বিশ্বে যানবাহনগুলো যতটা আধুনিক হয়েছে, সে তুলনায় সড়ক পিছিয়ে অনেকটাই। গাড়িতে সংযোজিত হচ্ছে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবস্থা। ভবিষ্যতে হয়তো গাড়ি চলবে আমাদের ইচ্ছে ও চিন্তায়। এর সঙ্গে তাল রেখে সড়কগুলো আধুনিক হবে কি? আমরা কি সড়ক ব্যবস্থাকে স্মার্ট বা বুদ্ধিমান বলতে পারব? প্রযুক্তিবিদদের এ বিষয়ে আশা বেশ ইতিবাচক। গাড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সড়কগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন করা না গেলেও অনেক আধুনিক ও নিরাপদ সড়ক নির্মিত হচ্ছে। যেমন, আপনার উপস্থিতি টের পেয়ে রাস্তায় সংক্রিয়ভাবে আলো জ্বলবে, বৈদ্যুতিক গাড়ি চলতে চলতে যদি ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যায় তবে সড়কেই চার্জ করিয়ে নেওয়া যাবে, বিপজ্জনক জায়গাগুলোতে বার্তা ভেসে উঠবে সহজেই। এসব সুবিধা যখন কোনো সড়ক ব্যবস্থায় থাকবে, তখন নিশ্চয় আমরা তাকে অনায়াসে ‘স্মার্ট রোড’ বলতে পারব।
নেদারল্যান্ডে রাতের আঁধারে পিচঢালা কালো সড়কের ওপর ‘গ্লো মার্ক’ এখন গাড়ি চালকদের জন্য ভালোই পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। মাত্র কয়েক দিন আগে নির্মাতা সংস্থা হেইজম্যান আর ডিজাইন কোম্পানি রুজগার্ডের উদ্যোগে অস্ শহরের এই এন-৩২৯ রাস্তাটি স্মার্ট হাইওয়ের পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। রাতের চালকেরা যেন ভালোভাবে রাস্তাটা অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পান এবং নিরাপদে গাড়ি চালাতে পারেন, এই উদ্দেশ্য নিয়েই এ সড়কের যাত্রা শুরু। আসলে ২০১২ সালে যখন হেইজম্যান ও রুজগার্ড এ ধরনের সড়কের পরিকল্পনা করেন। তখন তাঁরা একটা বিদ্যুৎসাশ্রয়ী কিন্তু গাড়ি চলাচলের সময় প্রয়োজনমতো আলোয় সাড়া দেয়, এমনই একটা সড়কের চিন্তা ছিল তাঁদের মাথায়। তাই তাঁরা বিশেষত রাতে চলাচলের সময় সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে ‘গ্লো ইন দ্য ডার্ক লাইন’, ‘ডাইনামিক পেইন্ট’, ‘ইন্টার-অ্যাকটিভ লাইট’, ‘উইন্ড লাইট’ ও ‘ইন্ডাকশন প্রায়োরিটি লেন’-এর মতো প্রযুক্তিকে সাধারণ সড়কের সঙ্গে যুক্ত করার কথা চিন্তা নিয়ে একটা পরিকল্পনা করেন।

রাতের সড়কে নিরাপদে গাড়ি চালানোর উপযুক্ত আলো নিশ্চিত করতে প্রয়োজন অনেকগুলো সাধারণ বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহার করে রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করা অথবা তুলনামূলকভাবে কম বিদ্যুৎ খরচ হয় এ রকম আলো ব্যবহার করে হাজার হাজার মাইল রাস্তাকে আলেকিত করা। এ দুটির মধ্যে যেকোনো একটি চিন্তা করা যাক না কেন বিদ্যুৎ ও লাইটের মূল্য বিবেচনায় এটা একটা বিশাল খরচের ব্যাপার, সে বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। তার চেয়ে বৈদ্যুতিক লাইট ব্যবহার না করে যদি রাস্তাকে এমন এক ধরনের গাঢ় রং দিয়ে চিহ্নিত করা যায়, যাতে রাতের আঁধারেও রাস্তাটাকে জ্বলজ্বল করতে দেখা যাবে, তাহলে তাতে খরচ অবশ্যই অনেক কমবে বা একটা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থাকবে।
