সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

‘পরিবেশ আইন মেনে ভবন নির্মাণের প্রবণতা আমাদের এখানে এখনো চালু হয়নি’

পরিবেশ আইনবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের জন্ম ১৯৬৮ সালের ১৫ জানুয়ারি, ঢাকার ধানমণ্ডিতে। বাবা সৈয়দ মহিবুল হাসান, মা সুরাইয়া হাসান। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। সেখান থেকেই সম্পন্ন করেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের আইজেনহাওয়ার ফেলোশিপসহ দেশের বাইরে বেশ কয়েকটি কোর্সে অংশ নেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিতে (বেলা) যোগ দেন। বেলায় থেকে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি বাংলাদেশে পরিবেশ-সুশাসন নিশ্চিত করতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এ জন্য তাঁকে ২০০৭ সালে পরিবেশ পদকে ভূষিত করে। ২০০৯ সালে তিনি পরিবেশের নোবেলখ্যাত সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ’ পান। এ ছাড়া একই বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘টাইম’ তাঁকে বিশ্বের অন্যতম ‘হিরোজ অব এনভায়রনমেন্ট’ (Heroes of the Environment) অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করে, বাংলাদেশি হিসেবে যা কারও জন্য এ ধরনের প্রথম সম্মাননাপ্রাপ্তি। তিনি ফ্রেন্ডস অব আর্থ ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী সদস্য; এ ছাড়া এনভায়রনমেন্টাল ল অ্যালায়েন্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং এনভায়রনমেন্টাল ল কমিশন অব দ্য আইইউসিএনের সদস্য। এ ছাড়া কাজ করছেন সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব এনভায়রনমেন্টাল অ্যাক্টিভিস্টের (SAANS) দিকনির্দেশক হিসেবে। তবে জাহাজভাঙাশিল্পের পরিবেশদূষণ ও শ্রমিকদের মৃত্যুঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে তাঁর আইনি লড়াই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালে পেয়েছেন এশিয়ার নোবেলখ্যাত ‘র‌্যামন ম্যাগসাইসাই’ অ্যাওয়ার্ড। বর্তমানে তিনি বেলার প্রধান নির্বাহী। প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় বন্ধনকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারটি পুনর্মুদ্রিত হলো।

জাহাজভাঙ্গাশিল্পে যুক্ত শ্রমিকেরা

ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশ আইন মানা হচ্ছে কতটুকু?

ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশ আইন মানা হচ্ছে না এটা ঠিক। আমাদের রাজউকের কাছ থেকে কোনো পরিকল্পনা পাস করাতে হলে এমন কিছু নীতিমালা রয়েছে, যেগুলো আপনাকে অনুসরণ করতে হবে। তা না হলে আপনি ভবন নির্মাণ করতে পারবেন না। আর করলেও সেটা রাজউক বা পরিবেশের জন্য হুমকি মনে হলে পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলে ভেঙে দিতে পারে। আমাদের ভবন নির্মাণে যে বিধিমালা রয়েছে সেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে একটি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা থাকতে হবে। বাসার ছাদে সোলার প্যানেল বসাতে হবে। পানির লাইন আর গ্যাসের ব্যবস্থা নিয়েও রয়েছে সুস্পষ্ট আইন। প্রতিবেশীর সমস্যা না হয় এমন অনেক বিষয়ক সচেতনতা রয়েছে আইনে। ভবন নির্মাণের সময় যে দুর্ঘটনা ঘটে, সেটা রোধে আইন করা হয়েছে। অনেকে আবার এসব আইন মানছেন না। যাঁরা মানছেন না রাজউকের পক্ষ থেকে তাঁদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এগুলো ভাঙা বা জরিমানা করার বিধান আছে। মানার বিষয়ও এটি। আর শুধু আইন করলে হবে না, জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে আইন মানতে।

বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল থাকা বাধ্যতামূলক কিন্তু কজন এটা করছেন! খোলা স্থান রাখার কথা আছে, অনেকে রাখছেন না। বর্তমানে নতুন যাঁরা বাড়ি করছেন, অনেকের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা আশার দিক। অনেকে বাড়িতে খোলা স্থান রাখছেন, কিন্তু সেখানে বাচ্চাদের খেলতে দেওয়া হচ্ছে না। সুন্দর সুন্দর ঘাস লাগানো হচ্ছে ওখানে। স্থানটি ব্যবহার করা হচ্ছে সৌন্দর্যের প্রয়োজনে, অন্য কোনো কাজে আসছে না।

যাঁরা আইন মানছেন না তাঁদের কী করা যেতে পারে?

