বিল্ডিং কোডের কার্যকর প্রয়োগ 

ইমারত ও বিল্ডিং কোড

ইমারত নির্মাণ আইনে ‘ইমারত’ বলতে যেকোনো সামগ্রী বা উপকরণ দিয়ে তৈরি স্থায়ী-অস্থায়ী কাঠামো বা স্থাপনাকে বোঝায়, যার আওতায় বস্তি থেকে বহুতল অট্টালিকা সবকিছুই পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে নিম্নআয়ের মানুষের সামর্থ্যরে অভাব তথা নির্মাণযোগ্য ভূমি স্বল্পতায় সাধারণ মানুষ যে যেখানে যেভাবে পারছে, সেভাবে ঘরবাড়ি বা ইমারত নির্মাণ করে বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। এসব ইমারত বা স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে খুব কম ক্ষেত্রেই অনুমোদন নেওয়া হয়। আবার যারা বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন নিয়ে ইমারত নির্মাণ করে, তাদেরও বেশির ভাগ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ইমারত নির্মাণ করে। এ বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে বেশি ঘটে নগর এলাকায়। অবশ্য ‘কিছু মানুষ’ আছে, যারা আইন ও বিধি-বিধান উপেক্ষা করে স্থাপনা নির্মাণে আগ্রহী। আইনি ভাষায় এসব স্থাপনা ‘অবৈধ’ ও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ইমারত। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় ‘ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত’ বলতে কাঠামোগত অনিরাপদ, জরাজীর্ণ, অস্বাস্থ্যকর, অগ্নি-ঝুঁকিপূর্ণ, যথাযথ জরুরি নির্গমন পথবিহীন, ভগ্নপ্রায়, যথাযথ সংস্কারবিহীন, পরিত্যক্ত, জন-অধ্যুষিত ও সংলগ্ন এলাকার জনসাধারণের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে চিহ্নিত যেকোনো ইমারত বা নির্মাণকাজকে বোঝানো হয়েছে, যা কারিগরি ভাষায় Non-Engineered Structures হিসেবে বিবেচিত।

নগর এলাকায় ঘিঞ্জি পরিবেশ এবং এলোপাতাড়িভাবে নিচু ভূমি কিংবা পুকুর ভরাট করে বা পাহাড় কেটে ইমারত নির্মাণের ফলে দিন দিন বাড়ছে নানা ধরনের ঝুঁকি। প্রতিদিন এখানে-ওখানে বিভিন্ন মাত্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই এ ধরনের স্থাপনা বা ইমারত নির্মাণরোধে বিশেষ করে যত্রতত্র শিল্প স্থাপন ও হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্মাণশিল্পে শৃঙ্খলা আণয়ন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ ও নির্মাণকাজে অপচয় রোধের লক্ষ্যে নিজস্ব আঙ্গিকে বিল্ডিং কোড প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তা ছাড়া রাজধানী ঢাকা এবং বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে যত্রতত্র ও অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ভবনে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি স্থাপন ও বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে Non-Compliance-এর কারণে বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষ থেকেও যথাযথভাবে গার্মেন্টস ভবন নির্মাণ বা স্থাপনের চাপ রয়েছে। এতদ্প্রেক্ষিতে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯১ সালে নির্মাণশিল্পের পরিকল্পিত বিকাশ, নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় Uniform Standards of Safety, State-of-the-Art Technology & General Welfare of People-এর বিবেচনায় সামগ্রিকভাবে একটা বিল্ডিং কোড প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তদনুসারে দেশজ জলবায়ু, পরিবেশ, নির্মাণ ঐতিহ্য, নির্মাণসামগ্রী, বিভিন্ন ঝুঁকি (অগ্নিকাণ্ড, ভূ-কম্পন ইত্যাদি) ও কারিগরি কৌশলের বিবেচনায় প্রণীত হয় ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-১৯৯৩’ সংক্ষেপে ‘বিএনবিসি’। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করেন দেশের স্থপতি-প্রকৌশলী ও অপরাপর পেশাজীবীরা। 

ইমারত ও বিল্ডিং কোড

বিএনবিসি

বিএনবিসিতে সর্বমোট ১০টি চ্যাপ্টার রয়েছে, যা নিম্নরূপ:

