ব্যবসা করুন দেশকে ভালোবেসে
একজন সফল ব্যবসায়ীর গল্প

ব্যবসা শুধু লাভ-লোকসানের খতিয়ান নয়, সম্মানেরও। কিন্তু ব্যবসা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন ব্যবসায় সফলতা আসে। কাঙ্খিত সেই সফলতার দেখা পেয়েছেন ব্যবসায়ী মো. আবুল বাসার ওরফে রিকু। সাভারের হেমায়েতপুরের পূর্বহাটি নতুনপাড়া রোডের মেসার্স মা ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী তিনি। কিন্তু কীভাবে সফল হওয়া যায় ব্যবসায়? আসুন, জেনে নিই তাঁরই রয়ানে। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা মো. সারোয়ার মোর্শেদের সহায়তায় ‘সফল যাঁরা কেমন তাঁরা’ পর্বে এবার জানাব তাঁরই ব্যবসায়িক সাফল্যের কৌশল।

ব্যবসায়ী মো. আবুল বাসার ওরফে রিকুর জন্ম ১৯৭৯ সালের ১ মার্চ, ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার হেমায়েতপুরে। বাবা মরহুম মো. জালাল উদ্দিন, মা আলহাজ সালেহা বেগম। বাবা জুট মিলে চাকরি করতেন। প্রবাসেও চাকরি করেছেন বেশ কিছুদিন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ছয় ছেলে ও দুই মেয়ের বিশাল এক পরিবার একা চালানো তাঁর পক্ষে কষ্টকর বৈকি! তবে সংসারে অভাব থাকলেও সন্তানদের তিনি যথাসম্ভব সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। আট ভাইবোনের মধ্যে রিকু চতুর্থ। হেমায়েতপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে এসএসসি পাসের পর সংসারে সচ্ছলতা আনতে শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে শুরু করেন কর্মজীবন। পোশাক কারখানা ও অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন প্রায় তিন বছর। ২০০১ সালে কোরিয়ান ভাষা শিখে পাড়ি জমান দক্ষিণ কোরিয়ায়। সেখানে কাজ পান একটি ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানিতে। কঠোর পরিশ্রম, কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও দেশটির ভাষাজ্ঞানের কারণে মাত্র দুই বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সেকশন ইনচার্জের দায়িত্ব পান। পদোন্নতিতে বাড়ে বেতন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। প্রায় আট বছর প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফেরেন ২০০৯ সালে। বিদেশের উপার্জনকৃত টাকায় শুরু করেন নতুন ব্যবসা। বেছে নেন নির্মাণপণ্য বিক্রির ব্যবসাকে। সিমেন্ট, রড ও নির্মাণসংশ্লিষ্ট অন্যান্য পণ্য বিক্রির লাভে আসতে থাকে কাঙ্খিত সাফল্য।

মেগাসিটি ঢাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে নগর ছাড়িয়ে এর আশপাশে। হেমায়েতপুরের অবস্থান ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় এলাকাটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন এগোচ্ছে দ্রুতগতিতে। নির্মাণপণ্যের চাহিদা যে দিন দিন ক্রমেই বাড়বে তা তিনি বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই আদর্শ ব্যবসা হিসেবে বেছে নেন নির্মাণসামগ্রী বিক্রিকে। সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল না তা কয়েক বছর যেতে না যেতেই বুঝতে পারেন। তখন এলাকায় নির্মাণসামগ্রীর দোকানও তেমন ছিল না। ফলে বিক্রিও হতো বেশ। স্বল্পমূল্যে গুণগত মানের পণ্য বিক্রির কারণে ক্রেতারা পণ্য কিনতে তাঁর প্রতিষ্ঠানকেই বেছে নেন। তা ছাড়া এলাকায় পরিচিতি হওয়ায় আস্থাসহকারেই পণ্য কেনেন সবাই। এভাবে বাড়ে ব্যবসার পরিসর। তাঁর দোকানে খুচরা বিক্রিই বেশি। শুরুতে অন্যান্য সিমেন্ট বিক্রি করলেও ফ্লাই অ্যাশবিহীন আকিজ সিমেন্টের গুণগত মান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কারণে পণ্যটি বিক্রিতে আগ্রহী হন। এখন তাঁর দোকানে ক্রেতা চাহিদার শীর্ষে আকিজ সিমেন্ট। অধিক পণ্য বিক্রির স্বীকৃতিস্বরূপ আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির পক্ষ থেকে ২০১৩ সালে ভ্রমণ করেছেন মালয়েশিয়া। এ ছাড়া কোম্পানির পক্ষ থেকে নেপালে আনন্দভ্রমণের প্রক্রিয়াও প্রায় চূড়ান্ত। অন্যান্য কোম্পানিও তাঁর বিক্রির সাফল্যে সন্তুষ্ট। এরই ধারাবাহিকতায় একটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রস্তাব পেয়েছেন ডিলারশিপের। খুচরা বিক্রিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করায় এমন প্রস্তাব থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। সেরা বিক্রেতার স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সময়ে তিনি পেয়েছেন স্বর্ণালংকার, মাইক্রো ওভেন, মোবাইল ফোনসেট, নগদ টাকাসহ নানা উপহারসামগ্রী ও সম্মাননা। 

