স্থাপত্য ও অপরাধ-২
অপরাধ দমনে স্থাপত্য কেমন হওয়া দরকার

গ্রামবাংলার স্থাপত্যে ঐতিহ্যের কথা ওঠালেই প্রথমেই যে বাড়িটির ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেটি খোলামেলা মাটির বাড়ি। সামনে একটি উঠোন। চারপাশে নানা রঙের গাছ। বাড়ির চালটি চৌচালা, সেখানে বৃষ্টি পড়ার শব্দ নতুন এক উন্মাদনা সৃষ্টি করে। আর পাশের বাড়ি থেকে নানা বয়সী মানুষজন বিকেলবেলা এসে জড়ো হয় বাড়ির উঠোনে। অনেক সময় বড় একটি আমগাছ কিংবা অন্য কোনো ফলদ গাছ লাগানো হয়ে থাকে। চারপাশ খোলামেলা দক্ষিণা বাতাস বৈঠকখানায় হু-হু করে ঢুকে পড়ে। প্রতিটি ঘরের সামনে থাকে প্রশস্ত বারান্দা। সেখানে বড়রা সকাল-বিকেল চেয়ার নিয়ে বসে চারদিকে খেয়াল রাখেন। গল্প-গুজব করেন। রান্নাঘর থাকে মূল বাসকারী ঘর থেকে একটু দূরে, যার কারণে কখনো বসতবাড়িগুলো ধোঁয়াজনিত কারণে আচ্ছাদিত হয় না। প্রতিদিন সকালে গাছ থেকে পড়া শুকনো পাতা গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রান্নাঘরে। জ্বালানি হিসেবে সেগুলোকে খুব সহজে ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় বাড়ির আশপাশে থাকে অগভীর জলাশয় কিংবা পুকুর, যেখানে মাছের চাষ করা হয় এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কারণে অনেক সময় এই পানি ঘর-গৃহস্থালির কাজেও ব্যবহার করা হয়। চারদিকে পর্যাপ্ত খোলামেলা থাকার কারণে গৃহের অভ্যন্তরে আলোর স্বল্পতা কখনো পরিলক্ষিত হয় না। এ ধরনের বাড়িতে শান্তি-সম্প্রীতি অটুট থাকে সব সময়। তা ছাড়া আশপাশের কমিউনিটির সঙ্গে থাকে সুসম্পর্ক। এ তো গেল গ্রামের গল্প। এবার চোখ ফেরানো যাক শহরের অ্যাপার্টমেন্ট কালচারের দিকে।

পাঁচ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ফ্ল্যাট। সামনে ১৮ ফুটের প্রশস্ত রাস্তা প্রায় ৬০ শতাংশ জমির ওপর গড়ে উঠেছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটে লিফট, সিঁড়ি বিদ্যমান, রয়েছে ৮-১০টি গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা। প্রতিটি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট। মোট ফ্ল্যাটের সংখ্যা ১৪টি। প্রতিটি ফ্ল্যাটের মানুষের সংখ্যা যদি সর্বনিম্ন চারজন করে হয়, তাহলে মোট মানুষ আনুমানিক ১৪X৪ = ৫৬ বা ৬০ জনেরও বেশি হতে পারে। অথচ একথা সর্বজনগ্রাহ্য যে এই ৬০ জন মানুষের মধ্যে সঠিক নিয়মে গড়ে উঠছে না সুস্পর্ক। বর্তমানে খবরের কাগজ খুললেই যে খবরটা সচরাচর চোখে পড়ে সেটি হচ্ছে ‘ফ্ল্যাটের অভ্যন্তরে অপরাধ’। এমনও দেখা যাচ্ছে খুন-ডাকাতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকার অপরাধ দিন-রাতে সংঘটিত হচ্ছে অথচ পাশের ফ্ল্যাটেরই কেউ কিছু জানছে না। এমনকি গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে ঘটছে বড় রকম দুর্ঘটনা পাশের ফ্ল্যাটেই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, ‘বর্তমানে আমাদের দেশের যে অ্যাপার্টমেন্ট কালচার তৈরি হচ্ছে, সেটি কি স্থাপত্যের দৃষ্টিকোণে নিরাপদ?’

সার্ভিস লাইন ও শেডিং ডিভাইসযুক্ত ভবন

নিচে এর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যায়-

বর্তমানের অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে খোলা জায়গা নেই বললেই চলে। যদিও একটু থেকে থাকে অনেক বাড়ির মালিকদের দেখা যায় সেটিকে অন্য কোনো কাজে লাগাতে।

সমাজব্যবস্থায় এককেন্দ্রিকতা চলে আসার কারণে সমাজের মানুষেরা নিজেদের মতো ভালো থাকার চেষ্টা করছেন। ফলে পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের দিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়!

সৌন্দর্য কিংবা শান্তির চেয়ে টাকার মূল্য অনেক বেশি হওয়ায় বাড়ির মালিকেরা তাঁদের জায়গার প্রায় শতভাগ বসবাসের জন্য তৈরি করছেন। কারণ, বর্তমানে শহরগুলোতে প্রতি বর্গফুট জায়গার মূল্য ৭০০০-১২০০০ টাকা। এই লাভের কথা চিন্তা করে কমিউনিটি স্পেসের কথা তারা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে।

বাড়ির ভেতর এবং আশপাশের পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ না থাকার কারণে ছোট ছেলেমেয়েরা ঘরের চারদেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে এবং বাইরের জগতের সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এতে পরস্পরের সমঝোতার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের চারদেয়ালে আবদ্ধ ‘অ্যাপার্টমেন্ট’ কালচার এই ক্ষেত্রটিকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে।

