রাজধানীর ভয়াবহ যানজট ও পার্কিং সমস্যার সমাধানে

রাজধানী ঢাকার যানজটই এ নগরের অন্যতম প্রধান সমস্যা। আর অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপর্যাপ্ত রাস্তা, যত্রতত্র ও অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পার্কিং, বছরজুড়ে রাস্তা খনন আর ভাঙাচোরা রাস্তাই মূলত এর জন্য দায়ী। বিশাল জনসংখ্যার চাপ তো আছেই। তদুপরি নেই কোনো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ ও পার্কিং নীতিমালা। ফলে সর্বত্রই বিরাজ করছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। আর এ কারণেই বৈশ্বিক নগরায়ণ ও অবকাঠামোগত সুবিধার মাপকাঠিতে ঢাকার অবস্থান ১৩৯তম (বিশ্বের ১৪০টি নগরের বিবেচনায়)। দীর্ঘদিন যাবৎ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের চেয়ে ঢাকা মাত্র এক পয়েন্ট ওপরে। যুদ্ধের কারণে দামেস্কের এই অবস্থা, নইলে ঢাকাই পেত ওই জরিপের সর্বনিম্ন স্থান। আধুনিক এই সময়ে যেখানে প্রায় সর্বত্র গাড়ি নিয়ন্ত্রিত হয় অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে, সেখানে এখনো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গাড়ি নিয়ন্ত্রিত হয় পুলিশের বাঁশি ও হাতের ইশারায়, দড়ি বেঁধে পৌরাণিক সব কায়দায়। লেন অনুসরণে গাড়ি না চালানো ও ওভারটেকিং করা যেন আমাদের মজ্জাগত স্বভাব। আশ্চর্যের বিষয়, বিশ্বের কোনো বড় নগরে এখন আর সহজে পুলিশ চোখে পড়ে না, অথচ ঢাকার সব সড়কের মোড়ে দাড়িঁয়ে ট্র্যাফিক পুলিশ। সড়কের ওপর ও ফুটপাতে গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো নিয়ম না থাকলেও পুলিশের অদক্ষতা বা দুর্বলতার কারণে হচ্ছে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং। 

মাঝেমধ্যে পুলিশ নগরীর কিছু জায়গায় মোবাইল কোর্ট বসিয়ে রাস্তায় পার্কিং করা গাড়ি আটক করে মামলা করে বটে। কিন্তু এ সব কার্যক্রম স্থায়ী না হওয়ায় মুহূর্তের মধ্যে (মোবাইল কোর্ট অফ হওয়ার পর) সবকিছু আগের মতো হয়ে যায়। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ চাইলেও কিছু করতে পারে না। কারণ, প্রভাবশালীদের ধমক ও ক্ষমতার দাপট! একবার তো এক মাননীয় বিচারপতির গাড়ি আটকানোর কারণে সংশ্লিষ্ট ট্র্যাফিক পুলিশ অতঃপর পুলিশের মহাপরিদর্শকেরও চাকরি যায়। ঢাকার রাস্তায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জের ধরে এ ধরনের আরও অনেক নাটকীয় গপ্পো আছে, যাতে পুলিশের অসহায়ত্বের সুবাধে ইদানীং ‘ফ্লাগস্ট্যান্ড’ লাগানো গাড়ির উল্টোপথ দিয়ে চালানোর সংস্কৃৃতিও শুরু হয়েছে। তা ছাড়া অনেকে তো রেড সিগন্যালের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে কৃতিত্ব বোধ করেন। দুনিয়ার আর কোথাও এ ধরনের অরাজকতা হয় কি না সন্দেহ! আর কিছু সড়ক নেটওয়ার্ক তো অনেকটা স্থায়ীভাবে অবরুদ্ধ বলা যায়! যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা এবং কিছু বিদেশি রাষ্ট্রদূতের দপ্তর ও বাসস্থান। এসবের মধ্যে যেদিন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির কর্মসূচি থাকে, সেদিন তো আর কথা নেই- সমগ্র নগরে লেগে যায় মহাজট। তা ছাড়া আছে যত্রতত্র আকস্মিক সভা-মিছিল-সমাবেশের আয়োজন। এতে সব মিলিয়ে নগরে নিত্যদিন যানজটের কারণে হাজারো শ্রমঘণ্টার ক্ষতিসহ নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার জ্বালানি এবং উত্তপ্ত হচ্ছে পরিবেশ ও জলবায়ু। এত সব দুর্ভোগের মধ্যেও অব্যাহত রয়েছে ‘ঢাকায় সবার নিজস্ব বাড়ি থাকার’ প্রতিযোগিতা।   