অনেকে আইন মানছেন না। রাজউক চাইলেও অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ বিজিএমইএ ভবন। আর ঢাকার বাইরে ভবন নির্মাণের কথা বলতে গেলে বাধ্যবাধকতা আসেনি এখনো। আসলে এমন অবস্থা আমাদের দেশের যে অনিয়মকে নিয়ম করে ফেলার প্রবণতা বাড়ছে। পরিবেশ আইন মেনে ভবন নির্মাণের প্রবণতা আমাদের এখানে এখনো চালু হয়নি। তবে যে আইন আছে তা মেনে চললে অনেক ভালো হয়।

জলাশয় ভরাট করে গড়ে ওঠা বিজিএমইএ ভবন

প্রতিবছরই চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে। এটি কেন হচ্ছে? এ বিপর্যয় থেকে রক্ষার উপায় কী?

চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনা একটা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ঘটনা মাত্র। পাহাড় প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশীয় আইনে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ। ১৯৯৭ সালের আইনে বলা আছে, পাহাড় বা টিলা কাটতে হলে যেসব জেলায় পাহাড় ও টিলা রয়েছে, সেখানকার জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে একটি দল থাকবে। এই দলের সহায়তা নিয়ে পাহাড় কাটতে হবে। পাহাড় কাটতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি লাগবে। আমার জানামতে, পাহাড় কাটার যে নীতিমালা রয়েছে তা মেনে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো পাহাড় কাটা হয়নি। অথচ নির্বিচারে চলছে পাহাড় কাটা। পরিবেশরক্ষায় আমাদের দেশে যে আইন আছে, সরকার তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ। এ ব্যর্থতার জন্য আমরা সাধারণ মানুুষ নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি প্রতিদিন। কিছু মানুষ সবকিছু গ্রাস করতে চায়। তাদের ব্যক্তিস্বার্থের জন্য পরিবেশের অনেক বড় বিপর্যয় তারা করছে। এসব লোকের নদীর মধ্যে হোটেল দরকার, সাগরপারে পর্যটনকেন্দ্র তৈরির জন্য বড় বড় মোটেল নির্মাণ করা দরকার। পারলে এরা পাহাড়টারও দখল নিতে চায়। এ ধরনের অনেক বড় বড় অনিয়ম আমাদের এখানে হচ্ছে। শুরু হয়েছে সবকিছু দখলের মহোৎসব। 

ব্যক্তিমালিকানাধীন যেসব পাহাড় বা টিলা রয়েছে, সেগুলো থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে বা পাহাড় কেটে সমতল করে কৃষিজমি তৈরি করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে আবাসন প্রকল্প। পাহাড় ব্যক্তিমালিকানাধীন হোক আর সরকারি হোক, কাটতে হলে জেলা প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন। তা না হলে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত।

আমাদের দেশের পাহাড়গুলোকে দখলে নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক মদদপুষ্ট স্বার্থান্বেষী মহল সব সময় তৈরি, যারা পাহাড় দখল করছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এটা হওয়ায় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে। চট্টগ্রাম এলাকায় পাহাড় দখলে নিয়ে, এর একদম নিচে ঘুপচিঘর করে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নদীভাঙনের শিকার হয়ে বা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের শিকার হয়ে শহরে এসেছে অসহায় এ মানুষগুলো। এখানে আশ্রয় নিচ্ছে। আর এ সুযোগে তাদের দুই দিক থেকে লাভ হচ্ছে, ভাড়া পাচ্ছে আর দখলে থাকছে পাহাড়। ভাড়া পাচ্ছে মাসে মাসে। যারা এখানে থাকে, তাদের অসচেতনতা বা অসহায়ত্ব এর জন্য দায়ী। এই লোকদের আবাসনের নিশ্চয়তা দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু সরকারের। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প রয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করছে সেখানে। আর সামান্য এক হাজার ৬০০ পরিবারের বাসস্থানের জায়গা করতে পারছে না। সরকার চাইলেই পারে। সরকার পারে না এ কথা বলাটা যৌক্তিক নয়। এটাকে আমি বলব একধরনের উদাসীনতা। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে সরকার দারুণ উদাসীন। যার ফল প্রতিবছর পেতে হচ্ছে এখানে বসবাসরত মানুষের। সরকার তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে যতই সরে যেতে বলুক না কেন, তারা সেখান থেকে সরবে না। তারা সরে কোথায় যাবে? তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। মোটামুটি চারটি কারণে এ সমস্যা হচ্ছে বলে আমি মনে করছি। এক. আইন প্রয়োগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতা। দুই. সর্বহারা জনগণকে পুনর্বাসন করতে সরকারের ব্যর্থতা। তিন. রাজনৈতিক মদদপুষ্ট লোকের দখলকে প্রশাসনের দেখেও না দেখার ভান করা এবং চার. সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়া। 

