আধুনিক বিশ্বে স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণে অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলেছে স্টিল। আর এই স্টিল উৎপাদনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ফেরো অ্যালয়। বাংলাদেশে এই পণ্যটির প্রথম এবং একমাত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফেরো অ্যালয় কোম্পানি প্রাইভেট লি.। প্রতিষ্ঠানটি দেশের চাহিদা পূরণে রাখছে অনন্য ভূমিকা। গুণগত মানের এ পণ্যটি রপ্তানিও করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফেরো অ্যালয় খাতের সম্ভাবনা, প্রতিবন্ধকতা, সমাধানের উপায়সহ নানা বিষয়ে বন্ধন-এর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন ফেরো অ্যালয় কোম্পানি প্রাইভেট লি. ও রহিম স্টিল- এর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মোহসিন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহফুজ ফারুক
স্টিল উৎপাদনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ফেরো অ্যালয়, বাংলাদেশে যার প্রথম এবং একমাত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফেরো অ্যালয় কোম্পানি প্রাইভেট লি. দেশের চাহিদা পূরণে কতটা ভূমিকা রাখছে?
বর্তমানে দেশে আমরাই একমাত্র ফেরো অ্যালয় উৎপাদন করছি। তবে আরও একটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছিল কিন্তু এখন তা বন্ধ রয়েছে। স্টিল উৎপাদনে প্রয়োজন হয় তিনটি কেমিক্যাল। ফেরো ম্যাঙ্গানিজ, সিলিকন ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো সিলিকন। আমরা দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ পূরণে সক্ষম। তবে চাহিদার শতভাগ পূরণ করার সক্ষমতাও আমাদের রয়েছে। কিন্তু তা করতে ধাপে ধাপে কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়; প্রয়োজন পলিসি নির্ধারণেরও। যেমন, এটি আমদানি করলে খরচ কম পড়ে। এতে স্বভাবতই দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পড়বে হুমকির মুখে। সরকার যদি আমদানি নিরুৎসাহে উদ্যোগী না হয় এবং দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত না করে, তবে দেশীয় শিল্প টিকবে না। ইতিমধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা যদি উৎপাদন শুরু না করতাম, তাহলে পণ্যটি আমদানি করতে এত দিন প্রচুর অর্থ ব্যয় করে হতো। বিগত ১০ বছরে দেশের স্টিল সেক্টরে প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে। আশার কথা হচ্ছে, সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করেছে বিধায় আমাদের কথা শুনছে, এরই মধ্যে কিছু কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে ক্রমবর্ধমান এ খাতের উন্নয়নে।

২০০৩ সাল থেকে এ দেশে ফেরো অ্যালয় উৎপাদনে আপনার প্রতিষ্ঠান পাইনিয়ার বা অগ্রদূত, এ ধরনের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ কেন নিলেন?
আমরা শুধু ফেরো অ্যালয় নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশীয় শিল্পে অগ্রদূত! যেমন, অক্সিজেন। ব্রিটিশ অক্সিজেনের মনোপলি ছিল ৯৯ বছর। আমরাই এ মনোপলি ভেঙে ১৯৮৫ সালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করি। এ কাজে ব্রিটিশরা অনেক বাধা দিয়েছিল কিন্তু আমাদের বিরত রাখতে পারেনি। আমাদের পথ অনুসরণ করে দেশে এখন প্রায় ২০টি প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়েছে। ফলে এখন মানুষ অনেক কম মূল্যে সেবাটি পাচ্ছে। স্টিলের ক্ষেত্রেও একটি মিনি স্টিল প্ল্যান্টের মাধ্যমে আমরাই দেশে প্রথম এর উৎপাদন শুরু করি। এখন দেখেন দেশে কতগুলো স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। আমরা সব সময়ই চেষ্টা করি নতুন কিছু করতে। আমেরিকা থেকে স্টিলের ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছি নতুন কিছু করার প্রয়াসেই। আসলে ব্যবসায় মুনাফা অর্জনই বড় কথা নয়, প্যাশন থাকতে হয়; থাকতে হয় দেশকে গড়ে তোলার মনোভাবও। দেখেন, ভারত একসময় অনেক কিছুই আমদানি করত। এখন অধিকাংশ জিনিস তারা নিজেরাই উৎপাদন করে। বেসিক কিংবা হেভি ইন্ডাস্ট্রি যদি গড়ে না ওঠে, তাহলে দেশের উন্নয়নটা হবে কীভাবে!
