ছবি আঁকা তাঁর শখ। ছোটবেলা থেকেই সুন্দর আঁকতেন। যা ভালো লাগত তা-ই আঁকতেন। স্কুলের আর্ট কমপিটিশনে প্রত্যেকবারই হতেন প্রথম। সুন্দর ছবির আঁকায় পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা। ছবি আঁকার এই ব্যাপারটি মনের অজান্তেই তাঁর ভালো লেগে যায়। তখন থেকেই বিভোর একজন চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্নে। লক্ষ্য পূরণে ভর্তি হন কলকাতার রবীন্দ্রভারতী আর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিধি বাম! পরিবার পেশাটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারল না। তাই তাঁকে ছাড়তে হলো বিশ্ববিদ্যালয়। আর এতেই অপূর্ণ রয়ে গেল চিত্রশিল্পী হবার স্বপ্ন। নাই বা হলেন চিত্রশিল্পী কিন্তু সুনাম কুড়িয়েছেন একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার পুরোনো থানা এলাকার ‘মেসার্স খোকন ট্রেডার্স’-এর স্বত্বাধিকারী খোকন কুমার সাহা। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির ভৈরবের আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা রাজীব কুমার সাহার সহায়তায় বন্ধন-এর নিয়মিত আয়োজন ‘সফল যাঁরা কেমন তাঁরা’ পর্বে এবার জানাব তাঁরই সফলতার গল্প।
ব্যবসায়ী খোকন কুমারের জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া গ্রামে, ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর। বাবা হরেন্দ্র চন্দ্র সাহা ও মা স্বর্গীয় মলিনা রাণী সাহা। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার। পারিবারের প্রায় সবারই রয়েছে পরিবহন ব্যবসা। বলা চলে একমাত্র তাঁরাই কিশোরগঞ্জের আদি পরিবহন ব্যবসায়ী। এ ছাড়া প্রায় ৪৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী মায়া বেকারির কর্ণধারও এ পরিবার। পরিবারের তিন ভাই ও সাত বোনের মধ্যে তিনি অষ্টম। জেলা শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। বেশ কয়েকটি স্কুল বদলের পর আজিম উদ্দীন হাইস্কুল থেকে ১৯৯০ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর কলেজে ভর্তি হলেও সে পাট চুকে যায়। আসলে ইচ্ছে ছিল বিদেশ যাওয়ার; তাই তো ছেড়েছিলেন কলেজ কিন্তু শেষ পর্যন্ত মায়ের আপত্তিতে তাও হয়নি। কী আর করা, ১৯৯৩ সালে বড় ভাইয়ের সঙ্গে শুরু করেন ব্যবসা। প্রায় দুই বছর পর ১৯৯৫ সালে শুরু করেন একক ব্যবসা। পুরোনো থানা এলাকার নরসুন্দা নদের তীরে তাঁদেরই অব্যবহৃত একটি দোকানে হয় তাঁর ব্যবসায়িক ঠিকানা। সেখানেই সিমেন্ট, রড, ঢেউটিন, স্যানিটারি পণ্য, ইট এসব পণ্যসম্ভারেই চলে তাঁর নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা। টিনপট্টির অর্থাৎ মার্কেটের শেষ সারিতে দোকানের অবস্থান হওয়াই অসংখ্য দোকান পেরিয়ে ক্রেতাকে আসতে হতো তাঁর দোকানে। অনেকে আবার বুঝতও না এখানে দোকান আছে। তাই বিক্রিও হতো তুলনামূলক কম। পাঁচ-সাত বছর এভাবেই চলেছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই তিনি সৃষ্টি করেন অসংখ্য ক্রেতা আর ব্যবসাকেও নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। তুলনামূলক কম মুনাফায় মানসম্মত পণ্য বিক্রি, সততা, ভালো ব্যবহার এসবেই মূলত ক্রেতারা আকৃষ্ট হন। তবে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে তাঁর কঠোর পরিশ্রম। আর তাই ব্যবসার পরিসর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় তাঁর সুনাম। বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলার নির্মাণসামগ্রীর