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে জাহাজভাঙ্গাশিল্পের শ্রমিকেরা

সাধারণ মানুষ কীভাবে পরিবেশ বিপর্যয়কারী বা অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে?

পরিবেশ-সুশাসন নিশ্চিত করতে আইনি লড়াই অনিবার্য। তবে পরিবেশ-দুর্বৃত্তরা অনেক শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার সুযোগ কম। তাই কমিউনিটিকে নিজের অধিকারের ব্যাপারে মোবিলাইজ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, অধিকার চর্চার ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিতে হবে। ফুলবাড়ী, রূপগঞ্জ এবং আড়িয়াল বিলে যেভাবে প্রতিরোধ করা গেছে, সেভাবে এদের প্রতিরোধ করতে হবে। সাধারণ মানুষ কিন্তু পরিবেশ আদালতে যায় না। কারণ, পরিবেশ-অন্যায়কারীরা খুবই শক্তিশালী। আর উচ্চতর আদালত থেকে আমরা পরিবেশ-অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলার রায়ে জিতে এসেছি, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।

ঢাকার খেলার মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে, আইনি জটিলতা নিয়ে এ বিষয়ে কিছু বলবেন?

এ ব্যাপারে আমরা সত্যিই হতাশ। মাঠ দখল ঠেকাতে দীর্ঘদিন থেকে নানা সংগঠনকে অনুরোধ করে আসছি। আদালত ঢাকা শহরের ১০টি খেলার মাঠ, ৬১টি পার্ক ও উদ্যানকে রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। এসব স্থাপনা যারা দখল করেছে, তাদের উচ্ছেদ করে বা কোনো স্থাপনা থাকলে তা ভেঙে মাঠ বা পার্ক উদ্ধারের নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু তা অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি। উল্টো খেলার মাঠে তৈরি হয়েছে গ্যারেজ। তৈরি করা হয়েছে দোকান। আমাদের পক্ষ থেকে আরও একটি দাবি ছিল, এসব মাঠকে দেখভাল করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে কমিটি গঠন। আমরা বলেছি, সিটি করপোরেশনের আওতায় এটি রাখা যাবে না। তারা এটি মানেনি। সিটি করপোরেশন আদালতের রায়ও মানেনি। সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে আমরা আদালত অবমাননার মামলা করেছি। মাঠগুলো উদ্ধারের জন্য আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। অব্যাহত রেখেছি আমাদের সব ধরনের কার্যক্রম।

দেশীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না? এ ব্যাপারে সরকারের কোনো দুর্বলতা রয়েছে কি?

এগুলো রক্ষা করা আমাদের জন্য খুবই দরকার। ইতিহাস ও ঐতিহ্য মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সরকার এগুলো রক্ষায় এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা করেনি। সরকার তার কাজকে বাস্তবায়নের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে। এটিকে একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে নিয়ে কাজ শুরু করলে সংস্কার করা সম্ভব। আমরা জানি না কত বছরের পুরোনো ভবন হলে বা কী কী নির্মাণশৈলী থাকলে তাকে ঐতিহ্যবাহী হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে। এ ধরনের সুনির্দিষ্ট নিয়ম বা আইন না থাকায় এটি নির্ধারণে কষ্ট হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় নষ্ট হচ্ছে এসব স্থাপনা। এটিকে রক্ষার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদের। 

ঢাকার অদূরে স্যাটেলাইট সিটির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?