ফেরো অ্যালয় উৎপাদনে আপনারা কোন পদ্ধতি অবলম্বন করছেন?
বিশ্বের উন্নত দেশের মতো ইলেকট্রিক আর্থ ফার্নেস পদ্ধতিতেই ফেরো অ্যালয় উৎপাদন করছি আমরা।
ফোরো অ্যালয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় কীভাবে এবং এটি কতটাই-বা গুরুত্ব পায়?
মান নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটা শুরু করি কাঁচামাল নির্বাচনের ক্ষেত্রে। আগে কিছু কিছু কাঁচামাল আমরা ভারত থেকে আনতাম। কিন্তু বাংলাদেশে ফেরো অ্যালয় উৎপাদন শুরু হলে ওরা আমাদের কাঁচামাল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ফলে আমরা এখন দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিল থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করছি। এরপর এই কাঁচামাল সঠিক অনুপাতে মিক্সিং করাও গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য মানসম্পন্ন ল্যাব থাকতে হবে। কারণ, সঠিক মিশ্রণের ওপরই নির্ভর করে স্টিলের স্ট্রেন্থ। আমরা এটা নিশ্চিত করি নিজস্ব সুসজ্জিত আধুনিক ল্যাবের মাধ্যমে।

পণ্যটি উৎপাদনে কাঁচামাল সংগ্রহের উৎস সম্পর্কে বলুন?
গুণগত মানের কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রথমত আমরা প্রাধান্য দিই ম্যাঙ্গানিজ কনটেন্ট সঠিক অনুপাতে আছে কি না। দ্বিতীয়ত, দেখি আয়রন আর তৃতীয়ত বোরনের মাত্রা। জাপানে বোরনকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কারণ, বোরন বেশি থাকলে স্টিলে ফ্যাটিগ বেশি হয়। এ জন্য আমরা লো বোরনের কাঁচামাল সংগ্রহের চেষ্টা করি।
ফোরো অ্যালয় কি শুধু স্টিল উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে না কি না অন্য ক্ষেত্রেও রয়েছে এর ব্যবহার?
ফোরো অ্যালয় প্রধানত স্টিল উৎপাদনেই ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ব্যবহৃত হয় কাস্ট আয়রনে (ফাউন্ড্রি) এবং সোলার প্যানেল তৈরী কারখানায়।
আগে ফোরো অ্যালয় কোন কোন দেশ থেকে আমদানি করা হতো, সে ক্ষেত্রে স্টিল উৎপাদন খরচে এর প্রভাব পড়ত কেমন?
দেশে উৎপাদন শুরুর আগে ফোরো অ্যালয় আমদানি করা হতো নরওয়ে, ভারত ও চীন থেকে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যয় বেশি হতো। আমরা যখন উৎপাদন শুরু করি তখন ভারত ও চীন দাম কমানো শুরু করে। ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম সবচেয়ে কম, বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গেই যার সামঞ্জস্য নেই। যারা ভারত থেকে আমদানি করছে, তারা কম দামে আনতে পারছে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আমাদেরও দাম কমাতে হচ্ছে। দাম কমাতে কমাতে আমরা প্রায় লসের পর্যায়ে চলে এসেছি। আমরা একমাত্র প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সমস্যাটি সমাধানে সরকারও প্রথম দিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। সরকারকে আমরা নানাভাবে বুঝিয়েছি। ফলে এখন সরকার উপলব্ধি করতে পেরেছে। সরকার প্রণোদনা দিলে দেশে আরও অনেক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠত। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক্সপোর্ট তথা রপ্তানি করতে পারতাম। আগের দিনের মতো রপ্তানির সুদিন ফেরানো সম্ভব হতো।
বর্তমানে দেশের প্রথম সারির কিছু স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আপনাদের উৎপাদিত অ্যালয় ব্যবহার করছে, যা রপ্তানি হচ্ছে কয়টি বা কোন কোন দেশে? ভবিষ্যতে রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কী?
