শৈল্পিক কারুকার্যময় ঢাকাইয়া জামদানির সুখ্যাতি দুনিয়াজোড়া। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী তাঁতে তৈরি এ শাড়ির বুননধারা বংশপরম্পরায় এখনো বহমান। সূচিশিল্পের এ কারিগরদের বড় একটি অংশের বাস ঢাকার ডেমরায়। নানামুখী শিল্পে সমৃদ্ধ এলাকাটি। ঢাকার অদূরে অবস্থানের কারণেই এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে। ঘটছে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। নির্মাণপণ্যের ব্যবসা এখানে সুদৃঢ়। ডেমরার ডগাইর বাজারের মেসার্স ঝুমু ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী হাজি মো. সালাউদ্দিন (সেন্টু) এলাকার একজন সফল নির্মাণপণ্য ব্যবসায়ী। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের আঞ্চলিক বিপণন কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমানের সহায়তায় সফল এ ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপচারিতার পর ‘সফল যাঁরা কেমন তাঁরা’ পর্বে এবার রয়েছে তাঁরই সাফল্যকাহিনি।
ব্যবসায়ী সেন্টুর জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৫ জুন, ডগাইর, ডেমরায়। তাঁর বাবা মরহুম আলহাজ মো. মমতাজ উদ্দিন মাস্টার আর মা মৃত হাজি রহিমা খাতুন। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, পাশাপাশি করতেন শিক্ষকতাও। ডগাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে ব্যবসায়ী সেন্টু ষষ্ঠ। ডেমরা বাওয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে এসএসসি ও হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ থেকে ১৯৮২ সালে এইচএসসি পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষে ব্যবস্থাপক পদে যোগ দেন কন্টেইনার উৎপাদনকারী কারখানায়। তিন বছর চাকরির পর ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে দেখভাল করেন মামার শাড়ির দোকানের ব্যবসা। এভাবে কাটে আরও দুই বছর। এরপর নিজেই জড়ান ব্যবসায়। ডেমরার কারিগরদের কাছ থেকে ঢাকাই জামদানি সংগ্রহ করে তা সরবরাহ করতেন সারা দেশে। প্রায় ১০ বছর এ ব্যবসায় যুক্ত থাকায় বুঝে যান ব্যবসাটির আদ্যোপান্ত। তাই একসময় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এ ব্যবসা বিস্তৃত হয় কলকাতার বাজারে। এখান থেকে ওখানে তিনি জামদানি শাড়ি রপ্তানি করতেন। পাশাপাশি ডগাইর বাজারে একটি দোকান নিয়ে শুরু করেন নির্মাণপণ্যের ব্যবসা। ব্যবসার প্রথম নির্মাণপণ্য ঢেউটিন। এরপর শাড়ি রপ্তানিতে জটিলতায় পড়ায় ছেড়ে দেন ব্যবসাটি। এলাকায় খুব দ্রুত নির্মাণকাজ চলায় স্বভাবতই চাহিদা বাড়বে নির্মাণপণ্যের, এ রকম দূরদৃষ্টি থেকেই এ ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন পুরোপুরি। ক্রেতা চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নির্মাণপণ্যের ব্যবসায় একে একে যোগ করেন সিমেন্ট, রড, ইট, বালু, স্যানিটারির মতো সামগ্রী।