সপরিবারে ব্যবসায়ী মো. আবুল বাসার

নিজের পরিশ্রম ও মেধার গুণে আবুল বাসার রিকু এলাকার একজন সফল ব্যবসায়ী। তবে এই সফলতার পেছনে রয়েছে তাঁর মায়ের বিরাট অবদান। বিদেশে যেতে যাবতীয় সহায়তা করেছিলেন মা। সেখানে থেকেই তৈরি করেছেন জীবনে স্বাবলম্বী হওয়ার ভিত। দীর্ঘ প্রবাসজীবনের অর্জিত উপার্জনই আজ তাঁর ব্যবসার মূলধন। এ টাকায় নির্মাণ করেছেন বাড়িও। নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসায় সফলতা পেলে শুরু করেন ল্যান্ড বা ভূমি ব্যবসা। জায়গা-জমি বিক্রির মাধ্যমে আসা আয়টা নেহাত মন্দ নয়। এ ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পর দোকানে আর আগের মতো বসতে পারেন না। তবে ছোট ভাই আল মাসুদ সামলে নেন বড় ভাইয়ের ব্যবসাকে। নিজস্ব কয়েকটি বাড়ি থেকে ভাড়া বাবদ ভালো আয় হয়। ফলে দোকানের আয়কৃত টাকা পুনরায় বিনিয়োগ করতে পারেন ব্যবসার পরিসর বাড়াতে। নিজে একসময় চাকরি করলেও এখন তাঁর প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন বেশ কয়েকজন। 

সফল এ ব্যবসায়ী বিয়ে করেছেন ২০০৯ সালে। স্ত্রী রুনা আক্তার। তাঁদের ঘর আলো করে আছে তিন বছরের কন্যা রওজা আক্তার। ব্যস্ততার অবসরে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়েই কাটে তাঁর বাকিটা সময়। মাঝেমধ্যে ঘুরতে যান বিনোদন পার্কে, শপিংমলে। ফুটবল খেলা ও কাচ্চি বিরিয়ানি তাঁর খুব প্রিয়। ব্যবসায়িক ব্যস্ততা থাকলেও নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন সামাজিক কাজে। সফল হয়ে আজকের এ অবস্থানে আসায় তিনি আল্লাহর প্রতি জানান অসীম কৃতজ্ঞতা। তিনি মনে করেন, তাঁর এ অর্জনে দরিদ্র মানুষের হক রয়েছে। তাই এলাকার গরিবের বিবাহ, চিকিৎসা ও অন্যান্য বিপদ-আপদে সাধ্যমতো সহায়তা করেন। মসজিদ, এতিমখানা ও মাদ্রাসা নির্মাণে দান করেন মুক্তহস্তে। 

জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে আজকের সফল এই ব্যবসায়ীকে। প্রবাসে আয় করেছেন চাহিদার চেয়ে বেশি। সুযোগ ছিল বিদেশে থাকার। নিজের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করার। কিন্তু তিনি প্রবাসী হয়ে প্রবাসে থাকেননি। সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হওয়ার। সে স্বপ্নই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে আজকের এ অবস্থানে। সীমিত পর্যায়ে এখন ব্যবসা করলেও ইচ্ছে আছে বৃহৎ পরিসরে পাইকারি ব্যবসা করার। এ ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী। তাঁর এ প্রত্যয় সফল হোক বন্ধন পরিবারের পক্ষ থেকে রইল শুভকামনা। 

মাহফুজ ফারুক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৫ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top