  • Scope and Definitions
  • Administration and Enforcement
  • General Building Requirements, Control and Regulation
  • Fire Protection
  • Building Materials
  • Structural Design
  • Construction Practices and Safety
  • Building Services
  • Alteration, Addition to and Change of Use of Existing Building
  • Sign and Outdoor Display

কোডটির বাস্তবায়ন ও কার্যকরণে বিএনবিসিতে বেশ কিছু সুপারিশ ছিল। তন্মধ্যে ইমারত নির্মাণ  আইন-১৯৫২-এর আওতায় এটির কার্যকরণ এবং যথাযথ বাস্তবায়নে একটা Code Enforcement Authority গঠন করাটা ছিল অন্যতম, যার আওতায় নগর থেকে গ্রাম সর্বত্র কার্যকরণের নির্দেশনা ছিল। ইমারত নির্মাণ আইনে বর্ণিত অথোরাইড অফিসার (Authorised Officer) এর পরিবর্তে বিল্ডিং কোডে ইমারতের নকশা অনুমোদন, নির্মাণ তদারকি কিংবা মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিল্ডিং অফিশিয়াল (Building Official)-এর ওপর অর্পণ করা হয় এবং বিল্ডিং অফিশিয়াল হিসেবে নিয়োজিত হতে নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি বা প্রকৌশলীদের বিশেষ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এসব সুপারিশ বা নির্দেশনা কার্যকর হয়নি। অর্থাৎ এ পর্যন্ত দেশের কোনো জায়গায় একজন বিল্ডিং অফিশিয়ালও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে দেশে একটা বিল্ডিং কোড থাকা সত্ত্বেও তা আজ অবধি ঐচ্ছিক পরিপত্র (Optional Document) হিসেবে রয়ে গেছে। অর্থাৎ কেউ ইচ্ছে করলে এটি অনুসরণ করল আর ইচ্ছে না হলে করল না! 

অথচ বিল্ডিং কোড হচ্ছে ইমারত নির্মাণের অ-ত, যেখানে নকশা অনুমোদন থেকে নির্মাণের সব কলাকৌশল বর্ণিত আছে। ঝুঁকিমুক্ত ইমারত নির্মাণের খুঁটিনাটিসহ সব ধরনের নিয়মনীতি এতে উল্লেখিত আছে। যেকোনো ধরনের ইমারত নির্মাণের আগে Geo-Technical Investigation এবং ওই জমির ভূমি ব্যবহার অনুসারে অভিজ্ঞ ও পেশাজীবী নগর পরিকল্পনাবিদ বা স্থপতি বা প্রকৌশলী দ্বারা বিস্তারিত ডিজাইন প্রণয়ন করে তাঁদের তত্ত্বাবধানে উপযুক্ত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে যথাযথ পদ্ধতিতে নির্মাণকাজ স¤পাদন করা বাধ্যতামূলক। নির্মাণের প্রতিটি স্তরে গুণগতমান নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় টেস্ট পরিচালনা, কারিগরি মান বজায় রেখে নির্মাণকাজ করা, Occupancy Certificate গ্রহণ করা, নির্ধারিত ব্যবহার অর্থাৎ যে ব্যবহার উল্লেখ করে নকশার অনুমোদন নেওয়া হয়েছে, সেভাবে ইমারতের ব্যবহার করা এবং নিয়মিত ইমারতের পরিচর্যা-রক্ষণাবেক্ষণ-সংস্কারের নির্দেশনা মেনে চলা। একইভাবে ইমারতের Re-Construction, Vertical Extention বা ভাঙার (Demolition) বিষয়টিও সম্পূর্ণভাবে একটা কারিগরি কৌশল এবং বিল্ডিং কোডে এর যাবতীয় নিয়ম উল্লেখ রয়েছে।  

