয় হাজার ৪১৪ হেক্টরে। রাজধানীর গাছ নিধন, উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয় ধ্বংসের প্রধান কারণ নতুন নতুন ভবন নির্মাণ। কোনো কিছুই এ শহরে পরিকল্পনামাফিক হয়নি। সড়ক নির্মাণ, নগরের শোভাবর্ধন, নিরাপত্তাব্যবস্থা, দুর্নীতি, অর্থের লোভসহ নানা কারণে শতবর্ষী গাছসহ সব ধরনের গাছ নিধন করা হয়েছে নির্বিচারে। এসব অসংগতি দেখার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু উভয় প্রতিষ্ঠানই তাদের দায়িত্ব পালনে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। রাজউকের একটি ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) আছে, যেখানে রাজধানীর ভূমি ব্যবহারের নানা নির্দেশনা রয়েছে। এ ছাড়া ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ অনুসারে যেকোনো প্লটে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবনের চারপাশে খোলা জায়গা ছেড়ে ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিও’ (এফএআর) বজায় রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বহুতল ভবন নির্মাণে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ১৯৯৩ অনুসরণ করাও বাধ্যতামূলক। ভবনের সামনের কিংবা চারপাশের খোলা জায়গা কোনো অবস্থাতেই পাকা না করে সেখানে উপযুক্ত প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর নির্দেশনাও আছে। অথচ কেউ কোনো নির্দেশনাই মানছে না। ঢাকার অধিকাংশ ভবন বা এর আশপাশে কোনো গাছ লাগানো হচ্ছে না বরং তা ঢেকে ফেলা হচ্ছে কংক্রিটে। শুধু ভবনই নয়, সড়ক ও ফুটপাতের পাশের গাছের সংখ্যাও কমছে। ফলে প্রখর রোদে কোনো পথচারী গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে যে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেবে, সে উপায়ও নেই। কিন্তু এগুলো দেখভালের দায়িত্ব নগর প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তর, গণপূর্ত বিভাগ ও সিটি করপোরেশনের।

জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনে বিশ্ব আজ উৎকণ্ঠিত। প্রতিবছরই বাড়ছে তাপমাত্রা। বিশেষ করে ঢাকা আজ তপ্ত এক নগর। এবারই বিগত প্রায় ৬০ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। গ্রীষ্মে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা এক অশনিসংকেত। এই তাপের হাত থেকে বাঁচতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসি, ফ্যান, কুলার, ফ্রিজ ইত্যাদির ব্যবহার। কার্বণ নিঃসরণ বেড়ে পরিবেশ বিপর্যয় আজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। পর্যাপ্ত গাছ না থাকায় ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। বড় গাছ না থাকায় প্রয়োজনমতো বৃষ্টিও হচ্ছে না। কিছু কিছু সৌন্দর্যবর্ধক ও বিদেশি গাছ লাগালেও তা বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে চরমভাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপতা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী গ্রহণ করা হচ্ছে ইকোসিটি কার্যক্রম। