একটি জাতির পরিচয় তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যে। ঐতিহ্যের ধারক যেমন ভাষা, পোশাক, সংস্কৃতি; তেমন ঐতিহ্যের অন্যতম বাহক একটি দেশের স্থাপত্য। তাই পৃথিবীজুড়ে মানবসভ্যতা অতি যত্নে সংরক্ষণ করছে তার ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ। বাংলাদেশেরও রয়েছে স্থাপতিক ঐতিহ্যে হাজার বছরের অনন্য নিদর্শন। কিন্তু ঐতিহাসিক স্থাপত্যের রক্ষণাবেক্ষণে আমাদের উদাসীনতার কারণে অনেক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন স্থাপত্য বিলীন হয়েছে, আমরা হারিয়েছি মূল্যবান স্থাপত্যিক ঐশ্বর্য। বিশেষত, রাজধানী ঢাকার প্রেক্ষাপটে এমন অসংখ্য ইতিহাস-প্রসূত স্থাপনা রয়েছে, যা রয়ে গেছে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে। এমনই একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ইতিহাস জানতে ফিরতে হবে ঢাকা শহরের ইতিহাসে। কত বছরের পুরোনো আমাদের প্রাণপ্রিয় এই নগর? বলা হয় ৪০০ বছর। প্রকৃতপক্ষে এই ৪০০ বছরের ইতিহাস ঢাকার রাজধানী হয়ে ওঠার ইতিহাস। কিন্তু ঢাকার প্রকৃত ইতিহাস বলতে গেলে আরও বেশ কিছুটা আগ থেকেই শুরু করতে হয়। মোগল সম্রাট আকবরের আমল থেকেই ঢাকায় ছিল পুরোনো আফগান কেল্লার অবস্থান। পরে ইসলাম খান বাংলার সুবেদার হয়ে আসার পর মুসা খাঁকে পরাজিত করে আফগান কেল্লাটি দখলে নেন। সে সময় থেকেই মোগল সাম্রাজ্যের পরিচালনাস্থল তথা ইসলাম খানের আবাসস্থল হিসেবে কেল্লাটি ব্যবহৃত হতে থাকে। কালক্রমে কেল্লার সামনে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের বিখ্যাত চকবাজার। ইসলাম খান ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করার পর এখান থেকেই শুরু হয় নগর ঢাকার বিকাশ। যাতায়াত ও বাণিজ্যিকর সুবিধার কারণে বুড়িগঙ্গার তীর ধরে গড়ে ওঠে ঢাকা মহানগরী। প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠে বড় কাটরা ও ছোট কাটরা, স্থাপিত হয় লালবাগ কেল্লা। একদিকে যখন ঢাকা রাজধানী হিসেবে প্রস্ফুটিত হতে থাকে, পুরোনো আফগান কেল্লাটিও যেতে থাকে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। কিছু সময়ের জন্য কেল্লাটি টাঁকশাল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। মোগল আমল থেকেই এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েদিদের এনে রাখা হতো। পরে ইংরেজ শাসনামলে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ কারাগারে রূপান্তরিত হয়। গোড়াপত্তন হয় আজকের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের।

ইতিহাসের পাতা থেকে এখন ফিরে তাকালে দেখা যায়, পুরান ঢাকার ঘনবসতির মাঝে আজও টিকে আছে কয়েক শতবর্ষের এই কারাগারটি। সর্বমোট প্রায় ৩৮ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এই কারাগারের উঁচু দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে মনে প্রশ্ন জাগে, কী আছে দেয়ালের ওপারে? ইংরেজ শাসনামলেই কয়েদিদের স্থানসংকুলানের জন্য ভেঙে ফেলা হয় পুরোনো আফগান কেল্লাটি, প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন নতুন ভবন। পুরোনো কেল্লার দেয়ালটি ভেঙে ফেলা হলেও কামান প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা থাকার দরুন অক্ষত রাখা হয়েছিল দক্ষিণ-পূর্বের অংশটি। বাংলা চলচ্চিত্রের কল্যাণে আজকের বিখ্যাত হয়ে ওঠা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের মাঝে আজও এই পুরোনো দেয়ালের অবস্থান চিহ্নিত করা যায় সহজেই। সে সময় গড়ে ওঠা নতুন ভবনগুলো কালের বিবর্তনে আজ জরাজীর্ণ দশায়। কিন্তু তারপরেও লাল ইটের এই দালানগুলোর দিকে তাকালে আজও ধরা পড়ে কলোনিয়াল ভবনের চিরচেনা সৌন্দর্য।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নীরব সাক্ষী এই কারাগার। প্রতিটি আন্দোলনের ইতিহাস ধরে রেখেছে জেলখানার দেয়ালগুলো। জেলখানায় বন্দী জাতীয় চার নেতা হত্যার সাক্ষ্য দেয় মৃত্যুঞ্জয়ী সেলের গারদে বুলেটের দাগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারে অবস্থানের স্মৃতি নিয়ে আজও আছে দেওয়ানি সেল। সম্প্রতি এই সেল দুটিকে মিউজিয়ামে রূপান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস ধরে আছে কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ আর প্রতিটি সেলের প্রতিটি দেয়াল।