স্বয়ংক্রিয় পা‍র্কিং সিস্টেম

বাস্তবে নগরায়ণের মাপকাঠিতে রাজধানী ঢাকায় যে পরিমাণ জনসংখ্যা থাকার কথা, বসবাস তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লোকের। ফলে এই অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যার আধিক্য সৃষ্টি করছে ভয়াবহ সমস্যার। সুষ্ঠু পরিবহনব্যবস্থার জন্য যেখানে একটা শহর-নগরে ন্যূনতম শতকরা ২৫ ভাগ রাস্তা থাকার কথা, সেখানে এখন ঢাকায় আছে মাত্র ৭-৮ ভাগ। পুরান ঢাকায় তো এর পরিমাণ আরো কম। এমনিতে সরু রাস্তা আর অলিগলিতে গড়ে ওঠা পুরান ঢাকাকে বলা হয় ‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’র শহর। পুরান ঢাকা সার্বিকভাবে একটা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত ও অলিগলির শহর, যেখানে অনেক এলাকায় কোনো ধরনের গাড়ি প্রবেশ করে না, রিকশা-ভ্যানগাড়ি আর ঘোড়ার গাড়িই সেখানে পরিবহনের একমাত্র বাহন। অন্যদিকে দেশের সবকিছু ঢাকামুখী হওয়ায় নতুন আর পুরান ঢাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আগে যে জায়গায় একটা পরিবারের আবাস ছিল, সেখানে এখন ১৫-২০ পরিবারের বসবাস এবং অনেক ক্ষেত্রে (বহুতল ভবন হলে) তার চেয়ে  বেশি। পক্ষান্তরে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় বেড়েছে মানুষের সামর্থ্য। অর্থাৎ মাত্র কয়েক বছর আগে যাঁরা রিকশায় চড়তেন, তাঁদের এখন অনেকের রয়েছে গাড়ি। প্রতি মাসে রাজধানী ঢাকায় গড়ে সংযোজিত হচ্ছে ২০০টি নতুন গাড়ি। কিন্তু আনুপাতিক হারে বাড়েনি রাস্তা, বরং প্রায় রাস্তার ওপর বা ধারে চলছে নানা ধরনের ফেরি ব্যবসা ও বাণিজ্য। তা ছাড়া রাস্তার ওপর সর্বত্রই রাখা হয় গাড়ি পার্ক করে। এ ছাড়াও আছে রিকশা ও ভ্যানগাড়ি। ফলে কোনো সড়কেই পর্যাপ্ত ঈধৎৎরধমব ডধু নেই। এই নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতিতে বর্তমানে নগরের প্রায় সব জায়গায় বিশেষ করে নিউমার্কেট, পল্টন, মতিঝিল, দিলকুশা, বায়তুল মোকাররম, গুলিস্তান, শান্তিনগর, মৌচাক, বাড্ডা, মিরপুরের মতন এলাকায় বিষয়টি রূপ নিয়েছে প্রকটতর। আগে যেসব রাস্তায় কাউকে গাড়ি পার্ক করতে দিত না, এখন সেখানে এমনকি ভিআইপি রোড খ্যাত বিমানবন্দর সড়ক বা সচিবালয়ের সম্মুখ রাস্তার ওপরও গাড়ি (প্রাইভেটকার, সরকারি-বেসরকারি গাড়ি ও বাস) পার্ক করে রাখা হয় এবং অনেক রাস্তার ওপর কিংবা ধারে তো কয়েক রো-তে রাখা হয় গাড়ি পার্কিং করে।   