‘গ্লো ইন দ্য ডার্ক রোড’ আসলে এ ধারণারই বাস্তব রূপ। নেদারল্যান্ডের অস্ শহরের হাইওয়েতে এমন এক ধরনের ‘ডাইনামিক পেইন্ট’ বা রং ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে রয়েছে আলোক সংবেদনশীল পাউডার। এই পাউডার সূর্য থেকে আলো সংগ্রহ করে ধরে রাখে এবং রাতের আঁধারে তা বিকিরণ করে। ফলে ৫০০ মাইল দীর্ঘ রাস্তার ওপর সবুজ রঙের এই লাইন সারা দিনে যে আলো গ্রহণ করে, তা দিয়ে রাতের বেলায় আট হতে দশ ঘণ্টা পর্যন্ত আলো বিকিরণ করতে পারে। যদিও এই রঙের ব্যবহার এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়েই রয়েছে। চেষ্টা চলছে আরও উন্নত করার। তারপরও বলতে হয় এটি স্মার্ট রোডের প্রথম পদক্ষেপ।
রাতের আঁধার দূর করার জন্য ‘ডাইনামিক পেইন্ট’ হয়তো-বা যথেষ্ট মনে হয়নি তাঁদের কাছে। তাই তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনায় যুক্ত করেছেন মোশন-সেনসিটিভ ‘ইন্টার-অ্যাকটিভ লাইট’। ইন্টার-অ্যাকটিভ বাতিগুলো এমনভাবে কাজ করে যে যখন আপনার গাড়ি স্মার্ট রোডের কোনো অংশে পৌঁছায়, তখন রাস্তার পাশের লাইটের মোশন-সেন্সর চালু হয় আর শুধু সামনের অংশের লাইটগুলোকে জ্বালিয়ে দেয়। আপনার গাড়িটি যখন সামনের দিকে এগোতে থাকে সঙ্গে সঙ্গে সামনের লাইট পোস্টগুলোর আলো বেশি উজ্জ্বল হতে থাকে আর পেছনের লাইটগুলো ধীরে ধীরে কমতে থাকে। পেছনে কাছাকাছি কোনো গাড়ি না থাকলে তা একসময় একেবারে নিভে যায়।

যেসব রাস্তায় সাধারণত খুব কম যানবাহন চলাচল করে, সেসব রাস্তায় এ ধরনের ইন্টার-অ্যাকটিভ লাইটের ব্যবহার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। কারণ, এই লাইট শুধু গাড়ি চলাচলের সময়ই জ্বলছে বাকি সময় নেভানো থাকছে। ফলে একদিকে যেমন প্রয়োজনমতো আলো দিচ্ছে, তেমনি নেভানো অবস্থায় বিদ্যুৎ অপচয় রোধ করছে। বিষয়টা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো আরকি! ‘ইন্টার-অ্যাকটিভ লাইট’ গাড়ি চলাচলের সঙ্গে সঙ্গে জ্বলা-নেভা করলেও এর রয়েছে বড় এক সীমাবদ্ধতা। একে জ্বালাতে তো বিদ্যুতের প্রয়োজন। তাই সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য বিশেষ করে যেসব জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সহজলভ্য নয়, সেসব জায়গার পরিকল্পনায় যুক্ত হয়েছে ‘উইন্ড লাইট’। উইন্ড লাইটকে জ্বালানোর জন্য আলাদা বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজন হবে না। লাইটের সঙ্গে যুক্ত ছোট্ট একটা জেনারেটর প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। আর এই জেনারেটর চলবে বাতাসে। রাস্তার ধারে বসানো থাকবে এসব লাইটপোস্ট। রাস্তা দিয়ে যখন কোনো গাড়ি যাবে, তখন যে বাতাস গাড়ির পাশ দিয়ে ছড়িয়ে যাবে তা-ই জেনারেটরের প্রপেলারকে ঘুরিয়ে দেবে, ফলে তৈরি হবে বিদ্যুৎ। আর এই ছোট্ট জেনারেটরের উৎপাদিত অল্প বিদ্যুৎ দিয়েই জ্বলবে ‘উইন্ড লাইট’।
