সবুজের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। সবুজ আনে শীতলতা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মূল রহস্য সবুজকে ঘিরে। সবুজ প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে থাকে মানুষের নানা আয়োজন। আর তাই তো সবুজ প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা দেখাতে সুইজারল্যান্ডের লুসানে নির্মিত হতে যাচ্ছে ১১৭ মিটার উচ্চতার বিশ্বের প্রথম সবুজ ভবন। ভবনটির নকশা করেছেন ইতালির স্থপতি স্টেফেনো বোয়েরি। চিরসবুজ গাছে বেষ্টিত হবে ভবনটি। ৩৬ তলাবিশিষ্ট ভবনটির নাম হবে ‘লা টাওয়ার দ্য সিডারস’ অর্থাৎ দারুগাছের টাওয়ার। ভেতরে ৩ হাজার বর্গমিটার জায়গাজুড়ে থাকবে ১০০টিরও বেশি গাছ, ৬ হাজার ঝোপঝাড় এবং ১৮ হাজার গাছের চারা।
গাছগুলো ভবনটির ভেতরকে বাইরের ঝোড়ো হাওয়া, ধুলা এবং বিভিন্ন দূষণ থেকে সুরক্ষা দেবে ও শহরের সৌন্দর্য বাড়াতে সাহায্য করবে। এটা স্টেফেনো বোয়েরির দ্বিতীয় সবুজ প্রকল্প। এর আগে ইতালির মিলান শহরে একই ধরনের ১১২ মিটার উচ্চতার দুটি টাওয়ারের ডিজাইন করেছিলেন। স্থপতি বোয়েরির লুসানে শহরের এ বাড়িটি চাবানিস-প্রিজ-রিনেন্সে। গাছগাছালি দিয়ে আচ্ছাদিত ‘লা টাওয়ার দ্য সিডারস’ হবে শহরের প্রথম চিরসবুজ বাড়ি। ১১৭ মিটার উচ্চতার এ ভবনে একই সঙ্গে দুই থেকে পাঁচ কক্ষবিশিষ্ট আবাসিক ইউনিট ও অফিস কক্ষ থাকবে। বাড়িটির টপ ফ্লোরে থাকবে জিমনেশিয়াম, প্যানোরামিক বা মনোরম দৃশ্য সংযুক্ত রেস্টুরেন্ট।
প্রাসাদের ছাদেও থাকবে সবুজের সমারোহ। সবুজ গাছ দিয়ে হবে প্রাসাদের ছাদ নির্মাণ। মিলানের প্রাসাদের মতো বালু ও ধূলিকণার ফাঁদ থেকে দেবে সুরক্ষা, কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ কমিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করবে বাড়িটি। গাছের অক্সিজেন আশপাশের দূষিত বাতাসকে করবে নির্মল। এ ছাড়া ভূমিধসেও এই গাছের অক্সিজেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। উদ্ভিদ ও লতাপাতার বৈচিত্র্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধনে তৈরি ভবনটি ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ শহর সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্যে এনে দেবে নতুন এক মাত্রা।

পাখির কিচিরমিচির শব্দে কে না আন্দোলিত হয়? পাখির ভাষাও প্রকৃতির ভিন্ন সুর, ভিন্ন স্বাদ। এ সুরের মূর্ছনায় মেতে ওঠে পরিবেশ। মাতিয়ে তোলে হৃদয়। এ হৃদয়কাড়া সুরের আয়োজনও থাকছে বাড়িটিকে ঘিরে। বিভিন্ন মৌসুমে আগমনী গান গেয়ে পাখিরা মাতাবে মন। গাছের পাতা ও ফুলের পরিবর্তনে বাড়িটির রঙের পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে দূর থেকেই। রঙের খেলায় মেতে উঠবে মন, দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে উদাস মনাদের। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গেই রূপ বদলাবে বাড়িটিও। প্রকৃতির তালে তালে নিজেকেও সাজাবে নতুন সাজে, নতুন রঙে। জেনেভার লেক থেকে বাড়িটি খুঁজে পাওয়া যাবে খুব সহজেই। মধ্য ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ এ শহরের অট্টালিকায় জীববৈচিত্র্য বিরাজ করবে স্থায়ী সৌন্দর্য নিয়ে।