কিন্তু অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিএনবিসি আইনগত ভিত্তি পায়নি। এ অবস্থায় ঢাকা মহানগরে উপর্যুপরি ইমারতধসের প্রেক্ষাপটে কোডটি প্রণয়নের ১৩ বছর পর ২০০৬ সালে ইমারত নির্মাণ আইন সংশোধন করে তাতে বিল্ডিং কোড প্রণয়ন ও কার্যকরণের ব্যবস্থা করা হয়। অতঃপর ১৫ নভেম্বর ২০০৬-এ এটিকে ইমারত নির্মাণ আইনের আওতায় গেজেট করা হয়। কিন্তু এর পর অদ্যাবধি বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠিত হয়নি, ফলে বিএনবিসি আইনের অংশ হয়েও এখনো তা ঐচ্ছিক পরিপত্র বলা যায়। খুব কমসংখ্যক ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহারেও নেই সঠিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। নগর এলাকায় স্থপতি-প্রকৌশলীরা ইমারতের ডিজাইন করলেও তাঁরা তদারকিতে থাকেন না। এতে এখনো রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যেনতেনভাবে ইমারত নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। বিধি ও কোড অনুসরণ ব্যতিরেকে কিছু নির্মাণ করলে এবং তা আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাবে অদ্যাবধি কোনো বিষয়ে কারও কোনো ধরনের শাস্তি হয়নি। শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বাইরে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অধীনের সংস্থা বা দপ্তরগুলোও বিএনবিসি অনুসরণ ও ব্যবহার করে না। আর বেসরকারি ক্ষেত্রের চিত্রটাও একই রকম।  

বাস্তব অবস্থা

ইমারত নির্মাণ আইনটি সারা দেশের জন্য প্রণীত হলেও অদ্যাবধি রাজধানী ঢাকা এবং অপর তিনটি বিভাগীয় শহর (চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা) ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে অথোরাইড অফিসার নিয়োগ করা হয়নি। সর্বশেষ কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে কক্সবাজারের পর্যটন নগরে এলোপাতাড়ি ইমারত নির্মাণ রোধে অথোরাইড অফিসারের দায়িত্ব পালনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়াধীন স্থাপত্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রণীত ডিজাইনের ক্ষেত্রে প্রধান স্থপতিকে সরকারি ইমারতের নিয়ন্ত্রণে অথোরাইড অফিসার নিয়োগ করা হয়। এই অবস্থা বিল্ডিং কোডের ক্ষেত্রেও। এটি একটি জনগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দলিল হওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি তার কাঙ্খিত ব্যবহার না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ পরিলক্ষিত হয়। যেমন- রাজধানী ঢাকার দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, রাজউক ও উলে­খিত অপরাপর সংস্থা বা দপ্তরের অধীনে নিয়োজিত অথোরাইড অফিসার কিংবা বিসি কমিটি বিধিমালা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার ভ‚মি ব্যবহার ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন দপ্তরের ছাড়পত্র অনুযায়ী শুধু বিল্ডিং লে-আউট ও প্ল্যান অনুমোদন করে। নির্মাণ বা কারিগরি নকশা অনুমোদন করে না। ফলে নকশা অনুমোদনের পর একটি ইমারতের নির্মাণকাজ কখন শুরু হয় ও শেষ হয় তা দেখার কেউ নেই। বাস্তবে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ইমারত নির্মিত হচ্ছে কি না, তা তদারকি ও মনিটর করার জন্য রাজউক বা সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা বা দপ্তরে প্রয়োজনীয় জনবল নেই। ফলে সরকারি ইমারত ব্যতিরেকে খুব কম ইমারতই অনুমোদিত নকশা মোতাবেক নির্মিত হয়। ১৯৫৬ সালে ডিআইটির জন্মলগ্নে (যখন ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল চার-পাঁচ লাখের মতো) যে পরিমাণ জনবল ছিল, ৫৭ বছর পরও আজকের রাজউকে সেই একই জনবল। অথচ এর মধ্যে রাজউকের পরিধি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, নগরে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে দেড় কোটির ওপর, ঘরবাড়ি ও ইমারত নির্মিত হয়েছে লাখ লাখ। অবশ্য অতিস¤প্রতি রাজউকের একটি নতুন সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদিত হয়েছে, যার আওতায় অথোরাইড অফিসার ও পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।