একটা স্থাপনা থেকে আরেকটি স্থাপনার দূরত্ব কম থাকার কারণে অনেক বাড়ির ক্রেতা বা বিক্রেতা প্রাইভেন্সির জন্য অনেক সময় দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখে। যার দরুন গৃহের অভ্যন্তরে আলো-বাতাস চলাচল কম হয় এবং পাশের ফ্ল্যাটের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একটি অস্বচ্ছ ধারণা থাকে। আর এ জন্য কোনো অপরাধ সংঘটিত হলেও বাইরে কিংবা পার্শ্ববর্তী ফ্ল্যাট থেকে সেটা নিরূপণ করা সম্ভব হয় না।

স্থাপনার জন্য প্রয়োজন খোলামেলা পরিবেশ

এসব ফ্ল্যাটের প্রধান প্রবেশ দরজা একটি হওয়ার কারণে বিশেষ কোনো মুহূর্তে যেমন আগুন লাগলে কিংবা অন্য কোনো সময় বের হতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে।

বর্তমানে সিকিউরিটির কথা চিন্তা করে অনেকেই তাঁর অ্যাপার্টমেন্টকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখেন। এমনকি প্রয়োজনীয় ভেনটিলেশনের ব্যবস্থাও থাকে না। এ কারণে রান্নাঘরের অভ্যন্তরে থাকা গ্যাসের সিলিন্ডার কোনো কারণে লিক (ছিদ্র) হয়ে গেলে সেই গ্যাস বের হওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না, যা জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

সিঁড়ি একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে প্রতিটা বাসার ক্ষেত্রে। কারণ, অনেক সময় দেখা যায় সিঁড়ির রাইজার ৬ ইঞ্চির থেকে কম বা বেশি হয়ে থাকে, যা যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। তা ছাড়া সিঁড়ির আকার আকৃতি স্থাপনার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে, কোড অনুযায়ী সেগুলো ব্যবহার করতে হয়।

আমাদের দেশে অনেক স্থপতিকেই দেখা যায় এসব বিষয়কে আমলে না নিতে এবং সৌন্দর্যবর্ধনের ক্ষেত্রে যদি তাঁরা বিশেষ ধরনের কোনো স্থাপত্যিক নকশা প্রণয়ন করেও থাকেন, অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে সেই নকশা যেন কারও     প্রাণহরণের কারণ না হয়।

স্থাপত্য নকশার ক্ষেত্রে সাধারণ যেকোনো স্থাপনার জন্য চারটি দিক (উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম) প্রধানত বিবেচনা করা হয়। যেখানে আমাদের দেশের জলবায়ুর ওপর নির্ভর করে উত্তর-দক্ষিণ দিককে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। আলো-বাতাস চলাচলের জন্য এর পূর্ব-পশ্চিমকে প্রায় বন্ধ রাখা হয়। কারণ, পূর্ব-পশ্চিম দিক থেকে ঘরের অভ্যন্তরে বেশি পরিমাণ তাপ প্রবেশ করতে পারে। এর দরুন দেখা যায় বাড়িতে বসবাসকারী উত্তর-দক্ষিণ দিকে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখলেও পূর্ব-পশ্চিম দিকে সেটি রাখতে পারছে না। এমতাবস্থায় যদি বাড়ির আশপাশের ঝোপ-ঝাড় কিংবা মাঝারি গাছের বাগান করা হয়ে থাকে এবং অপর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকে, তাহলে সেখানে অপরাধ সংঘটিত হতে পারে বৈকি!

এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলে রাখা ভালো, অনেক সময় স্থাপনার সম্মুখভাগে অধিক মাত্রার উজ্জ্বল আলো দৃষ্টিভ্রম ঘটায়, যা ইলুউশন তৈরি করে। এতে যেকোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার (চুরি, ডাকাত) ঝুঁকি থাকে।

একটা কথা মোটেও অস্বীকার করা যাবে না। সমাজব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে শুধু নান্দনিকতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি কোনো আবাসিক স্থাপনার রাস্তাসংলগ্ন অংশ পুরোপুরি কাচ দিয়ে তৈরি করা হয় তাহলে রাস্তা থেকে যে কেউ ভেতরের কর্মকাণ্ড রাতের বেলা দেখতে পাবে এবং সেক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থায় এটা মোটেই নিরাপদ হবে না। তাই গøাস ব্যবহারের সময় বর্তমানে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

অনেকেই বিভিন্ন স্থাপনাতে অধিক চাকচিক্যময় টাইলস ব্যবহার করেন। তবে প্রথমেই দেখতে হবে স্থাপনার ব্যবহারকারী কারা, যেটির ওপর নির্ভর করে প্রয়োজনমতো বিভিন্ন রকমের টাইলস ব্যবহার করা যেতে পারে।

ঘনবসতির নগরায়ন চিত্র

বর্তমানে আরেকটি ব্যবস্থাপনা একটু ভাবিয়ে তুলছে। সাধারণত দেখা গেছে, স্থাপনার বাইরের অংশে যদি এমন কোনো প্লেট কিংবা ব্যবস্থা থাকে, যেখান দিয়ে খুব সহজেই যে কেউ দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে যেতে পারে তাহলে অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। তাই স্থাপনার সার্ভিস পাইপলাইন, শেডিংয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কেননা সুন্দর একটা বাড়ি বানানোর পর যখন সামান্য বিবেচনার অভাবে চারপাশে গ্রিল নামক লোহার খাঁচা দিয়ে আটকিয়ে দিয়ে ওটাকে জেলখানা হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের সামান্য ব্যবস্থাপনাকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করে।

লেখক : শিক্ষক ও জলবায়ু এবং পরিবেশ গবেষক
ছবি : ইন্টারনেট

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৭ তম সংখ্যা, মে ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top