বোয়েরি সাম্প্রতিক সময়ের স্থপতি, যিনি স্থাপত্যের সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশের সমন্বয় করে অক্সিজেনের প্রধান উৎস গাছকে সংযোজন করেছেন। এর আগে স্বল্প পরিসরে ফ্রান্সের স্থপতি জিয়ান নোয়াবেল সিডনিতে প্যাট্রিক ব্লান্স নামের টাওয়ারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসাধনে গাছ সংযোজন করেছিলেন। এ ছাড়া স্থপতি ভো ট্রং নিগিয়া কংক্রিটের সঙ্গে গাছের বেড়ে ওঠার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ভিয়েতনামের হলিডে রিসোর্ট অট্টালিকায়। এই অট্টালিকার সদরের বাইরে ক্ষুদ্র পরিসরে সৌন্দর্যের জন্য সংযোজন করেছিলেন গাছ।
স্টেফেনো বোয়েরি ইতালির উৎসাহ ও অনুপ্রেরণাদায়ক স্থপতিদের তালিকায় স্বমহিমায় নিজের নাম যুক্ত করেছেন প্রাকৃতিক পরিবেশবান্ধব ব্যতিক্রমী এই বাড়ির ডিজাইন করে। তিনি ইটের বুকে সবুজের সম্মিলন ঘটিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়েছেন। বোয়েরির ভার্টিকাল সিরিজেরই অংশ সুইজারল্যান্ডের এই দারু অট্টালিকার নকশাকৃত বাড়িটি। সুইজারল্যান্ডের হাজারো অট্টালিকার মাঝে ইটের বুকে সবুজের আচ্ছাদিত এই ভবনটি নির্মাণ নিয়ে রয়েছে মানুষের প্রবল কৌতূহল ও আগ্রহ।
বন উজাড় থেকে শহরকে সুরক্ষা দিতেই এই দালানগুলো নকশা করার ধারণা আসে স্থপতির। আর এই উপলব্ধি থেকেই তিনি এই সিরিজ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন।বিশ্বের মডেল হিসেবে এই ভবনটি অন্য স্থপতিদের অনুপ্রেরণা জোগাবে নিঃসন্দেহে। তবে মিলানের বাড়িতে ছিল ৯০০ গাছ, ২০০০ চারাগাছ। বোয়েরি মনে করেন, দালানের ঘনত্ব ঠিক রেখে এই শহরের মধ্যে গাছ ও চারার সংযোগ ঘটাতে পারলে কার্বন ডাই-অক্সাইড কিছুটা কমানো সম্ভব। আর তাঁর এই চিন্তা থেকেই মূলত সবুজ অট্টালিকা তৈরির চমৎকার এ পরিকল্পনা।
প্রাকৃতিক এই দৃশ্য নির্মাণে জীববৈচিত্র্যকে নিশ্চিত করা সহজ হবে। পোকামাকড় ও পাখির কলবরে মুখরিত হবে আবাসস্থল। জীববৈচিত্র্যের অন্যতম উপাদান গাছ। তাই জীবের সমারোহ ঘটাতে সহায়তা করবে গাছ। যেথায় বিচরণ করবে নানা প্রজাতির পাখি। দুই বছরের সমীক্ষা শেষে উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞরা এই অট্টালিকায় গাছের কৌশল সংযোজন করেন। শহুরের কিছু নাগরিকের প্রাণ ফিরে আসবে এই অট্টালিকায় বসবাসে।

মারিও বোত্তা আর্কিটেট্টো, রিখটার দালরখা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস আর্কিটেকস ও গোয়েটিস পার্টনারসের মতো আন্তর্জাতিক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় স্টেফেনো বোয়েরি টিকে আছেন নিজের ব্যতিক্রমী ধারণার নকশার নিয়ে। সবকিছু চলছে পরিকল্পনা অনুযায়ী। সুইজারল্যান্ডের বুড়ো হাপল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইতালির লাউরা গাট্রি কোম্পানি যৌথভাবে ২০১৭ সালের মধ্যে শুরু করবেন ‘লা টাওয়ার দ্য সিডারস’-এর নির্মাণকাজ।
মোহাম্মদ রবিউল্লাহ
[email protected]
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭১ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৬