একটি বাড়ির প্ল্যান

দ্বিতীয়ত, ঢাকার মহাপরিকল্পনাভুক্ত এলাকায় রাজউকের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ; যেমন- ঢাকা, মিরপুর ও সাভার ক্যান্টনমেন্ট এবং পিলখানায় বিডিআর; টঙ্গী, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কদমরসুল পৌরসভা; বাড্ডা, সাতারকুল, বরুরা, শ্যামপুর-কদমতলী ইত্যাদি ইউনিয়ন পরিষদসমূহ তাদের কর্মপরিধিতে স্ব-স্ব বিধি-বিধান অনুসারে এলাকার নকশা অনুমোদন করে। কিন্তু তারা কেউ ইমারত নির্মাণ আইন, নগর উন্নয়ন আইন, জলাধার সংরক্ষণ আইন, বিল্ডিং কোড ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করে না। ফলে একেক প্রতিষ্ঠানের অধীনে একেকভাবে ইমারতের নকশা অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই সময়ে একটি দেশের রাজধানীতে ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাউসিং প্রকল্প ও ইমারতের নকশা অনুমোদন করার বিষয়টি হতবাক করার মতোই! রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র নির্মাণযোগ্য জমির স্বল্পতায় এসব স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক নিচু জমি ভরাট করে, পাহাড় কেটে, অপরিকল্পিত এলাকায় বা সরকারি খাসজমি দখল করে সেখানে যতসব ‘চমকপ্রদ’ হাউসিং প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে ঢাকার অভ্যন্তরে এবং আশপাশের নিম্নাঞ্চল ও খাল-নালা ভরাট করে এভাবে যেনতেনভাবে নরম জায়গার ওপর নির্মিত বা নির্মাণাধীন অনেক ইমারত আপনাতেই ধসে পড়তে, এমনকি অনেক জায়গায় ধেবে যেতেও দেখা যায়। ভূ-বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় সাত-আট মাত্রার ভূমিকম্পে এসব ভবন ধসে পড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। 

তৃতীয়ত, দেশে বিশেষ করে বেসরকারি পর্যায়ে ইমারত নির্মাণের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনো সংস্থাই ইমারতের বিস্তারিত স্থাপত্য ও কারিগরি নকশা অনুমোদন করে না। তাই নকশা অনুমোদন লাভের পর বা অনুমোদন না নিয়ে (!) জমির মালিক বা ডেভেলপাররা নিজেদের ইচ্ছামতো ইমারত নির্মাণ করে। ফলে একটি ইমারতের নির্মাণকাজ কখন শুরু ও শেষ হয় এবং নির্মাণোত্তর কীভাবে ইমারতটি ব্যবহৃত হয় তা দেখার কেউ নেই। এ সুবাদে যে যেভাবে পারে নিজের মতো করে ইমারত নির্মাণ ও ব্যবহার করে। অনেকেই স্বজ্ঞানে বা অজ্ঞানে খরচ কমানোর নামে সয়েল টেস্ট না করে ও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে ভবন বা ইমারত নির্মাণ করে। আইনগত বাধ্যবাধকতার অভাবে যেসব ক্ষেত্রে স্থপতি-প্রকৌশলীদের স¤পৃক্ততা থাকে, সেখানেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের পরামর্শ বা ডিজাইন উপেক্ষিত। আবার অনেকে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের ‘ফি’ দিতে হবে বিধায় বা ‘ফি’ না দেওয়ার জন্য মিস্ত্রি বা ওস্তাগারের পরামর্শে ইমারত নির্মাণ করে। 