স্যাটেলাইট সিটি সম্পর্কে আমাদের ধারণা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। আমরা জানি না এটি কাদের জন্য, কোথায় নির্মিত হচ্ছে। কাদের জায়গায় এগুলো করা হবে। আর এগুলো কারা কিনবে তাও জানি না। তবে একটি কথা বলি, আপনি কখনো ঢাকা শহরে কোনো উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তকে দেখেছেন যে রাস্তায় ঘুমায়। হয় তার প্লট বা ফ্ল্যাট আছে অথবা সে ভাড়াবাড়িতে থাকে। তাহলে এই ফসলি জমি নষ্ট করে কেন এত প্লট বা ফ্ল্যাট নির্মাণ। একটি কথা বলি, ঢাকা থেকে লোক কমাতে হবে। শহরের বাইরে নিতে হবে শিল্পকারখানা। সবচেয়ে বড় কথা, গোটা দেশই এমন কিছু গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি। এখন ঢাকা শহরে আবাসনের নামে কী হচ্ছে? জলাশয় ভরাট করেও আবাসন হচ্ছে। এখানে যেসব ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে তার বেনিফিশিয়ারি কারা? বেসরকারি বড়জোর তিন-চারটি আবাসন কোম্পানি। মূলত উচ্চবিত্ত, বড়জোর উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য এসব ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। আমি তো ঢাকা শহরে এমন কোনো উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তের কথা শুনিনি, যাঁর কোনো ফ্ল্যাট নেই বলে তিনি রাস্তায় থাকছেন। বরং দরিদ্ররা পথে পথে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা ঢাকায় থাকতে না পারলে পরিবার-পরিজনকে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের জন্য নেই কোনো আবাসন ব্যবস্থা। তার মানে, এখানে সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। আমাদের দেশের এই দ্বৈত নীতি পরিহার করতে হবে। আমাদের দেশের সরকারের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় দেশে, আবাসন, ট্যানারি আর জাহাজভাঙাশিল্প ছাড়া আর কোনো শিল্প নেই। সরকার কেন এদের পক্ষে এত কথা বলে, কার স্বার্থে বলে কিছুই আমরা বুঝি না।

অবাধে চলছে পাহাড় কাটা

বন রক্ষায় বন আইন হয়েছে। এ সম্পর্কে কি কিছু বলবেন?

বন রক্ষায় আমরা সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা রেখেছি। প্রথমত, সব প্রাকৃতিক বনের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, বনের যে অংশ দখল হয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনা এবং বননির্ভর জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে বন থেকে সামাজিক বনায়ন উঠিয়ে দিয়ে বনগ্রাম তৈরি করা। যেখানে লাগানো হবে ওই বনের প্রাকৃতিক গাছগুলোকে। আবার আমরা যদি গাছপালা না লাগিয়ে বনকে নিরাপত্তা দিই, কোনো ধরনের অসুবিধা না করি, বন এমনিতেই ফিরে আসবে। আমরা যদি বনকে বনের মতো থাকতে দিই, সেটা হবে মঙ্গলজনক।

পরিবেশের ওপর ইটভাটার প্রভাব নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বাড়ছে ইটভাটার সংখ্যা। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

আমাদের এখানে অনেক কিছু করার আছে। নদীর পাশে ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এক ফসলি জমি বলুন আর দুই ফসলি জমি বলুন, কোনো আবাদি জমিতে ইটের ভাটা স্থাপন করা যাবে না। প্রয়োজনে আমরা ইট আমদানি করব, তবুও ইটভাটার সংখ্যা বাড়ানো ঠিক হবে না। কারণ, ইটভাটার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় জমি ও পরিবেশ। আর ইট আমদানি করে যে বাড়তি খরচ হবে তা আবার কৃষি থেকে উঠে আসবে।

দেশীয় পরিবেশ আইনের ভালো-মন্দ ও সম্ভাবনা নিয়ে যদি কিছু বলেন?

আমাদের দেশের পরিবেশ আইনের সবচেয়ে ভালো দিক সাংবিধানিকভাবে পরিবেশরক্ষায় গুরুত্ব প্রদান। আমাদের পরিবেশ আইনের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে পরিবেশ বিষয়ে। এ আইনটি আমাদের জন্য পর্যাপ্ত বলা যায়। পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে অনেক কিছু বলা আছে এখানে। আজকের প্রজন্ম এটি নিয়ে অনেক সচেতন। দুর্বল দিক হচ্ছে, যে আইন রয়েছে তার বাস্তবায়ন না হওয়া। আর এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তাদের মধ্যে এই আইন বাস্তবায়নের জন্য কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। এখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সদিচ্ছার অভাবের কারণে এটি বাস্তবায়নে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মাত্র ৮৭টি ট্যানারির মালিকের স্বার্থের জন্য জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে বুড়িগঙ্গাকে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা পালন করছে না। আমাদের বন বা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের ১৬টি ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। বন ব্যবস্থাপনায় বনবাসীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নদী ব্যবস্থাপনার কথা বললেও সরকার ছাড় দিচ্ছে নদী ব্যবস্থাপনার দিকেও।