আর ঢাকা দেশের মধ্যভাগে অবস্থিত হওয়া এবং নগরের বাইরে বাইপাশ সড়ক না থাকায় সমগ্র দেশের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে যাওয়া-আসার সব গাড়ি রাজধানীর ওপর দিয়েই চলাচল করে। তার মধ্যে রাজধানীর অভ্যন্তরে রয়েছে কমলাপুরে রেলওয়ে স্টেশন ও অসংখ্য রেলক্রসিং। ফলে উল্লেখিত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে শহরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে আগে যেখানে ১০-১৫ মিনিট লাগত, এখন সেখানে অনেক সময় দেড়-দুই ঘণ্টায়ও যাওয়া যায় না। বৃষ্টি-বাদল হলে তো কথাই নেই, মুহূর্তের মধ্যে জলাবদ্ধতা ও ভয়াবহ জলজট, যাতে সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে পড়ে! অপর দিকে নগরের অনেক স্থানেই নেই পাবলিক পার্কিং, যার কারণে রাস্তার ওপর করা হয় গাড়ি পার্কিং। কিছু ভবন, স্থাপনা বা অফিস কমপ্লেক্সে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। ফলে এসব ভবন বা স্থাপনার প্রবেশপথ ও রাস্তার ওপর প্রায়ই গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে ঢাকায় একটি ভবন বা স্থাপনায়ও পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা নেই। তবে হালে নির্মিত ও নির্মাণাধীন ভবনসমূহে বেসমেন্ট ফ্লোর সংযোজন করে গাড়ি পার্কিংয়ের কমবেশি ব্যবস্থা সৃষ্টির চেষ্ঠা চলছে। কিন্তু সমস্যা হয়, যখন সব গাড়ি রাস্তায় চলে আসে। সকালবেলায় অফিস আর স্কুল-কলেজে যাওয়ার জন্য যখন সব গাড়ি রাস্তায় বের হয়, তখন নগরের চেহারা হয় অন্য রকম। এতসব সমস্যার মধ্যে যেটুকু রাস্তা আছে, তাও নিয়মিত সংস্কার করা হয় না এবং অনেক রাস্তা তো বছরজুড়ে খানাখন্দক বা নালা থেকে উপচেপড়া ময়লা পানিতে ভর্তি থাকে। তার মধ্যে প্রায়ই এখানে-ওখানে চলে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন। অনেক জায়গায় পরিলক্ষিত হয় কৃত্রিম সমস্যাও। যেমন সচিবালয়সহ অনেক সরকারি-বেসরকারি অফিস প্রাঙ্গণে দশনার্থীদের গাড়ি প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। ফলে এসব অফিস প্রাঙ্গণে কমবেশি পার্কিং থাকলে তা ব্যবহৃত না হওয়ায় রাস্তায় ওপর ভিজিটরদের গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে সৃষ্টি হয় যানজটের। 

অথচ নিয়ম অনুসারে নগরের প্রতিটা ভবন ও কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত নিজস্ব গাড়ি পার্কিং থাকার কথা, নগরের সর্বত্র ও সর্বক্ষণ পুলিশের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা। শুধু তা-ই নয়, নগরে চিহ্নিত প্রায় কার পার্কিং স্থানগুলোও চলে গেছে অন্য ব্যবহারে। যেমন মতিঝিলে পাবলিক গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় নির্মিত হয়েছে ‘সিটি সেন্টার’; কাওরান বাজারে পার্কিংয়ের জায়গায় ‘কাঁচাবাজার’ আর বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের পরিবর্তে নির্মিত হয়েছে ‘কমিউনিটি সেন্টার’। এভাবে নগরে বিভিন্ন সময়ে সংরক্ষিত অপরাপর গাড়ি পার্কিং স্পেসগুলো বেহাত-বেদখল বা অন্য ব্যবহারে ব্যবহৃত চলে হয়। অন্যদিকে মতিঝিল-দিলকুশা এলাকায় নির্মিত কয়েকটি বহুতল পার্কিং লট সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। মাত্র ১০-২০ টাকার টিকিট কিনে এসব পার্কিংয়ে দিনভর গাড়ি রাখার ব্যবস্থা থাকলেও বেশির ভাগ চালক তা করে না। অন্যদিকে মতিঝিল-দিলকুশা ও কাওরান বাজার এলাকায় সত্তর-আশির দশকে নির্মিত সরকারি-বেসরকারি বহুতল ভবনগুলোতে (এমনকি ৮-১০ এবং তদূর্ধ্ব ভবনেও) একটি গাড়ি পার্কিংও নেই। একইভাবে নব্বইয়ের দশক থেকে নির্মিত অনেক আবাসিক ভবন ও কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে কমবেশি কিছু পার্কিং থাকলেও বেশির ভাগ শপিং কমপ্লেক্স কিংবা বাণিজ্যিক ভবনে কোনো গাড়ি পার্কিংই নেই। অনেক অফিস-মার্কেট-শপিং কমপ্লেক্স-স্কুল-কলেজ-ক্লিনিক- হাসপাতাল প্রাঙ্গণেও প্রয়োজনীয় গাড়ি পার্কিং নেই। ফলে এসব জায়গায় ভবন-ইমারত প্রাঙ্গণ, ফুটপাত আর রাস্তা গাড়িতে একাকার হয়ে থাকে। এসব কারণে নগরের বড়-ছোট কোনো রাস্তায় এখন আর কাক্সিক্ষত গতিতে গাড়ি চালানো যায় না। সার্বিকভাবে এখন এই অবস্থা নতুন আর পুরান ঢাকা সর্বত্র। গুলশান ১ নম্বর গোল চত্বর থেকে ২ নম্বর চত্বরে যেতে আধা ঘণ্টা লেগে যায়। বনানীর কাকলী থেকে মহাখালী ফ্লাইওভার পর্যন্ত আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সম্মুখে সর্বক্ষণ যানজট লেগে থাকে। ফলে মহাখালী সড়কের মোড় আর বনানী রেলক্রসিংয়ের ওপর ফ্লাইওভার নির্মাণ করে কোনো লাভ হয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তা ছাড়া শুধু ফ্লাইওভার নির্মাণ করে ঢাকার যানজট সমস্যা নিরসণ করা যাবে কি না তা নিয়েও আলোচনা চলছে।