আমরা পণ্য রপ্তানি করছি অনেক দেশেই। বিশেষ করে ইউরোপে। বিগত দুই বছর যাবৎ রপ্তানি হচ্ছে না। ইউরোপের বাজারে মন্দাভাব বিরাজ করায় এখন চাহিদা কিছুটা কম। আমাদের এবারের রপ্তানি লক্ষ্য আমেরিকায়। কারণ, দেশটিতে ভারত থেকে পণ্য রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভালো সুযোগ রয়েছে; বাজার দখলে নেওয়ার। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নত হলে ইউরোপের বাজারও হয়তো দ্রুত খুলবে। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারও অনেক ভালো। সেখানেও আলাপ-আলোচনা চলছে। পাকিস্তানের মার্কেটও বেশ ভালো। আসলে সারা বিশ্বেই স্টিল ইন্ডাস্ট্রি কিছুটা ডাউন টার্ন ফেজে যাচ্ছে। ফলে সবাই স্টিল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করতে পারব। এখন সরকার যদি আমাদের উৎসাহ দেয়, সহযোগিতা করে তাহলে আমরা অনেক ভালো করতে পারব। আরও অনেকেই এগিয়ে আসবে এই সেক্টরে।

নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় আপনারা পণ্য উৎপাদন করছেন এমনকি উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ন্যাশনাল গ্রিডে দিয়ে দেশসেবায় ভূমিকা রাখছেন, বিষয়টি সম্পর্কে কিছু বলবেন?
খুব ভালো প্রশ্ন। নিজস্ব বিদ্যুতে আমাদের ফ্যাক্টরি চলছে, একই সঙ্গে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ আমরা ন্যাশনাল গ্রিডেও দিচ্ছি। বিদ্যুৎ আমাদের ব্যবসা ছিল না। ২০১১ সালে যখন সরকার প্রাইভেট সেক্টরকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহিত করে বিদ্যুৎ কিনতে চায়। তখন আমরাই প্রথম একটি স্মল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করি। পরে এর ক্ষমতা আরও বাড়িয়েছি। কিন্তু বিদ্যুৎ তৈরির প্রধান উপাদান গ্যাস সরকারি প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে প্রতি ঘনমিটার ৩.৮০ পয়সা, আগে আমরা পেতাম ৫ টাকায় আর এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ টাকায়! একই বিদ্যুৎ তৈরিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এক নিয়ম আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আরেক। এটা খুবই সামঞ্জস্যহীন। এটা সরকারের সমালোচনা নয়, সরকার উৎসাহ দিয়েছিল বলেই আমরা করেছিলাম। আমরা সমস্ত ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট এখন ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। যদি এই উৎপাদন না হতো তাহলে সরকারের কত অর্থ ব্যয় হতো? আবার বাইরে থেকে আমদানি করাটাও সহজ নয়।
প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফোরো অ্যালয়ের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি?
অবশ্যই আছে। স্টিলে এখন ৫০০ গ্রেড চলছে। আমরা ৬০০ গ্রেডের স্টিল উৎপাদনে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। খুব শিগগিরই আমরা বাজারে আনব। এতে স্টিলের স্টেন্থ বাড়বে অথচ ওজন কমবে। স্টিল অনেক বেশি লোড বিয়ার করতে পারবে।

আপনাদের নিজস্ব ফ্যাক্টরি কতটা পরিবেশবান্ধব?
পরিবেশরক্ষায় প্রথম থেকেই আমরা সোচ্চার। আমাদের ফ্যাক্টরির প্রতিটি ইউনিটে বায়ু পরিশোধন করার যন্ত্র রয়েছে। ফলে ফেরো অ্যালয় উৎপাদন করতে গিয়ে যে ফিউল নির্গত হয় তা ফিল্টার করেই বাতাসে ছাড়া হয়। এ ছাড়া উচ্ছিষ্ট বর্জ্য নিচে পড়ে যায়। এই বর্জ্যরে ভ্যালু কম নয়! এতে ম্যাঙ্গানিজ থাকে। এটাও রপ্তানি হচ্ছে। এই বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার করা যায়। আমরা ইট তৈরিতে এই উপাদান ব্যবহার করছি। এই ইট খুব ভারী এবং শক্ত। যদিও এই ইট নিজেদের কাজেই ব্যবহার করছি।
আপনাকে ধন্যবাদ, স্যার।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রকাশকাল: বন্ধন ১১৫ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৯