এখন ঢাকা শহরকে বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিততম মেগাসিটি বলা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ আমাদের ভ্রান্ত উন্নয়ন কৌশল। আমরা উন্নয়নের জন্য যে মডেল বেছে নিয়েছি, তা টেকসই নয়। টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে এমন একটি মডেল, যাতে বর্তমান প্রজন্মের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও উপকৃত করা যায়। আমাদের বেছে নেওয়া মডেলটির ফলে খেলার মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে। পার্ক চলে গেছে। আমাদের রাস্তাঘাটে জ্যাম বেড়েছে ভয়ানকভাবে। বায়ুদূষণ মাত্রা ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। শব্দদূষণ হচ্ছে ব্যাপক মাত্রায়। অর্থাৎ আমাদের মডেলটি উন্নয়নের গতিকে আরও শ্লথ করে দিয়েছে। কৈশোরে আমরা বনানী থেকে মগবাজারের স্কুলে যেতাম ১০ মিনিটে। এখন হরতালের দিন ছাড়া অন্য কোনো সময় এত দ্রুত বনানী থেকে মগবাজারে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আসলে এই মডেলটা যে কাজ করেনি, সেটাই এর প্রমাণ।

পরিবেশ অন্দোলনের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায়?

তরুণ প্রজন্মকে এ কাজে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে আমি একমত। তাদের দিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব। সঠিক গাইড লাইন দিয়ে তাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গেলে সবকিছু সহজ হয়ে যাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা এদের মাঝে বোঝানোর প্রয়োজন রয়েছে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষার বিষয়ে। যদি আমরা এই বিষয়টি ছোটবেলা থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি, তবে তাদের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা সহজ হবে। আমাদের বাচ্চাদের পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করানো দরকার। প্রয়োজন পাঠ্যসূচিতে এটির অন্তর্ভুক্তি। চতুর্থ শ্রেণী থেকে অনার্স পর্যন্ত পরিবেশ বিষয়ে পড়াশোনা বাধ্যতামূলক করা। তাহলে সচেতনতা বাড়বে। আমাদের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এলে যারা এর বিরুদ্ধে কাজ করছে, তারা আর পার পাবে না। আমাদের কাজ করতে সুবিধা হবে। মানুষকে বোঝানোর কাজটা কঠিন। আর এই কাজটি যদি তরুণ প্রজন্মের মাঝে করা যায়, তাহলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বর্তমান কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলুন?

বেলা এখন বেশি যে কাজটি করছে, সেটি হলো তৃণমূল পর্যায়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা দেওয়া। এ কাজটি আমরা করছি নিষ্ঠার সঙ্গে।

বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে আপনার ভাবনার কথাটা জানতে চাই?

পরিবেশ আইনের নামে অত্যাচার হচ্ছে গরিবের ওপর। আর যারা আসলে পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করছে, তারা দিব্যি আছে। তাদের কোনো সমস্যা নেই। পরিবেশ-শাসনব্যবস্থাটা খুব বেশি নাজুক হয়ে পড়েছে বলেই আজ দেশের এই হাল। রাজনৈতিক দলগুলোরও সেই অর্থে কোনো কমিটমেন্ট নেই। যদি থাকত, তাহলে হাজারীবাগের ট্যানারি সরাতে এত সময় লাগত না। জাহাজভাঙাশিল্পের ব্যাপারে বিধি দিয়েও একে নিয়ন্ত্রণ করতে সময় নষ্ট করা হতো না। পাহাড়ে এত প্রাণহানি হতো না। চারদিকে আবাসন কোম্পানিগুলোর যে অত্যাচার চলছে, তা বন্ধ হতো। সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রশাসন কোথায় যেন আটকে আছে।

দেশের জাহাজভাঙ্গাশিল্প সম্পর্কে কিছু বলুন?