প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি জেলাটির আকিজ সিমেন্টের সর্বোচ্চ বিক্রেতা। অন্যান্য কোম্পানির পণ্য বিক্রিতেও রয়েছে তাঁর সমান সাফল্য। আর তাই স্বীকৃতিস্বরূপ একটি কোম্পানির পক্ষ থেকে ভ্রমণ করেছেন মালয়েশিয়া। এ ছাড়া নেপালসহ অন্যান্য দেশ ভ্রমণের অফারও রয়েছে। উপহারস্বরূপও পেয়েছেন বেশ কিছু টেলিভিশন, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রো ওভেন, ডিজিটাল ক্যামেরা, ডিনার সেট, ট্যাবলেট পিসি, মোবাইল, নগদ টাকাসহ অন্দরসজ্জার নানা সামগ্রী। বর্তমানে বাজারে রয়েছে তাঁর তিনটা শোরুম ও দুটো গোডাউন। পরিবহনের ব্যবসায়ও রয়েছে তাঁর সরব পদচারণ।

২০০০ সালে বেবী সাহার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সফল এ ব্যবসায়ী। তাঁদের দুটি সন্তান। বড় ছেলে হরিজিৎ সাহা শ্রাবণ চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে ও ছোট ছেলে প্রিয়জিৎ সাহা শাণের বয়স প্রায় তিন বছর। তিনি একজন ব্যস্ত ব্যবসায়ী হলেও উৎসব-বিনোদন খুবই পছন্দ করেন। অবসরে শোনেন গান। সময় পেলেই বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, বান্দরবানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। এ ছাড়া নানা সামাজিক কাজেও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। বর্তমানে সম্পৃক্ত আছেন বিএএসএসডি নামক একটি এনজিওর সঙ্গে। এ ছাড়া কালীবাড়ি মন্দির কমিটি ও শ্রী শ্রী গোপীনাথ জিওর আখড়ার আজীবন সদস্য। শীতবস্ত্র বিতরণ, দুস্থদের সহায়তা, উৎসব উদ্যাপনে অর্থ সহায়তাসহ নানা কাজেই রয়েছে তাঁর অংশগ্রহণ।
সারা দিন নৌকায় ঘোরা, বড়শি দিয়ে মাছ ধরা, অন্যের গাছের ফল চুরি এসব করেই কেটেছে আনন্দ-ঝলমল ডানপিঠেপনায় ভরপুর এক শৈশব। মাছ ধরা ছিল তাঁর নেশা। মাঝে মাঝে তো মধ্যরাত পর্যন্ত মাছ ধরতেন। এখনো সময় পেলেই বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন। তাঁর দস্যিপনায় এলাকার মানুষ ছিল অতিষ্ঠ। কারও বাড়ি ঢিল পড়লে, গাছের ফল খোয়া গেলে দোষ পড়ত তাঁর ওপরই। কাকাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়েই চলত এহেন কার্যকলাপ। দুরন্তপনা এতটাই মাত্রা ছাড়িয়ে ছিল যে তাঁর বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে সংশোধনের জন্য। অবশ্য কর্তৃপক্ষ অপরাধকে খুব গুরুতর মনে করেনি বলে সেবারের মতো রক্ষা। ফুটবল ছিল তাঁর প্রিয় খেলা।
নিমার্ণ সামগ্রীর ব্যবসা এখন তৃণমূলে পৌঁছেছে। এতে অন্য ব্যবসার তুলনায় মুনাফাও এখন কম। তাই ব্যবসায় ভালো করতে সততা ও শ্রমের কোনো বিকল্প নেই। ক্রেতার বিশ্বাস অর্জন জরুরি। এ ছাড়া সতর্কতার সঙ্গে বাকিতে ব্যবসা করা উচিত। ক্রেতার ওপর কখনো বিরক্ত হওয়া যাবে না। তাঁর কাছে নবীন ব্যবসায়ী যাঁরা আসেন, তাঁদের তিনি এভাবেই পরামর্শ দেন; উৎসাহিত করেন।

কিশোরগঞ্জের বাজারে ব্যবসা খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ। সীমিত লাভে সবাই পণ্য বিক্রি করে। তাই খুচরা পর্যায়ে ব্যবসা করা খুব দুরূহ। তিনি চান ডিলারভিত্তিক ব্যবসা করতে। এ জন্য কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আরও কিছুটা সহায়তা ও মুনাফা প্রত্যাশা করেন। এ ছাড়া ইচ্ছা আছে পরিবহনের ব্যবসাকেও বড় করার। তাঁর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মেলবন্ধন ঘটুক বন্ধন পরিবারের এমনটাই প্রত্যাশা।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪১ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৩