দুবাই নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুউচ্চ ভবন, বিলাসবহুল ঝা-চকচকে গাড়ি, শপিংমল, বিনোদন কেন্দ্রসহ নান্দনিক সব আয়োজন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিখ্যাত এই শহরেই নির্মিত হয়েছে ব্যতিক্রমী এক ধর্মীয় শিক্ষামূলক পার্ক ‘কোরানিক পার্ক’। বিশে^ এই প্রথম এ ধরনের একটি পার্ক গড়ে তোলা হলো। পার্কটি শুধু মুসলিম নয়, বরং সব ঘরানার মানুষের কাছে ইসলাম ও কোরআনের মহান বাণী ও শিক্ষা পৌঁছে দিতেই নির্মিত হয়েছে। কোরানিক পার্ক এলে ভ্রমণপিয়াসুরা বিনোদনের পাশাপাশি জানতে ও দেখতে পারবে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন বাণীর শৈল্পিক উপস্থাপন।
বিস্ময়জাগানিয়া এ পার্কটির উদ্বোধন করা হয় ২৯ মার্চ, ২০১৯। এ পার্কটি গড়ে তুলতে সর্বমোট ব্যয় হয়েছে ৫০০ মিলিয়ন দিরহাম বা ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা (১ দিরহাম = ২৩ টাকা ধরে)। অফিশিয়াল তথ্যানুযায়ী, উদ্বোধনের পর প্রথম সপ্তায় পার্কে ভ্রমণ করেছিল প্রায় ১ লক্ষ দর্শনার্থী। আর এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। পার্কটির অবস্থান দুবাইয়ের আল-কাউয়ানিজ এলাকায়, যেটি দুবাইয়ের হর্টিকালচার হার্টল্যান্ড নামে পরিচিত। কোরানিক পার্ক এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যেন মুসলিম কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীরা পবিত্র আল-কোরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কিত অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে পারে। দুবাই মিউনিসিপ্যালটির ডিরেক্টর জেনারেল দাউদ আল হাজরির মতে, কোরানিক পার্ক ইসলামিক সংস্কৃতি ও মানবসভ্যতার ভূমিকা উন্নয়নে প্রভূত সাক্ষ্য বহন করবে। কুরআনিক পার্ক গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্ম-বর্ণের মানুষের সঙ্গে বিজ্ঞান-সংস্কৃতির সেতুবন্ধ সৃষ্টি করা।

৬৪ একরজুড়ে বিস্তৃত এ পার্ক। অপূর্ব পরিকাঠামো, বিপুল পরিমাণ ভিন্ন ঘরানার স্পেস যার মধ্যে রয়েছে গ্লাস হাউস, দুটি বেবি প্লে-গ্রাউন্ড, একটি আউটডোর থিয়েটার এবং একটি কেভ অব মিরাকল। রয়েছে একটি অপূর্ব লেক, যার মধ্য দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে মনুষ্য হাঁটাপথ; যদি আপনি একজন ভাগ্যবান দর্শনার্থী হয়ে থাকেন লেক তথা ঝরনার মোহিনী রূপ উপভোগ করতে করতে হেঁটে যাবেন দৃষ্টিনন্দন এই ওয়াকওয়ে ধরে। আর আপনি যদি সেলফি-ভক্ত হন তাহলে তো কথাই নেই! ঝটপট করে কয়েকটা সেলফি তুলতে পারেন। তবে সাবধান, খুব বেশি বাতাস প্রবাহ থেকে; জোরালো বাতাসে লেক থেকে পানি ছিটকে এসে ভিজিয়ে দেবে আপনাকে। আরও রয়েছে ডিজার্ট গার্ডেন, অ্যা পাম ওয়াসিস। রয়েছে ওয়াই-ফাই এবং ফোন চার্জিং স্টেশন, যেখানে বসার সুব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