আমাদের এখানে ভাঙার জন্য আনা জাহাজগুলো উন্নত বিশ্বের। বেশির ভাগই ইউরোপীয় জাহাজ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাপান এবং আমেরিকার দু-একটা জাহাজ আসে। যখন এ জাহাজগুলোর জাহাজ হিসেবে ব্যবহার শেষ হয়ে যায়, তখন তারা এগুলোকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয় ভাঙার জন্য। বিশ্বের মাত্র তিনটা দেশ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জাহাজ ভাঙে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান। ভারতে ভাঙে শুধু গুজরাটে। মুম্বাই একসময় ভাঙত, পরে বন্ধ করে দিয়েছে। পাকিস্তান তখনই জাহাজ ভাঙতে পারে যখন বাংলাদেশে জাহাজভাঙা বন্ধ থাকে। অন্য প্রতিযোগীদের টপকে বাংলাদেশিরা অনেক বেশি দাম দিয়ে এসব জাহাজ কিনে আনে। এগুলো কীভাবে ভাঙা হবে, কীভাবে বর্জ্য নিষ্কাশন করা হবে সেই দায়িত্ব মূলত উন্নত বিশ্বের। সে দায়িত্ব আমাদের না। আমাদের কেন নিতে হচ্ছে। আমাদের নাকি লোহা লাগবে। বিশ্বে দেশ আছে ১৯৫টি, লোহা আছে ১৪টার। বাকি দেশগুলো কেমন করে লোহার চাহিদা মেটায়। ওরাও তো মেটায়। শ্রীলঙ্কা মেটায় না, নেপাল মেটায় না? বাংলাদেশের পরে শ্রীলঙ্কায় এসব জাহাজ নেওয়ার কথা ছিল। শ্রীলঙ্কার সরকার সাফ বলে দিয়েছে, আমরা এটা নেব না।

ইটভাটার কালোধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ

জাহাজভাঙাশিল্পটা বাংলাদেশে চলে দুটো যুক্তির ভিত্তিতে। একটা হলো- এটা বাংলাদেশের লোহার চাহিদা মেটায়, আরেকটা হচ্ছে এটা কর্মসংস্থান করে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এ দুটো যুক্তি আসলে খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এ জাহাজগুলো যে পরিমাণ লোহা সরবরাহ করে, সেটা দেশের মোট লোহার চাহিদার ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশ মোট চারভাবে লোহা আনে। এক. সরাসরি রড আনে। দুই. বিলেড এনে সেখান থেকে রড বানায়। তিন. স্ক্র্যাপ আনে। স্ক্র্যাপ থেকে রড বানায়। আর চার. লোহা সংগ্রহ করে জাহাজভাঙাশিল্প থেকে। আমাদের যুক্তি হচ্ছে, মাত্র ২৫ শতাংশ লোহার জন্য বিদেশি এই বর্জ্যটাকে গ্রহণ করা কেন দরকার? এতে আমাদের সমুদ্রসৈকত এলাকা নষ্ট হচ্ছে। কোস্টাল ফিশারিকে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে ধ্বংসের মুখে। কেন আমাদের জেলেরা তাদের জীবিকা থেকে বঞ্চিত হবে।  কেন এতগুলো মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া।

আপনি এ বিষয়ে যে বই-ই পড়বেন, সেখানেই লেখা আছে ‘ইট ইজ অ্যান এনভায়রনমেন্টালি ডেঞ্জারাস ইন্ডাস্ট্রি…।’ একসময় উন্নত দেশে সবাই জাহাজ ভাঙলেও গ্রাজুয়্যালি এগুলো এমন সব দেশে চলে গেছে যে দেশগুলো পরিবেশ ও শ্রম আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে খুবই দুর্বল। যদি এই শিল্পটা জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো শিল্প হতো, যদি চাহিদার ৮০ শতাংশ লোহার জোগান দিত তাহলে কিন্তু আমরা এভাবে বলতাম না। বুয়েটের একটি রিপোর্ট বলছে, জাহাজভাঙা এই লোহা কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ব্যবহার করা উচিত না। তা ছাড়া জাহাজভাঙা প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে অ্যাজবেস্টজ। ১৫ থেকে ৩০ বছরের পুরোনো সব জাহাজেই এটা থাকে। ওই অ্যাজবেস্টজের একটা ফোঁটা গায়ে লেগে গেলে আপনার ক্যানসার হতে পারে।

পৃথিবীর সব দেশ এই বর্জ্যযুক্ত জাহাজভাঙা বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধ করে দেওয়ার ফলেই আমাদের এখানে এসেছে। এ বাস্তবটা সব বইয়েই লেখা আছে। আপনি এটা পড়েন না কেন? পড়ে বোঝেন না কেন? বোঝেন না কারণ, এখানে অনেক অর্থের ব্যাপার জড়িত।

বন্ধনের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

বন্ধনকেও ধন্যবাদ।

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৯ তম সংখ্যা, মে ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top