স্বয়ংক্রিয় পা‍র্কিং সিস্টেম

আমাদের দেশের নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগরবাসী অনেকেই বিদেশ যান। বিশেষ করে যাঁরা গাড়ি ব্যবহার করেন, তাঁদের তো শতভাগেরই বাইরে যাবার অভিজ্ঞতা আছে। তাঁরা দেখেছেন, বিদেশে কীভাবে প্রতিটা ইমারত-স্থাপনা বা কমপ্লেক্সের আঙ্গিনায় স্ব-স্ব পরিকল্পনায় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। অনেক অফিস, হোটেল ও মার্কেট প্রাঙ্গণে ভিন্নভাবে বহুতল পার্কিং ভবন বা লট বা বেসমেন্ট ফ্লোরে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। ইদানীং দেশের নগর এলাকায় পার্কিং সমস্যার ব্যাপকতায় নতুন করে নির্মিত কিছু ইমারতে বেসমেন্ট ফ্লোর নির্মাণ করে তা নিরসনের চেষ্টা চললেও নব্বইয়ের দশকের আগে নির্মিত ভবনগুলোর কোনোটিতে বেসমেন্ট ফ্লোর ছিল না। প্রায় ক্ষেত্রেই ইমারতের সামনের খোলা জায়গায় গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করা হতো। আবার কিছু ভবনে বেসমেন্ট ফ্লোরে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে তার ভিন্ন ব্যবহার হয়েছে। আসলে আশির দশকেও ইমারতের নকশা অনুমোদন করার সময় বাড়ির আঙ্গিনায় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য জায়গা সংরক্ষণের ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। এ জন্য রাজধানী ঢাকায় বড় মার্কেট কিংবা স্থাপনাসমূহে (নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, পল্টন, গুলিস্তান, মৌচাক, কাওরান বাজার, বনানী, গুলশান, উত্তরা বা মিরপুর) পার্কিংয়ের অপ্রতুলতা। সত্যিকার অর্থে, আমাদের নগর পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে বরাবর দূরদর্শিতার অভাব! ১৯৮৮ সালে রাজউকের অথোরাইজড অফিসারের দায়িত্ব পালনকালে বনানী বাণিজ্যিক এলাকায় পার্কিংবিহীন বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদনে আপত্তি করায় আমার সহকর্মী নগর পরিকল্পনাবিদেরা তখন আমাকে সমর্থন দেননি। শুধু বনানী-গুলশান নয়, ঢাকার মতিঝিল-দিলকুশা ও কাওরান বাজার বাণিজ্যিক এলাকায় কিছু ১৫-২০ তলা ভবনের ভেতরে বা ভবন প্রাঙ্গণেও কোনো গাড়ি পার্কিং নেই। প্রথম থেকে যদি আমাদের নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি বন্ধুরা এ বিষয়টি গুরুত্ব দিতেন, তাহলে ঢাকার আজকের এই অবস্থা নাও হতে পারত! একইভাবে দেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সারা বছর বিভিন্ন প্রশিক্ষণে  বিদেশ যাচ্ছেন। তাঁরা দেখছেন, কীভাবে সেখানে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। অথচ আজ অবধি কোনো পার্কিং নীতিমালা নেই আমাদের। 