কোরানিক পার্কে রয়েছে কিয়স্ক যেখানকার ডিসপ্লেতে কোরআনে উল্লিখিত বৃক্ষগুলোর বিভিন্ন তথ্য প্রদর্শিত হয়। বৃক্ষ, বৃক্ষসমূহের ফল খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের বিভিন্ন উপকারিতা, ঔষধি হিসেবে এসব বৃক্ষের কার্য সম্পাদন পদ্ধতি; কোন কোন অসুখে সেসব প্রয়োগ করা যায়সহ প্রদর্শন করা হয় সেই সম্পর্কিত মূল্যবান সব তথ্য। পার্কের দুটি প্রধান আকর্ষণের একটা হলো, গ্লাস হাউস, যাতে ২৯টি ভিন্ন ঘরানার চারা ও গাছ রয়েছে। যাদের উল্লেখ রয়েছে কোরআন ও সুন্নাহতে। যেমন: দারুচিনি, জলপাই, মরিচ, রসুন, পেঁয়াজ, গম, আদা, কুমড়া, তরমুজ, তেঁতুল, আঙ্গুর, কলা, ডুমুর, ডাল, ভুট্টা, বার্লি, শসা, আম, তুঁত এবং বিভিন্ন মসলার উদ্ভিদসহ জানা-অজানা নানা উদ্ভিদ। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ৫৪ প্রজাতির মধ্যে ৩৫টি পার্কের অভ্যন্তরে প্রদর্শিত হচ্ছে। অবশিষ্ট ১৫টি প্রদর্শিত হচ্ছে গ্রিন হাউজে এবং আরো ২০টি প্রজাতি পার্কের বাইরে প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রতিটি উদ্ভিদের পাশে প্রাথমিক ও অজানা সব তথ্য এবং কোরআন বা সুন্নাহর কোথায় কোন গাছের ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে এ সম্পর্কিত তথ্য। এগুলোকে খুব নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করা হয়। উদ্ভিদগুলো যে ব্রোঞ্জ পোলে রয়েছে, সেখানে নিয়মিত স্প্রে ছিটানো হয়। ইমিটেশন ট্রি ট্রাঙ্কে লুকানো ভেন্টস দিয়ে শীতল বাতাস সরবরাহের মাধ্যমে পোলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়।

পার্কটির অন্যতম আকর্ষণ ‘কেভ অব মিরাকল’ নামে মনুষ্য-নির্মিত গুহা, যাতে পবিত্র কোরআন মজিদে উল্লিখিত ইসলামের কিছু অতুলনীয় মিরাকল বা অলৌকিকতা প্রদর্শন করা হয়েছে। পার্কে ভিন্ন আকর্ষণ হিসেবে আরও রয়েছে রাবার জগিং ট্র্যাক ও সাইক্লিং করার রাস্তা এবং কাছেই রয়েছে জিম ইকুইপমেন্ট, যেগুলোতে ফ্রিতে ওয়ার্ম-আপ করা যায়। ছোট খিদে মেটাতে রয়েছে ‘ওয়ান কফি হাউস’। পার্কের ক্যাফের ঠিক একটু সামনে রয়েছে পিচ্চিদের প্লে-গ্রাউন্ড। বাচ্চাদের ওদিকটাতে পাঠিয়ে দিলে আপনি নিশ্চিন্তে ক্যাফের মেন্যুসমূহ চেখে দেখে উপভোগ করতে পারবেন।
কোরানিক পার্ক খোলে প্রতিদিন স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় আর বন্ধ হয় ঠিক রাত ১০টায়। প্রবেশে কোনো ফি নেই, তবে বর্তমানে ৩ বছরের ঊর্ধ্বের দর্শনার্থীদের জন্য গ্লাস হাউস ও কেব অব মিরাকলে এন্ট্রি ফি ধার্য করা হয়েছে ৫ (১১৫ টাকা) দিরহাম করে। ভ্রমণকারীরা এনওআই (ইলেকট্রনিক টিকিটিং কার্ড) স্মার্ট কার্ড দ্বারাও টিকিটের মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। উল্লেখ্য, ‘কেভ অব মিরাকল’-এর প্রবেশপথের ঠিক বাইরে রয়েছে স্মার্ট কার্ড রিচার্জ স্টেশন।
জাবের রহমান