সফল ব্যবসায়ী আহমেদ আকবর হোসেন হেনা

হেমন্তের পড়ন্ত বিকেল। মাঠে মাঠে সোনা রঙের পাকা ধান। ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষকের কণ্ঠে মাঝে মধ্যেই ভেসে আসছে আঞ্চলিক গানের সুর। সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও চলছে ধান কাটার উৎসব। বন্ধনের নিয়মিত আয়োজন ‘সফল যারা কেমন তারা’ পর্বের সফল ব্যবসায়ীর খোঁজে এবার এসেছি পদ্মা বিধৌত বরেন্দ্রভূমি রাজশাহীতে। আকিজ সিমেন্টের আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানকে সঙ্গী করে চলে এলাম দুর্গাপুর থানার মেসার্স জীবন ট্রেডার্সে। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আহমেদ আকবর হোসেন হেনা এলাকার একজন সফল ব্যবসায়ী। তারই বর্ণাঢ্য জীবনের সাফল্যগাথা এবার।

তখন তিনি ২য় শ্রেণীর ছাত্র। পড়ালেখা বা খেলাধুলার এ বয়সেই বসতেন পিতার কাপড়ের দোকানে। সকালে স্কুল বিকেলে দোকানে বসে ব্যবসা দেখা। এভাবেই উত্তরাধিকার সূত্রে শুরু ব্যবসায়িক জীবনের। পাকিস্তান আমল থেকে এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ী পরিচয়টাকে ধরে রেখেছেন। কাপড়ের ব্যবসা করেছেন দীর্ঘদিন। হাটের ইজারাদারিসহ অন্যান্য ব্যবসাতেও ছিল সমান পদচারণা। ২০১০ সালে শুরু করেন নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা। কাপড়ের ব্যবসার পাশাপাশি এই ব্যবসায় শুরুতেই পেয়ে যান সফলতার দেখা। সামগ্রিকভাবে নির্মাণশিল্পে যখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তখন দুর্গাপুরও পিছিয়ে নেই। মাটির বাড়ির স্থান দখল করে নিচ্ছে ইট-সিমেন্টের পাকা বাড়ি। ব্যবসাটির ব্যবসায়িক সম্ভাবনার দূরদৃষ্টি থেকেই সিমেন্ট, টিন, রড, কংক্রিটের একজন খুচরা বিক্রেতা হিসেবে এই ব্যবসায় আত্মপ্রকাশ করেন। এলাকার সর্বত্রই একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত থাকায় অল্প সময়েই সফলতার দেখা পান এলাকার সফল এই ব্যবসায়ী ।

জন্ম ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি রাজশাহীর দুর্গাপুর থানার গোঢ়খাই গ্রামে। পিতা মৃত সবির উদ্দীন মোল্লা ও মা মৃত জমেলা বেগম। ৪ ভাই ও ৫ বোনের সংসার। ১৯৬৮ সালে দুর্গাপুর (বর্তমান পাইলট) উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭২-এ শাহ মখদুম কলেজ, রাজশাহী থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর একই কলেজে স্নাতকে ভর্তি হন। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড ও ব্যবসায়িক ব্যস্ততার কারণে শেষ করা হয়নি গ্রাজুয়েশন। তবে স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশে স্নাতক পড়–য়া একজন শিক্ষার্থীর জন্য সুযোগ ছিল লোভনীয় সব চাকরির। কিন্তু চাকরির প্রতি কখনোই তার কোনো মোহ ছিল না। পিতাও চাইতেন না তার ছেলে অন্যের অধীনে চলুক। বন্ধুদের অনেকেই বড় মাপের চাকরি করলেও এর জন্য ছিল না কোনো অনুশোচনা। মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন একজন ব্যবসায়ী হতে। হয়েছেনও তাই। ব্যবসা তাকে জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য দিলেও জীবনের পূর্ণতা এসেছে পরিবার থেকে। স্ত্রী, ১ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। ছেলে ইকবাল হোসেন মনি ও মেয়ে শামিমা আক্তার সুমি। বাবা হিসেবে নিজেকে সুখী ভাবেন তিনি।