রাজধানীর চকবাজারে পুরান ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রায় ৩৮ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এই কারাগার স্থানান্তরের প্রস্তাব বহুদিনের। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ থেকে জানা যায়, ১৮৬৯ সালে সর্বপ্রথম এই কারাগার স্থানান্তরের প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল। ১৯১৭ সালে প্যাট্রিক গেডডেসও ঢাকা নগরীর জন্য তাঁর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই কারাগার স্থানান্তরের প্রস্তাব দেন। পরে ঢাকা নগরীর জন্য প্রস্তাবিত প্রতিটি মাস্টারপ্ল্যানেই পর্যায়ক্রমে উঠে এসেছে এই প্রস্তাবনা। ঢাকা নগরীর জন্য প্রস্তাবিত ১৯৫৯ সালের প্রথম ডিআইটি মাস্টারপ্ল্যানেই বলা হয়েছিল এই কারাগার স্থানান্তরের কথা। ১৯৮১ সালের ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন এরিয়া ইন্টিগ্রেটেড আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’-এ পুনরায় এই প্রস্তাবনার পর ১৯৮৭ সালে ক্যাবিনেট মিটিংয়ে কারাগার স্থানান্তরের সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ডিএমডিপি, ২০১০ সালের ডিএপি এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালের ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে এই প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। স্থানান্তরের কারণ হিসেবে কখনো ছিল কয়েদিদের স্থান সংকুলানের অভাব, কখনো বা নিরাপত্তার অভাব, কখনো বা কারাগারের আধুনিকায়ন। তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল, পুরান ঢাকার কেন্দ্রস্থল থেকে এই কারাগারের স্থানান্তর খুলে দেবে অনেক সম্ভাবনার দুয়ার। সমাধান হতে পারে পুরান ঢাকার নাগরিক সব সমস্যার। শতবর্ষের দীর্ঘসূত্রতার পর আজ আলোর মুখ দেখছে এই স্থানান্তরের প্রস্তাবনা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের জন্য কেরানীগঞ্জে তৈরি হয়েছে আধুনিক সুবিধাসংবলিত নতুন কারাগার। নতুন কারাগারে সম্পূর্ণরূপে স্থানান্তরের পর কী হবে এই পুরোনো পরিত্যক্ত কারাগারের?

পুরান ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ঐতিহাসিক স্থাপনাসংবলিত এই স্থান হতে পারে পর্যটনের আকর্ষণীয় কেন্দ্রস্থল, যাকে ঘিরে পুনরুজ্জীবিত হতে পারে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক সব স্থাপনা; ছোট কাটরা, বড় কাটরা বা লালবাগ কেল্লা। কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে হয়তো উঠে আসবে ঢাকার সর্বপ্রথম কেল্লার ভিত্তি আর উন্মোচিত হবে ঢাকার প্রাচীন ইতিহাসের এক নতুন পাতা। ঢাকার উন্মুক্ত উদ্যান আর খোলা জায়গার যে অভাব তা পূরণ করতে এক অপার সম্ভাবনাময় প্রকল্প হতে পারে কেন্দ্রীয় এ কারাগার। কিন্তু সর্বোপরি নতুন চিন্তাধারার মাঝে এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের সংরক্ষণ হওয়া উচিত এখনকার মূল ভাবনা।
শেখ রিসাদ আহম্মদ, প্রভাষক, স্থাপত্য বিভাগ,
আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৫ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১৬