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ঢাকাকেও আনতে হবে ইকোসিটির আওতায়। যদি গাছপালা না কেটে, নদী-পুকুর-খাল ও জলাশয় ভরাট না করে পরিকল্পিতভাবে রাজধানীর বিস্তার ঘটত, তাহলে ঢাকার আদি অকৃত্রিম রূপ বজায় থাকত। ইকোসিটি নিয়ে আজ ভাবতে হতো না। ঢাকার প্রতিবেশব্যবস্থাকে মহাবিপর্যয় থেকে বাঁচাতে প্রচুর গাছ লাগানো প্রয়োজন। কিন্তু এই প্রয়োজনের অনেকটাই ম্লান করে দেয় ঢাকা শহরে পর্যাপ্ত খোলা জায়গার অভাব। প্রায় সব জায়গাই ভবন আর রাস্তার দখলে। এ জন্য ঢাকাকে ঘিরে নিতে হবে ভিন্ন পরিকল্পনা। শহরের ভেতরে গাছ লাগানোর সুযোগ কম থাকায় ঢাকার চারপাশে যে বেড়িবাঁধ এবং বাঁধ-সংলগ্ন এলাকা রয়েছে, সেখানে ব্যাপক বৃক্ষায়ণ করতে হবে। অর্থাৎ এসব এলাকায় প্রচুর গাছ লাগিয়ে ফরেস্ট বেল্ট বা বৃক্ষবেষ্টনী তৈরি করা যেতে পারে। এ ছাড়া যেসব স্থানে জলাভূমি রয়েছে, সেখানে জলজ উদ্ভিদ অর্থাৎ পানিতে টিকে থাকতে সক্ষম, এমন গাছ লাগানো যেতে পারে, যা বর্ষায় ও গ্রীষ্মে উভয় পরিবেশেই টিকে থাকতে সক্ষম; যেমন রাতারগুল জঙ্গল। আবার জোন-ভিত্তিক বাগানও তৈরি করা যেতে পারে। এসব বন শহরের দূষিত বায়ু শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহে সহায়তা করবে। এছাড়া হাতিরঝিল, গুলশান লেক, ধানমন্ডি লেক, আশুলিয়া প্রভৃতি স্থানেও প্রচুর গাছ লাগানোর সুযোগ রয়েছে। রাজধানীর প্রতিটি পাবলিক পার্ক, সড়কের দু-ধার, সড়কদ্বীপ, অফিস আঙিনা, স্কুল-কলেজের মাঠ, বাড়ির আশপাশ এমনকি দেয়ালের ভেতর ও বাইরে একটু উদ্যোগ নিলেই লাখ লাখ গাছ লাগানো সম্ভব। বাড়ির দেয়ালে, কাঁটাতারের বেড়া ও মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত লম্বায়, ওপর দিয়ে যদি মাধবীলতা, রংবেরঙের পাতাবাহার, লবঙ্গলতিকা, অপরাজিতা, শঙ্খচক্র, হাসনাহেনা প্রভৃতি গাছ লাগানো যায়। বাড়ির আশপাশে একটু খোলা জায়গায় শেফালি, কাঠটগর, বেলি, গন্ধরাজ, পলাশ, জবা, করবী, মহুয়া প্রভৃতি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে জারুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সোনালি, অর্জুন, নিম প্রভৃতি গাছ লাগানো হলে ঢাকার সৌন্দর্য বেড়ে যাবে বহুগুণে।
ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব ও স্থান সংকুলানের জন্য বৃক্ষায়ণ করতে হবে সম্ভাব্য সব স্থানে। একটি ভবনও হতে পারে সবুজায়নের জন্য আদর্শ স্থান। অর্থাৎ ভবন, ভবনের ছাদ, দেয়াল, কার্নিশ এমনকি ভবন অভ্যন্তরেও। পরিবেশবান্ধব ভবনের জন্য স্থাপত্য ডিজাইনে কিছু পরিবর্তনও আনা যেতে পারে। ভবনের দেয়ালে যেন সবুজ উদ্ভিদ জন্মাতে পারে, এ জন্য বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সবুজ কংক্রিট বা জৈব কংক্রিট ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় খুব সহজেই কংক্রিটে বিভিন্ন ফার্ন-জাতীয় উদ্ভিদ জন্মাবে। এ ছাড়া ভবনের গায়ে লতাবট, ফার্ন, মানিপ্লান্ট ইত্যাদি লতানো উদ্ভিদ রোপণ করে ভবনকে সবুজের আবরণে ঢেকে দেওয়া যায়। সবুজের ছোঁয়া পেয়ে ভবনটিও হয়ে উঠবে স্বাস্থ্যবান্ধব। যেসব শিল্পাঞ্চলে বেশি তাপ উৎপন্ন হয় এবং ক্ষতিকারক নানা গ্যাস সৃষ্টি হয়, সেসব স্থানে প্রচুর গাছ লাগানোর মাধ্যমে তাপ ও গ্যাস কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
অতিরিক্ত তাপমাত্রা রোধে গ্রিনরুফ বা সবুজ ছাদ কৌশলটিও স্থাপনায় দারুণ জনপ্রিয়। এই পদ্ধতিটি ভবন ও ছাদের তেমন কোনো ক্ষতি না করে একদিকে যেমন তাপের হাত থেকে বাঁচায়, তেমনি ফুল, ফল ও সবজিও পাওয়া যায়। ভবন পুরোনো বা ছাদ দুর্বল হলে রুফটপ গার্ডেনিং করা যেতে পারে। ঢাকা শহরের প্রতিটা বাড়ি বা ভবনের ছাদের দুই-তিন ভাগ স্থানে যদি গাছ লাগানো যায়, তাহলে ঢাকার সবুজায়নের এ উদ্যোগ অনেকটাই এগিয়ে যাবে। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের একদল গবেষকের প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভবনের ছাদে সবুজায়নের মাধ্যমে কংক্রিট আচ্ছাদনের তাপমাত্রা প্রায় ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং পরিবেশের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমানো যায়। