নেই বহুতল ভবন, নেই বাইরের মানুষের আনাগোনা। বহু বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে মাসকটকে ‘উলটো দুবাই’ বলা হয়। কারণ দুবাই নিজ ঐতিহ্য ভুলে আধিক্যের চাকচিক্যের দিকে এগিয়েছে। অন্যদিকে ওমান এখনও তার ভূমি ও লোকসংস্কৃতিকে আঁকড়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে ওমান তেলবিহীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে চলছে। তাই নতুন পরিকল্পনায় দেশ গঠনের কিছু উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে। এসব প্রকল্পের মাঝে অন্যতম হলো সুলতাম হাইথাম সিটি।
মধ্যপ্রাচ্যের উন্নয়নে মেগাসিটি একটি নতুন মডেল যা দুবাইয়ের আদি রূপকে ভেঙ্গে ফেলে। উচ্চাশা নিয়ে নির্মিত অবাস্তব প্রকল্পগুলো মধ্যপ্রাচ্যে অনেকাংশেই ব্যর্থ হচ্ছে। একদম বিপরীতে গিয়ে হাইথাম সিটি তাই অনেক বাস্তমসম্মত একটি মডেল প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রস্তাবে ভবনগুলো বেশিরভাগই ছয় তলা বা তার চেয়ে কম উচ্চতার। এখানে বেশিরভাগ বাড়িঘর বানানো হয়েছে এই এলাকার মানুষদের জন্য। পর্যটকদের জন্যেও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মাসকট শহর ‘গালফ অফ ওমান’ সমুদ্র ও ‘হাযার’ পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত। ওমানের জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়ছে। সুলতান হাইথাম শহর এক লক্ষ মানুষের আবাসন নিয়ে কাজ করছে। এখানে ২৫টি মসজিদ ও ৩৯টি স্কুল নির্মিত হবে। এমন একটি ল্যান্ডমার্ক ও বিশাল প্রকল্প হলেও এর জন্য নির্ধারিত বাজেটের পরিমাণ (২.৬ বিলিয়ন ডলার) অপেক্ষাকৃত কম। যেমন সৌদি আরব ‘দ্য লাইন’ প্রকল্পে কেবল প্রথম ধাপেই ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে, যেখানে জনসংখ্যা হলো মাত্র ২ লক্ষ। আবার মিশরের নতুন প্রশাসনিক রাজধানী নির্মিত হচ্ছে ৫৮ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে জনসংখ্যা হলো ৬ লক্ষ। তবে ওমানের জনসংখ্যা কম এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অন্য দেশগুলোর মতো নয় বলে আধিক্যের ভাবনা নেই। ওমানের বেশিরভাগ মানুষই নিজ শহরে থাকে এবং চাকরি করে, যেখানে দুবাইয়ে মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ নিজ শহরে থাকে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ইয়াসির এলসেস্তয় বলেন, ‘ওমান এই বিষয়টা খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করেছে যে তারা আরেকটা দুবাই হতে চায় না।’
মডেলটা সফল হলো কি না তার জন্য আমাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এই প্রকল্পটি শেষ হবে ২০৪৫সালে। ওমানের জনগণকে বুঝিয়ে এখানে বসবাসের জন্য আনতে হলে তাদের এই সময় প্রয়োজন। ওমানের অধিবাসীদের ৮৯ শতাংশ মানুষের নিজেদের বাড়ি আছে। তারপরও দেশটি কিছু জটিল আবাসন সমস্যায় ভুগছে। এই কারণে সরকার ভাবছে, কি করে মানুষকে রাজি করাবে, যেন তারা একটি জনবহুল এলাকায় বসবাস করতে আগ্রহী হয়। কারণ ওমানের জনগণ সাধারণত নিজের একটা বাংলো বাড়িতে, কম জনসংখ্যার এলাকায় বসবাস করে অভ্যস্ত। লটারির মাধ্যমে তারা গৃহ নির্মাণের জন্য জমি পেয়ে থাকে। ফলে কাঠামোগত উন্নয়নে অনেক সময় লেগে যায়।