সমস্যা উত্তরণের উপায়

নগরের চতুর্দিকে বাইপাশ সড়ক নির্মাণ 

ঢাকা মহানগরের চারদিক নদী পরিবেষ্টিত। তন্মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে ‘আদি ঢাকা’, তুরাগ নদীর ধারে টঙ্গী-মিরপুর-রায়েরবাজার, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা-কাঁচপুর এবং বংশী নদীর পাশে সাভার গড়ে ওঠে। এসব নদীর সঙ্গে সংযোগ ঘটেছিল ঢাকা শহরের অভ্যন্তরস্থ একগুচ্ছ খালের। কিন্তু কালচক্রে এসব খাল ভরাট হয়ে গেছে। ফলে ঢাকা বহু আগে হারিয়েছে তার আদিরূপ। অন্যদিকে নদীর ধারে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের ফলে ভেতরের বিস্তীর্র্ণ নিচু ভূমিও স্বার্থান্বেষী মহলবিশেষ কর্তৃক ভরাট করে ফেলা হয়েছে। কথা ছিল, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধসমূহকে বাইপাশ সড়ক হিসেবে পরিণত করা হবে। কিন্তু কিছু জায়গায় তা আংশিকভাবে হলেও অনেক স্থানে তা সড়ক হিসেবে নির্মিত হয়নি। ফলে বাইপাশ সড়ক না থাকায় সারা দেশের আন্তজেলার যোগাযোগ হয় রাজধানী ঢাকার ওপর দিয়ে। এতে স্বাভাবিকভাবে রাজধানীতে বাড়তি যানবাহনের প্রবেশ ও যানজটের সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকভাবে রাজধানীর অভ্যন্তরে আন্তজেলা বাসটার্মিনালগুলোর (সায়েদাবাদ, কমলাপুর, মহাখালী ও গাবতলী) কারণেও নগরে হচ্ছে ভয়াবহ যানজট। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে বাইপাশ সড়ক নির্মাণের বিকল্প নেই। কাজেই যথাত্বরিত কাঁচপুর-মদনগঞ্জ-টঙ্গী-সাভার-কেরানীগঞ্জ-ডেমরা-কাঁচপুর বাইপাশ সড়ক নির্মাণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ট্রে বিশিষ্ট পা‍র্কিং সিস্টেম

রাজধানীর অভ্যন্তর থেকে রেলপথ অপসারণ

ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকায় রেল সার্ভিসেস চালু হয়। অতঃপর দেশজুড়ে রেলপথের বিস্তার ঘটলেও ঢাকার অভ্যন্তরে কমলাপুর আর তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন এখনো রয়েছে বহাল তবিয়ে। টঙ্গী থেকে তেজগাঁও হয়ে কমলাপুরে স্টেশনে ট্রেন ঢাকায় প্রবেশে ছোট-বড় অনেকগুলো রেলক্রসিং পার হতে হয়। এসব রেলক্রসিংয়ের কারণে ঢাকার অভ্যন্তরে সব সময় যানজট। এ নিয়ে নগরবাসীর সীমাহীন দুর্ভোগের মুখে কয়েকটি রেলক্রসিংয়ের ওপর ওভারপাশ বা ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও সার্বিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে নগরের অভ্যন্তর থেকে আন্তজেলা বাসটার্মিনাল এবং কমলাপুর ও তেজগাঁও রেলস্টেশন রাজধানীর বাইরে অন্যত্র অপসারণ করা দরকার।  দীর্ঘদিন ধরে কথা হচ্ছে, এই দুটি স্টেশনের কার্যক্রম টঙ্গীতে অপসারণ করে ঢাকার অভ্যন্তরে শুধু কমিউটার সার্ভিস চালু করা, কিন্তু এর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বরং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয় যে এই রুটটিতে নাকি আরও নতুন রেললাইন সংযোজন করা হবে। রাজধানীকে সচল রাখতে হলে ঢাকার অভ্যন্তর থেকে আন্তজেলা রেল সার্ভিস বন্ধ করা ও রেলপথ অপসারণের বিকল্প নেই। পরিত্যক্ত রেলপথকে সড়কে পরিণত করে তার ওপর বা নিচ দিয়ে মেট্রোরেল, মনোরেল, স্কাইরেল বা এমআরটি বা বিআরটি স্থাপনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।  