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় ৩৫০টি গ্রিনরুফ প্রকল্পের মাধ্যমে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন বর্গফুটের বেশি জায়গা সবুজায়ন করা হয়েছে। এতে ওই শহরের তাপমাত্রা আশ্চর্যজনকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। এভাবে পুরো ভবনটিকে যদি সবুজে মোড়ানো যায়, তাহলে ভবনটি হয়ে উঠবে জীবন্ত; দেখাবে ছবির মতো। তখন ভবনটি হবে শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের বড় এক অংশ। শহরটিও হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত। এ ছাড়া প্রতিটি ভবন যথাযথ ফ্লোর এরিয়া রেশিও মেনে প্রয়োজনীয় অংশ খালি রেখে সেখানে গাছ রোপণ করতে হবে। ভবনে রাখতে হবে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম। বৃষ্টির পানি যেন ভূতলে পানির জোগান দিতে পারে, সে ব্যবস্থাও রাখা উচিত। সঠিক ভেন্টিলেশন সিস্টেম, খোলামেলা পরিসর, এলইডি বাল্ব, উইন্ড এনার্জি ইত্যাদি ভবনে সংযুক্ত করে সবুজ বিপ্লবে অংশ নেওয়া যায়। কারণ, এগুলোর সবকিছুই সবুজায়নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

রাজধানীর হারানো রূপ ফিরিয়ে এনে সৌন্দর্যবৃদ্ধির নামে মাঝেমধ্যে বিউটিফিকেশন নামক কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম সড়কদ্বীপ ও সড়কের পাশে গাছ লাগানো হয়। সরকারি ও বেসরকারি উভয় উদ্যোগে কাজটি হয়। সৌন্দর্যবর্ধনে সাধারণত বিদেশি গাছ প্রাধান্য পায়। এ দেশের আবহাওয়ায় যা খাপ খেয়ে টিকে থাকতে সক্ষম কি না, তা যথাযথভাবে যাচাই করা হয় না। ফলে অনেক গাছই কিছুদিনের মধ্যে মারা যায়। উদাহরণসরূপ বলা যায় এয়ারপোর্ট রোডের দুপাশে অনেক বিদেশি গাছ লাগানো হয়েছে। হাতিরঝিলে বিদেশি পামগাছ লাগানো হয়েছে। এতে পরিবেশবাদীরা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। অথচ আমাদেরই রয়েছে অসংখ্য দেশীয় ফুল ও ফলের গাছ। কিন্তু ঢাকায় এসব গাছ লাগানোর ব্যাপারে উদাসীনতা দেখা যায়। ফলের গাছ না থাকায় এ শহর থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পাখি কমেছে। তা ছাড়া ফলের গাছ না থাকায় বস্তি ও দরিদ্র শিশুরা পুষ্টিহীনভাবে বেড়ে উঠছে। বিদেশি গাছগুলোর আয়ুও কমছে।
সরকারি উদ্যোগে রাজধানীতে প্রতিবছর গাছ লাগানোর কথা থাকলেও বেশ কয়েক বছর ধরে তা-ও হচ্ছে না। এ ছাড়া আগে রোপণকৃত গাছগুলো পরিচর্যার অভাবে মারা যাচ্ছে। ঢাকার ডিসিসি, বেইলি রোডের বিভাগীয় ও মহাখালীতে অবস্থিত ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমন্বয় করে গাছ রোপণ করা হয়। বন বিভাগের সূত্রে জানা যায়, বিগত পাঁচ বছরে সামাজিক বন বিভাগ ঢাকার রাস্তাঘাট ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গাছ লাগিয়েছে ৪৮ হাজার ৬০০টি।
এ ছাড়া গণপূর্ত অধিদপ্তরের আরবরিকালচার বিভাগ সচিবালয়, সরকারি অফিস, ওসমানী মিলনায়তন, হাইকোর্ট, ধানমন্ডি এলাকার ভিআইপি বিভিন্ন স্থাপনা, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন, মিন্টো রোড, ইস্কাটন ও সিদ্ধেশ্বরীর সরকারি বাড়ি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিভিন্ন সরকারি ভবনে বেশ কিছু গাছ লাগিয়েছে। বলাবাহুল্য, কাগজে-কলমে তালিকা দীর্ঘ হলেও, বাস্তবে এত গাছ শহরে দৃশ্যমান নয়। বন বিভাগ সূত্র বলছে, বিভিন্ন ফলের গাছ ছাড়াও সেগুন, শাল, গর্জন, মেহগনি, গামার, রেইনট্রিসহ বিভিন্ন গাছ লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে শহরের রাস্তার ডিভাইডারে সাধারণত লাগানো হয় আকাশমনি, গর্জন, গামার, মেহগনি, উইপিং দেবদারু ও রেইনট্রি। পার্কের সৌন্দর্যবৃদ্ধি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় লাগানো হয় উইপিং দেবদারু, মেহগনি ও বিভিন্ন ধরনের থুজাগাছ।