চতুর্থত, ঢাকা মহানগরের কিছু এলাকায় এখনো কোনো সংস্থা বা কর্র্র্র্র্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ নেই। যেমন- সাভার এলাকাটি রাজউকের মহাপরিকল্পনাভুক্ত এলাকা হলেও সেখানে কিছু জায়গায় সাভার ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং কিছু জায়গায় সাভার পৌর বা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ইমারতের নকশা অনুমোদন দেয়। এই দোটানায় সাভার ক্যান্টনমেন্ট ও সাভার পৌর সীমানার মধ্যবর্তী স্থানে (বাইপাল এলাকায়) মালিক তাদের প্রস্তাবিত ইমারতটির নকশা অনুমোদনের জন্য সাভার ক্যান্টনমেন্টের প্রভাবিত এলাকার বিবেচনায় সাভার ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে। কিন্তু প্রভাবশালী মালিকপক্ষ অনুমোদনের অপেক্ষা না করেই তড়িঘড়ি নিচু জমিতে ইমারতটির নির্মাণ শেষ করে তাতে ‘স্পেকট্রাম’ গার্মেন্টসটি চালু করে। এ অবস্থায় একদিন আকস্মিক ইমারতটি ধসে পড়ে মারা যায় অনেক শ্রমিক-কর্মচারী। সর্বশেষ সাভারের ‘রানা প্লাজা’ ধসে প্রায় ১২০০ শ্রমিক-কর্মচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ঢাকা ও মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের চিত্রটাও একই। এসব জায়গার জমির মালিকেরা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড বা অপরাপর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে নকশা অনুমোদন না পেয়ে যেনতেনভাবে (যেকোনো মূহূর্তে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভেঙে দিতে পারে আশঙ্কায়) ইমারত নির্মাণ করে। সাভারের ‘স্পেকট্রাম’ ও ‘রানা প্লাজা’, তেজগাঁওস্থ ‘ফিনিক্স’ ভবনধসসহ বিভিন্ন সময়ে আরও যেসব ভবন ও স্থাপনা ধসে পড়ে, তার প্রায় সবগুলোর তদন্তে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট এলাকার ভ‚মি ব্যবহার অনুসরণ না করা, যথাযথভাবে ইমারতের ডিজাইন না করা, নিচু জমি তড়িঘড়ি করে ভরাট করে দুর্বল ভিত্তির ওপর ইমারত নির্মাণ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা, অনুমোদিত নকশার পরিবর্তন, মালিকের ইচ্ছা অনুসারে ইমারতের সম্প্রসারণ ইত্যাদির কারণে ওভারলোডিং হয়ে ভবনগুলো ধসে পড়ে।

পঞ্চমত, আবার কিছু জায়গা আছে, যেখানে রাজউক বা অপরাপর স্থানীয় প্রতিষ্ঠানও নকশা অনুমোদন করে না, অথচ সেখানে লোকজন তাদের ইচ্ছামতো ইমারত নির্মাণ করে বসবাস করছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। যেমন- ডিএনডি এলাকা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ডিএনডি বাঁধ এলাকার উন্নয়নে অদ্যাবধি কোনো জোনাল প্ল্যান বা ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণীত না হওয়ায় সেখানে রাজউক নকশা অনুমোদন করে না, যদিও কিছু ক্ষেত্রে সেখানে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা ইমারতের নকশা অনুমোদন করে। ধারণা করা হয়, ঢাকায় ড্যাপ প্রণীত হলে তা রাজধানীর পরিকল্পিত উন্নয়ন ও স¤প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু ড্যাপ প্রণয়ন ও অনুমোদিত হওয়া সত্ত্বেও রাজউকের সাংগঠনিক দুর্বলতা তথা ‘ভূমিদস্যু’ খ্যাত ডেভেলপারদের বাড়াবাড়িতে এটির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তা ছাড়া সংস্থায় নিজস্ব ও দক্ষ জনবলের অভাবে নিয়মিত ড্যাপ রিভিউ না করাও এর একটি বড় দুর্বলতা।

ষষ্ঠত, নগরের অভ্যন্তরে অপরিকল্পিত এলাকায়, সরু রাস্তার ধারে, ডিসপুটেড জমিতে, নিম্নাঞ্চলে, বন্যা প্রবাহিত এলাকায় বা মহাপরিকল্পনার ভূমি ব্যবহার পরিপন্থী জায়গায় জমির বাসিন্দারা বা দখলভোগীরা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে ‘ভুয়া’ (জাল স্বাক্ষরযুক্ত) নকশা অনুমোদনের ব্যবস্থা করে সেখানে যেনতেনভাবে ও তড়িঘড়ি করে ইমারত নির্মাণ করে। সচরাচর ১০-১২ ফুট চওড়ার কম প্রশস্ত রাস্তার ধারে নকশা অনুমোদন করা হয় না। তাই দুষ্টচক্রটি তিন-চার ফুটের গলিকে ১২-১৪ ফুটের রাস্তা দেখিয়ে ‘ভুয়া’ নকশা অনুমোদন করে! এসব ভুয়া  অনুমোদনের কোনো নথি বা কাগজপত্র রাজউকের রেকর্ডে নেই এবং কোনো ইমারতের মালিককে তাঁর নকশা দেখানোর জন্য নোটিশ দেওয়া হলে তিনি বা তাঁরা রাজউকে না গিয়ে হয়রানির অভিযোগ তুলে কেউ কেউ আদালতের আশ্রয় নেন। অতঃপর বছরের পর বছর ধরে আদালতে মামলা ঝুলে থেকে বিষয়গুলো অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে থাকে। এভাবে শুধু আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাজধানী ঢাকার অলিগলিতে নির্মিত হাজার হাজার অবৈধ, জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত বা স্থাপনার অপসারণ কার্যক্রম থেমে আছে।