একজন বিচক্ষণ ব্যবসায়ী হিসেবে নির্মাণপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার কারণ ব্যবসাটির স্থায়ী ভবিষ্যৎ। আগের ধারাবাহিকতায় দ্রুততার সঙ্গে এ ব্যবসায়ও পান সাফল্যের সন্ধান। তবে এ ব্যবসায় খুব বেশি মূলধন বিনিয়োগ করতে হয়নি তাঁকে। জমানো কিছু টাকার সঙ্গে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন মাত্র পাঁচ লাখ টাকা। শুরুর দিকে তুলনামূলক কম পণ্য বিক্রি হলেও এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে পণ্যের চাহিদা। বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য বিক্রির মাধ্যমে বাড়ান ব্যবসার পরিসর। এরই ধারাবাহিকতায় বিক্রয় তালিকায় যুক্ত হয় দেশের একমাত্র ফ্লাই অ্যাশবিহীন সিমেন্ট, আকিজ সিমেন্ট। এভাবে এলাকায় সব ধরনের নির্মাণপণ্য বিক্রির নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় ঝুমু ট্রেডার্স। পায় ব্যাপক পরিচিত। সফল ও স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ী হিসেবে এলাকায় আত্মপ্রকাশ করেন হাজি মো. সালাউদ্দিন ওরফে সেন্টু। অধিক পণ্য বিক্রির সুবাদে লাভ করেন আকিজ সিমেন্টের ডিলারশিপ। আরও কিছু সিমেন্ট ও রড কোম্পানির ডিলার হন তিনি। এ ছাড়া সেরা বিক্রেতা হিসেবে আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির পক্ষ থেকে নেপালে গিয়েছেন দুইবার। বেশি পণ্য বিক্রির স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন কোম্পানির তরফ থেকে পেয়েছেন টিভি, মোবাইল, ডিজিটাল ক্যামেরা, মাইক্রোওভেন, ডিনারসেট, নগদ টাকাসহ নানা উপহার। এলাকার স্থানীয় বাজারে রয়েছে তাঁর দুইটি শোরুম আর চারটি গোডাউন। দোকানে কাজ করছে আটজন কর্মচারী ও ১০-১২ জন শ্রমিক।
সফল এ ব্যবসায়ী বিয়ে করেন ১৯৯৫ সালে। স্ত্রী শাহিন সুলতানা। সংসারে তাঁদের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে সাদিয়া সালেহ ঝুমু উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে, মেজো মেয়ে সানজিদা সানু পঞ্চম শ্রেণীতে আর ছোট মেয়ে সাদিকা সুলতানা এ বছরই ভর্তি হয়েছে স্কুলে। ব্যবসায়িক ব্যস্ততার পর স্ত্রী, সন্তান, পরিবারকে নিয়েই কাটে তাঁর বাকি সময়। এ ছাড়া এলাকার সম্মানিত একজন ব্যক্তি হিসেবে সামাজিক ও ধর্মীয় কাজেও সদা তৎপর। মসজিদুল-ই-আয়েশার সভাপতি তিনি। অন্যান্য মসজিদ কমিটিতেও রয়েছে সদস্য পদ। খেলাধুলা, ওয়াজ-মাহফিলসহ স্থানীয় ধর্মীয় কাজে তিনি সাধ্যমতো সহায়তা করেন। অত্র অঞ্চলের প্রায় সব মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে নির্মাণপণ্য সরবরাহকারী তিনি।

ব্যবসায়ী সেন্টু একজন স্বাধীনচেতা মানুষ, তাই চাকরি না করে করছেন ব্যবসা। সময়ের পরিক্রমায় নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আজ তিনি সফল এক ব্যবসায়ী। এ সফলতা এক দিনে অসেনি। বছরের পর বছর নানা কৌশল, পরিশ্রম ও ক্রেতাদের মন জয় করেই পেয়েছেন সাফল্য। সব সময়ই ব্যবসাকে তিনি সম্মান করেছেন পবিত্র পেশা হিসেবে। সততার সঙ্গে ব্যবসা করলে দুনিয়ায় যেমন সম্মান পাওয়া যায়, তেমনি আখিরাতেও মেলে শান্তি। তাই গুণগতমানসম্মত পণ্য বিক্রির ব্যাপারে বরাবরই থেকেছেন অটল। লাভও করেছেন সীমিত। মানসম্মত পণ্য বিক্রি করাতেই তাঁর গৌরব আর পছন্দ সৎ জীবনযাপনে।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৮ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৪