রাজধানী থেকে অনেক কিছু বিকেন্দ্রীকরণ

অদ্ভুতভাবে দেশের সবকিছু রাজধানী ঢাকায়। সব ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, বিপণিবিতান, হাসপাতাল থেকে শুরু করে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টসশিল্প এককথায় সবকিছু ঢাকায়। জানামতে, ৫৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০টির প্রধান ক্যাম্পাস ঢাকায়, পাঁচ হাজার রপ্তানিমুখী গার্মেন্টসশিল্পের প্রায় তিন হাজার ৫০০টি রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে এবং সব কয়টা বড় হাসপাতালের অবস্থান ঢাকায়। সুতরাং দেশবাসীকে এসবের প্রয়োজনে ঢাকায় আসতেই হচ্ছে। একসময় এসব অনেক সুবিধা চট্টগ্রাম ও অপরাপর বিভাগীয় শহরে ছিল, কিন্তু এখন সবকিছুই ঢাকায়। বিশেষ করে স্বাধীনতার আগে চট্টগ্রাম ছিল ঢাকার বিকল্প নগর, যেখানে তখন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক মানের অনেক কর্মযজ্ঞ হতো। কিন্তু আজ চট্টগ্রাম এসব কিছু থেকে বঞ্চিত। তা ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ধারাবাহিক দুরবস্থায় এখন আর কেউ সহজে চট্টগ্রামে যেতে চায় না। মূলত চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত যেই রপ্তানিমুখী গার্মেন্টসশিল্প হতে পারত চট্টগ্রামের আশপাশে, তার বিস্তৃতি ঘটেছে ও ঘটে চলেছে ঢাকায়। কিন্তু এভাবে তো একটা দেশ ও তার রাজধানী পরিচালিত হতে পারে না! কাজেই এসব সুবিধার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে এবং এতে অবশ্যই ঢাকার ওপর চাপ কমবে, কমবে যানজট।

যানজট ও গাড়ি পা‍র্কিং সিস্টেম

স্ট্র্যাটেজিক  ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের বাস্তবায়ন

১৯৯২ সাল থেকে ঢাকার মহাপরিকল্পনা সমীক্ষার পাশাপাশি বৃহত্তর ঢাকা তথা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুর জেলাজুড়ে পরিচালিত হয় বিশদ পরিবহন সমীক্ষা, যার ভিত্তিতে প্রণীত হয় ‘স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান’ সংক্ষেপে ‘এসটিপি’। ২০০৮ সালে এই পরিবহন পরিকল্পনাটি অনুমোদিত হয়, যাতে গণপরিবহন খাতে স্থল, নৌ ও রেল পরিবহনের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের অনেক সুপারিশ আছে। ‘বিআরটি’ (ডেডিকেটেড বাস রুটসহ সড়কব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ), ‘এমআরটি’ (আধুনিক রেল পরিবহনব্যবস্থার চালুকরণ) চালু করার সুপারিশ ছিল, কিন্তু আজ অবধি এসব সুপারিশের কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। ‘এমআরটি’র প্যাকেজের আওতায় জাইকার আর্থিক সহায়তায় একটি রুট (উত্তরা-মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত) চালু করতে গিয়ে বিভিন্ন জটিলতায় পড়ে তা থমকে আছে। কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে রেলপথের ধার দিয়ে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত প্রস্তাবিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসটি (ফ্লাইওভারটি) মুখথুবড়ে পড়েছে। ‘বিআরটি’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বেশ কিছু আধুনিক বাস আমদানি করা হলেও নগরে অদ্যাবধি ডেডিকেটেড বাস রুট করতে না পারায় কোনো ফলোদয় হয়নি। ফলে দিনে দিনে পরিবহন সমস্যার প্রকটতা হয়ে যানজটের ব্যাপকতা বাড়াচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে, আজ থেকে এক যুগ আগে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রধান শহর বা নগর কলকাতা-দিল্লি-মুম্বাই, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা মত নগরীও ভয়াবহ ট্র্যাফিক ও যানজট সমস্যায় ছিল। কিন্তু এসব শহর-নগরে পরিকল্পিতভাবে এমআরটি কিংবা বিআরটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার পর সেখানে এখন আর আগের মতো ভয়াবহ যানজট নেই। তাই ঢাকার যানজট সমস্যা থেকে উত্তরণে ‘এসটিপি’র বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

মোঃ এমদাদুল ইসলাম

প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক

চলবে…

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪২ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top