সপ্তমত, আরেকটি চক্র বৈধভাবে যা অনুমোদন পায় তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে অর্থাৎ ছয় তলার অনুমোদন নিয়ে ৯-১০ তলা বা আরও বেশি উচ্চতায় বা কোনো খোলা জায়গা না ছেড়ে সমগ্র জমির ওপর ইমারত নির্মাণ করে। তারা একটি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন নিয়ে খেয়ালখুশিমতো অন্য ব্যবহারের জন্য সুবিধামতো ইমারত নির্মাণ করে। কিছু প্রভাবশালী লোকজন এভাবে গর্হিত কাজ করে বাগাড়ম্বর করে। গুলশান-১/২ সার্কেল ও অ্যাভিনিউয়ের দুই ধারে কতিপয় প্রভাবশালী ছয়-সাত তলার অনুমোদন নিয়ে ১৫-২০ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করেছে। এসব ক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছে কর্তৃপক্ষ তথা সরকারও অনেক সময় অসহায়। অনেক সময় এরা এ ধরনের আইনবহির্ভূত কাজ করে বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে রাজউক তথা সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে হয়রানির অভিযোগ তোলে। যে কারণে এত দিন গুলশানে খেলার মাঠের জমিতে নির্মিত ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’ পার্কটি উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। অনেক বিলম্বে হলেও বহুল আলোচিত বিতর্কিত ‘র‍্যাংগস’ ভবনটি ভাঙা সম্ভব হয়েছে, গুলশান সেন্ট্রাল পার্কের জায়গা থেকে ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’ বিনোদনকেন্দ্রটিও উচ্ছেদ হয়েছে। আশা করা যায়, এই প্রক্রিয়ায় অচিরে হাতিরঝিল প্রকল্পের মধ্যে ‘বিষফোঁড়া’ খ্যাত অবৈধভাবে নির্মিত ‘বিজিএমইএ’ ভবনটিও ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে।

সর্বোপরি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যেকোনো স্থানের উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে নেই কোনো সমন্বয়কারী। অনেক ক্ষেত্রে একই মন্ত্রণালয়ের অধীনের সংস্থাসমূহের মধ্যেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ফলে কারও কাছে নেই অনুমোদিত বা অননুমোদিত ইমারতের সঠিক সংখ্যা, ইমারতের প্রকৃত ব্যবহারের তথ্যাবলি এবং কোনো একটি ইমারতেরও As-Built ড্রয়িং। ফলে যখনই ইমারতধস বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে বেকায়দায় পড়তে হয়, হইচই লেগে যায়, উদ্ধারকাজ হয় বিলম্বিত। এই অবস্থায় সর্বমহল থেকে দাবি উঠেছে, পরিকল্পনায় নির্ধারিত ভূমি ব্যবহার ও বিল্ডিং কোড মেনে ইমারত নির্মাণ করার, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পেশাজীবীদের তত্ত্বাবধানে ইমারত নির্মাণের, নির্মিত ইমারতের ব্যবহারের আগে Occupancy Certificate গ্রহণ করার এবং জান-মালের মতো ইমারতের বিমা পদ্ধতি চালু করার। এসব বিষয়াদির প্রায় সবকিছুই বিএনবিসিতে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও উপযুক্ত Administration and Enforcement এর অভাব এবং কোডটির কার্যকারিতা না থাকায় দিন দিন দেশে বাড়ছে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতের সংখ্যা। বিভিন্ন সময়ে নগরের এখানে-ওখানে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ অনেক ইমারত ধসে পড়ে জানমালের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়। পাশাপাশি বিল্ডিং কোড অনুসরণ ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতিরেকে অবৈধ বা অননুমোদিত স্থাপনা উচ্ছেদ বা ভাঙতে গিয়েও ক্রমেই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা, যাতে যখন তখন প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য শ্রমিক-পথচারী।