ব্যবসায়িক দক্ষতা পেলে বাবা তাকে পারিবারিক ব্যবসা থেকে আলাদা করে দেন। সাথে মূলধন হিসেবে দেন মাত্র ১০৬ টাকা। সামান্য এ টাকা দিয়েই শুরু হয় একক ব্যবসা। কাপড়ের পাশাপাশি পাট, পান, গুড়, সরিষা, বই ইত্যাদি পণ্যের প্রসার বাড়ান এলাকায়। সপ্তাহে ৩ দিন হাটে দোকান দিতেন, অন্য দিনগুলোতে করতেন লেখাপড়া। এভাবেই চলছিল তার ব্যবসা। একসময় স্কুল পেরিয়ে আসেন কলেজে। বাবা ব্যবসা আলাদা করে দিলেও তদারক ঠিকই করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ফলে তার কাছ থেকে শেখা ব্যবসায়িক কৌশল ও নীতির প্রয়োগে ক্রমেই বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিসর। পণ্যের গুণগত মান, ন্যায্যমূল্য ও ব্যাপক পরিচিতি ধীরে ধীরে এনে দেয় ক্রেতাপ্রিয়তা। বাজারে নতুন দোকান দেন। এ পর্যায়ে ব্যবসায় যোগ দেন তার ছোট দুই সহোদর মোঃ সাইদুর রহমান (মন্টু) ও একেএম মোহাইমেনুল হক (রেন্টু)। তিন ভাইয়ের মিলিত প্রচেষ্টা ও শ্রমে এগিয়ে যেতে থাকে তাদের ব্যবসা। তার অন্য দুই ভাইও স্বনামে পরিচিত। মোঃ সাইদুর রহমান এলাকার একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। দীর্ঘ ৯ বছর (২০০০-২০০৯) দুর্গাপুর পৌরসভার মেয়র ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল দুর্গাপুর থানার সাধারণ সম্পাদক। পাশাপাশি ঠিকাদারি কাজের সাথে যুক্ত। মৌসুমভিত্তিক কৃষি পণ্যের স্টক ব্যবসাও করেন। ২ সন্তানের জনক। সন্তানদের একজন শাহ আলম সবুজ অন্যজন আল সাইফ জীবন। ব্যবসায়ী আকবরের আরেক ভাই একেএম মোহাইমেনুল হক নির্মাণ ব্যবসার পাশাপাশি কাপড়ের ব্যবসা করেন। এ ছাড়াও এলাকার একজন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার। একসময়ে হাটের ইজারাদারিও করেছেন। বর্তমানে তিনি দুর্গাপুর বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। ১ ছেলে আশিকুর রহমান অথৈইয়ের জনক। এদেরই অন্য এক ভাই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত।

ব্যবসায় সফলতা লাভ খুব সহজ নয়। এ কাজে সফলতা পেতে সর্বপ্রথম আত্মার শুদ্ধতা আনতে হবে। হতে হবে সৎ। দোকানে থাকতে হবে পর্যাপ্ত মালামাল। ক্রেতাকে সর্বাত্মক ও দ্রুত সেবা দিতে হবে যাতে কেউ দোকানে পণ্য কিনতে এসে অপেক্ষা না করে। এ সবই শিখেছেন বাবার কাছে। তিনি বলতেন যত বড় ব্যবসায়ীই হও খুব সকালে দোকান খুলে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে খোলা রাখবে। মানুষ যেন পণ্য কিনতে এসে ফিরে না যায়। এ নিয়ম তিনি এখনো মেনে চলেন। প্রতিদিন ক্যাশ ও স্টক মেলানো, খতিয়ান বইয়ে হিসাব রাখা এসব কাজ করতে বলতেন আর্থিক হিসাব স্বচ্ছ রাখার জন্য। তিনি শিখিয়েছেন পণ্যের দাম এমন চাইতে যাতে ক্রেতা ঘাবড়ে না যায়। অর্থাৎ সীমিত লাভে পণ্য বিক্রি করার পরামর্শ তার। এ পরামর্শগুলোই অন্যদের প্রতি ব্যবসায়ী আকবর হোসেনের।

আহমেদ আকবর হোসেন, একেএম মোহাইমেনুল হক ও মোঃ সাইদুর রহমান (বাম থেকে)

ছোট থেকেই খেলাধুলার প্রতি সফল এ মানুষটির ছিল চরম আগ্রহ। ফুটবল তার প্রিয় খেলা। খেলতেন সেন্টার বা ফরোয়ার্ড পজিশনে। আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। উপজেলা পর্যায়ে হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। খেলাটির সাথে জড়িয়ে ছিলেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। পরবর্তীতে রেফারির দায়িত্বও পালন করেন। বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী দেশীয় খেলার আয়োজন করতেন। ক্রীড়ামোদী এই মানুষটি বর্তমানে উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। স্কুল জীবন থেকেই জড়িত স্কাউটিংয়ের সাথে। দুর্গাপুরে উপজেলা স্কাউট ভবন নির্মিত হয়েছে তারই প্রচেষ্টায়। এলাকার সামাজিক কাজেও রয়েছে সমান অংশগ্রহণ। স্কুল-কলেজ নির্মাণে রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। তিনি উপজেলা মাদ্রাসা সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। বিপদাপদে মানুষ তার কাছেই ছুটে আসে। সাধ্যমতো চেষ্টা করেন সহায়তা করতে। যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে যেতে হয়। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন প্রায়ই। তাদের বিশাল পরিবারে সদস্য সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, প্রায় ১৫০ জন। সবাইকে নিয়ে প্রায়ই চলে খিচুড়ি উৎসব। আগে প্রতি মাসেই হলেও এখন এ আয়োজন হয় তিন মাস পর পর। উৎসবটি তাদের পারিবারিক মিলনমেলায় রূপ নিয়েছে। 

সারাজীবন নানা ধরনের ব্যবসা করলেও তিনি চান একটি স্বনামধন্য সিমেন্ট কোম্পানির ডিলার হতে, সুস্থভাবে নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা করতে। তার মতে, ব্যবসায় প্রতিযোগিতা থাকবে কিন্তু থাকবে না প্রতিহিংসা। অনেক দিন থেকেই চেষ্টা করছেন এলাকায় একটি সাংস্কৃতিক দল গঠনের কিন্তু তা আজও হয়ে ওঠেনি। তার সাংস্কৃতিক প্রেম সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। অনুরোধ রেখেছিলাম দুর্গাপুর এলাকার ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠান সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে। তিনি বন্ধনকে প্রতিশ্রতি দিয়েছেন। তার উদ্যোগ যেন সফল হয় বন্ধন পরিবারের পক্ষ থেকে তার জন্য রইল শুভ কামনা। 

 মাহফুজ ফারুক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩২ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top