আবার যেসব রাস্তায় অনেক বেশি বৈদ্যুতিক যান (Electric Vehicles) চলাচল করে, সেসব রাস্তার জন্য থাকবে আরও একটি মজার সুবিধা। রাস্তায় একটা নির্দিষ্ট লেন থাকবে, যাকে বলা হচ্ছে ‘ইন্ডাকশন (ইলেকট্রিক) প্রায়োরিটি লেন’। এই লেন দিয়ে বৈদ্যুতিক যান চলাচল করলে চলার সময়ই তাতে চার্জ করে নিতে পারবে। এসব ইন্ডাকশন প্রায়োরিটি লেনে এমনভাবে ম্যাগনেটিক ফিল্ড সংযুক্ত করা থাকবে, যেন কোন চলন্ত বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি সহজেই চার্জ হয়ে যায়। ফলে দীর্ঘ যাত্রার জন্য চার্জিং স্টেশনের হিসাব করে রাস্তা ব্যবহার করতে হবে না। অথবা বারবার গাড়ি থামিয়ে সময় নষ্ট করে গাড়িতে চার্জ দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। যেসব দেশে প্রচুর বৈদ্যুতিক যান ব্যবহৃত হয় (যেমন-নেদারল্যান্ড), সেসব দেশের জন্য এ ধরনের রাস্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রোডের উন্নয়ন নিয়ে যে শুধু হেইজম্যান বা রুজগার্ডরাই ভাবছেন তা কিন্তু নয়। এঁদের পরিকল্পনাতে না থাকলেও অনেকেই ভাবছেন কীভাবে রোড থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করে রোডের লাইট জ্বালানোর পাশাপাশি অন্য কাজেও ব্যবহার করা যায়। তাই ‘ইন্ডিয়েগো’ প্রজেক্টের ইঞ্জিনিয়াররা বানাতে চাইছেন সোলার রোডওয়ে। এ প্রজেক্টে তাঁরা রোডটি বানাতে চান কাচ দিয়ে, আর তার নিচে থাকবে সোলার প্যানেল, এলইডি ও মাইক্রোপ্রসেসর। তাঁদের যুক্তি, কাচ নবায়নযোগ্য, পরিবেশবান্ধব এবং একে লোহার চেয়েও শক্ত করে তৈরি করা সম্ভব। তা ছাড়া কাচকে এমনভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব যে এর ওপর দিয়ে ৮০ মাইল গতিতে চলা একটি কার খুব সহজেই থেমে যেতে পারে ঠিক যেভাবে সাধারণ রোডে থামতে পারে। তাই রোডের উপরিভাগ কাচ দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে। তাঁদের মতে, শীতকালে যেসব এলাকায় তুষারপাত হয়, সেসব এলাকার জন্য এই সোলার রোডওয়ে আরও উপযুক্ত। কারণ, এটি নিজের তৈরি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে রাস্তার ওপরের তুষার সহজেই গলিয়ে ফেলতে সক্ষম। তা ছাড়া উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ তো অন্য প্রয়োজনে যেমন, বাতি জ্বালানো, ঘর গরম করা ইত্যাদি কাজে তো ব্যবহার হচ্ছেই।
কাজেই সড়কগুলো হয়তো আর আগের মতো আমাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার একটা প্রাণহীন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হবে না। এর বিশাল উন্মুক্ত স্থান প্রযুক্তির ছোঁয়ায় রাতারাতি জীবন্ত হয়ে না উঠলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যথেষ্ট নিরাপদ, বুদ্ধিমান ও করিৎকর্মা হয়ে উঠবে, এ আশা তো আমরা করতেই পারি।
আবু সুফিয়ান
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৬ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৬