তেল ব্যবসায় সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা, শিক্ষা ও গৃহনির্মাণ নিশ্চিত করেছে। তাই এখন ওমানের দরকার পড়েছে নতুন আবাসন নীতিমালা তৈরির। কিন্তু বিশাল মরু অঞ্চল থাকায় সেখানে আবাসন প্রকল্পগুলো সফল করা বেশ ব্যয়বহুল এবং টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়েই হাইথাম সিটি পরিকল্পনা করা হচ্ছে, জনবহুল এলাকা হলেও এখানে যেন অধিবাসীদের ব্যক্তিগত স্থান ধরে রাখা যায়। পৃথক পৃথক ভিলা তৈরি এবং মাসকট বাণিজ্যিক কেন্দ্রের সাথে হাইথাম সিটির মাঝে একটি বিশেষ গণপরিবহণের ব্যবস্থা করা এই পরিকল্পনার অংশ।
ওমান সুলতান হাইথাম শহরে পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করতে চায়। ওমানে আগত পর্যটকদের সংখ্যা খুবই কম। তাই ছবির মতো সুন্দর দেখতে ঐতিহাসিক জায়গাগুলোকে কেন্দ্র করে তারা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গ্রহণ করছে। তারা মনে করছে, খুব জাকজমকপূর্ণ কিছু করে পর্যটক আকর্ষণ করার দরকার নেই। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোতে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। এর কারণ হিসেবে স্থপতি ইয়াসির বলেন, ‘অনেক দেশ তার নিজের মানুষ ও জলবায়ুর চাইতে বিদেশি সাহায্যকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছে। অতীতকে বিলীন করে নতুন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে বিশালাকার এই প্রকল্পগুলো।’ ইয়াসির আরও বলেন, ‘দুবাইয়ের বিশালাকার ইমারত আর নানান ভাস্কর্যকে চ্যালেঞ্জ করা কঠিন। কারণ এ অঞ্চলের মানুষের মনে দুবাই হলো উন্নয়নের চিত্র।’
নতুন এই শহরের জন্য বারোটি মূল বৈশিষ্ট্য ঠিক করা হয়েছে— অন্তর্ভুক্তি, সাশ্রয়ী, নিরাপদ, কম্প্যাক্ট, প্রবেশযোগ্য, আরামদায়ক, দৃঢ়, কার্যকর, যাতায়াত সুবিধা, স্বাস্থ্যকর, স্মার্ট এবং প্রেমময়। পরিবেশগতভাবে ওমানের অত্যাধিক তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং গ্রীষ্মকালে বন্যার ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে শহরের মাঝে একটা ৭.৫ কিলোমিটারের দীর্ঘ শুকনো নদী রাখা হয়েছে। বন্যার সময় নদীর প্রাকৃতিক পানি ব্যবহার করে একটি উজ্জ্বল পাবলিক গ্রিন পার্ক হিসেবে জায়গাটিকে গঠন করা হয়েছে। খোলামেলা এবং ছায়াযুক্ত এই সবুজ পার্কটি শহরের হাঁটা পথগুলোর সাথে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে যা ঘরের বাইরের কার্যক্রম এবং সামাজিক আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়। উনিশটি মহল্লাকে উদ্দীপিত করতে এই মহা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ওমান ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি কৌশলের মাধ্যমে অর্জিত হবে এই লক্ষ্য। যেমন- পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎস হিসেবে সৌর শক্তি ব্যবহার, বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা, পুনঃব্যবহারের জন্য বর্জ্য জল শোধন করা এবং একটি সমন্বিত টেকসই কৌশল বাস্তবায়ন যা উপকরণ পুনঃব্যবহার এবং রিসাইক্লিংয়ের ধারণাকে প্রচার করে। এয়ার কোয়ালিটি মনিটর, স্মার্ট পাবলিক লাইটিং ও স্মার্ট মোবিলিটির মাধ্যমে উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত কর হবে। আরও থাকবে মাইক্রো-মোবিলিটি স্টেশন, যা একইসাথে সম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে এবং দীর্ঘমেয়াদী বর্জ্য কমাতে সহায়তা করবে।
ওমানের এই হাইথাম সিটি শুধু ওমানের জন্য নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের জন্য একটি মডেল হতে পারে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এর উন্নয়ন কেবল আঞ্চলিক অর্থনীতির জন্য লাভজনক হবে না, বরং আন্তর্জাতিক মঞ্চে ওমানের গুরুত্ব বৃদ্ধি করবে।