পরিকল্পনাহীন নগরীর চিত্র

আদালতের হস্তক্ষেপ

২০০৫ সালে সাভারে ‘স্পেকট্রাম গার্মেন্টস’ ও ২০০৬ সালে তেজগাঁওয়ে ‘ফিনিক্স ভবন’টি ধসে পড়ে অনেক মানুষের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে প্রচণ্ড আলোচনা-সমালোচনার মুখে সরকার ইমারত নির্মাণ আইনে সংশোধনী এনে বিল্ডিং কোড প্রণয়ন ও কার্যকরণের ব্যবস্থা করে। অতঃপর বিএনবিসিকে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এখনো কোডটির কার্যকর ব্যবহার শুরু হয়নি এবং তৈরি করা হয়নি কোনো প্রতিষ্ঠানও। এই অবস্থায় ২০০৭ সালে তড়িঘড়ি করে ও বিল্ডিং কোড অনুসরণ ব্যতিরেকে বহুল আলোচিত ‘র‍্যাংগস ভবন’টি ভাঙতে (Demolition করতে) গিয়ে বেশকিছু শ্রমিকের করুণ মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (BLAST), বাংলাদেশ অকুপ্যাশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ফাউন্ডেশন (OSHE) ও সেফটি অ্যান্ড রাইট সোসাইটি যৌথভাবে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন (রিট নং ৭১৮/২০০৮) দাখিল করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে উচ্চ আদালত নিম্নোক্ত নির্দেশনা প্রদান করেন- 

  1. Establish new or designate existing agencies as Code enforcing agency (Authority) with respective areas of jurisdiction for enforcement of the Bangladesh National Building Code, 2006 throughout the country in accordance with the provisions of Chapter 2 (Organization and Enforcement) of Part 2 of the Code within 01 (one) year from the date of receipt of this judgement.
  1. Designate, in the meantime, RAJUK and respective Unnayan Kartripakkha (Development Authority) of all other Municipality Corporation as the respective code enforcing agency (Authority) for enforcement of the Code within 03 (three) months from the date of receipt of this judgement.
  1. Secure immediately compliance with the safety and security provisions of the Code at every level of construction or demolition of buildings and other structures.

Submit progress reports to the Hon’ble Court in complaince with the preceding directions Nos (a), (b) and (c) at the end of every 03 (three) months from the date of receipt of this judgement.

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- মহামান্য আদালতের ওই নির্দেশনা প্রদানের পাঁচ বছরে পরেও আজ অবধি এর একটিও প্রতিপালিত হয়নি। এতে বিল্ডিং কোডের বাস্তবায়নের অভাবে ইমারত নির্মাণের সময় ও ইমারত ধসে পড়ে দুর্ঘটনা অব্যাহত থাকে, আর মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে অসংখ্য অসহায় মানুষ। এই অবস্থায় ‘রানা প্লাজা’ ধসে জানমালের বিশাল ক্ষয়ক্ষতিতে রিট মামলাটির আবেদনকারীরা উচ্চ আদালতে Contempt মামলা করেন। যাতে মহামান্য আদালত এই মর্মে সংশ্লিষ্টদের কারণ দর্শান যে Establish the Code Enforcement Authority as per Chapter 2, Code 1.2 of the Bangladesh National Building Code, 2006 ang further to show cause as to why the respondents should not be directed to secure compliance with the safety and security provisions of the Bangladesh National Building Code, 2006 at every level of construction and demolition of any building..

সরকার ওই কারণ দর্শানোর জবাব প্রদান করত অনতিবিলম্বে বিএনবিসির বাস্তবায়ন ও কার্যকরণে উচ্চ আদালতকে প্রতিশ্রুতি দেন।  

মো. এমদাদুল ইসলাম

প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৫ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top