নব্বই দশকে নগর বনায়ন প্রকল্পের আওতায় নগরে শুরু হয় সৌন্দর্যবর্ধন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ রোপণের কর্মসূচি। বন বিভাগ ও ডিসিসির আওতায় এই গাছগুলো রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করা হয়। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে নগরের সৌন্দর্যবর্ধনে রাস্তার ডিভাইডারে লাগানো হয় নানা রকম গাছ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে এসব গাছ লাগানো হলেও পরবর্তী সময়ে এগুলো আর তেমন পরিচর্যা করা হয় না।
রাজধানীকে নিয়ে কার্যকর কোনো মহাপরিকল্পনা আজ অবধি হয়নি, যদিও ভবন নির্মাণে কিছু বিধিমালা রয়েছে রাজউকের। এই বিধিমালায় প্রতিটি ভবন নির্মাণে ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিও’ মানতে হয়। কিন্তু বিশ্বের বড় বড় জনবহুল শহরগুলোকে সবুজায়নে বর্তমানে ‘গ্রিন প্লট রেশিও’র আওতায় আনা হয়েছে এবং তা মানা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া শহরগুলোকে সবুজ ল্যান্ডস্কেপিং ব্যবস্থার আওতায় আনার গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ঢাকাকে বাঁচাতে যদি এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায় তাহলে খুব দ্রুতই এ নগর সবুজে ভরে ওঠবে। এখানে বিকাশ ঘটবে অনেক ল্যান্ডস্কেপ প্রতিষ্ঠান, নার্সারির মতন শিল্পের। সেই সঙ্গে সুযোগ সৃষ্টি হবে ব্যাপক কর্মসংস্থানের। দেশের রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো যেন ‘গ্রিন প্লট রেশিও’ বা ‘সবুজায়ন আইন’ মেনে প্রকল্প নির্মাণ করে, তা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর তা দেখভালের দায়িত্ব রাজউক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের। প্রতিটি ভবন নির্মাণে ‘গ্রিন সার্টিফিকেট’ অর্থাৎ ভবনটি গাছপালাসমৃদ্ধ পরিবেশবান্ধব কি না, তা আইনে নিশ্চিত করতে হবে। এ আইন না মানলে ‘গ্রিন ট্যাক্স’ কার্যকর করা যেতে পারে।
ঢাকাকে সবুজ করে তুলতে, এ শহরের বাসযোগ্যতা রক্ষার্থে আর এর হারানো প্রাকৃতিক গৌরব ফিরিয়ে আনতে নিতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ। এর একমাত্র উপায় সবুজ বিপ্লব। এ জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে; বৃক্ষায়ণে এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকার সৌন্দর্যবৃদ্ধির পাশাপাশি নগরবাসীর সুস্বাস্থ্যে গাছের ভূমিকা নিয়ে নাটক, গান, কবিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সেমিনার ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করতে হবে। আয়োজন করতে হবে বেশি বেশি বৃক্ষমেলার। মেলা চলাকালে পর্যাপ্ত প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করলে নতুন প্রজন্মকে গাছ লাগাতে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হবে। তা ছাড়া গাছ যে শুধু পরিবেশবান্ধব তা-ই নয়, বরং এ থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়, সেটাও সবার মাঝে তুলে ধরতে হবে। নদীতীর, খালপার, খেলার মাঠ, জলাভূমি প্রভৃতি স্থান দখলমুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে সবুজ উদ্যান। তবেই ঢাকার মানচিত্র ভরে উঠবে স্নিগ্ধ সবুজের বিশাল এক উদ্যানে। চার শতবর্ষী প্রাচীন নগর ঢাকা ফিরে পাবে সবুজে ঘেরা তার হারানো সৌন্দর্য।
– মারুফ আহমেদ