তামা-কাঁসার ভাস্কর্য
প্রাচীন ঐতিহ্যের চমকপ্রদ নিদর্শন

বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন তামা-কাঁসাশিল্প, যা আজও সাভারের ধামরাইয়ে স্বল্প পরিসরে হলেও টিকে আছে। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ধামরাইয়ের কাহেতপাড়া এলাকায় তৈরি হয় প্রাচীন সভ্যতার আদলে নির্মিত তামা-কাঁসার ভাস্কর্য, যা এ দেশের সীমানা পেরিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে পৃথিবীর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পর্যটকদের। বিশেষত ফ্রান্স, জার্মানিসহ বহু দেশের পর্যটক এমন সব ভাস্কর্য সংগ্রহ করতে ধামরাই আসেন, সাগ্রহে সংগ্রহ করেন প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যমন্ডিত তামা-কাঁসার হস্তশিল্পের ভাস্কর্য। তামা-কাঁসার ভাস্কর্য তৈরির পেশাটি বহু প্রাচীন। ধারণা করা হয়, আনুমানিক ৩০০ বছর আগে এ অঞ্চলে এর প্রসার ঘটে। বংশপরম্পরায় শুরুর উত্তরসূরিরাই এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তবে কালের বিবর্তন ও মানুষের চাহিদার সঙ্গে যা হয়েছে পরিবর্তিত। ব্যবসা মন্দার কারণে তামা-কাঁসাশিল্পীদের অনেকেই বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পেশা। শিল্পটি এখন পড়েছে অস্তিত্বের সংকটে।

তামা-কাঁসার ভাস্কর্য তৈরিতে যে পদ্ধতিটি অবলম্বন করা হয়, তা ‘মোম পদ্ধতি’ নামে পরিচিত। প্রথম ধাপে মোম দিয়ে ভাস্কর্যটি প্রস্তুত করা হয়, এরপর সেই মোমের ভাস্কর্যটিতে মাটির পাতলা প্রলেপ দেওয়া হয়। এই প্রলেপটি শুকানোর পর দ্বিতীয়বার মাটির পাতলা প্রলেপ দেওয়া হয়। এভাবে দেওয়া হয় চার থেকে সাতটি প্রলেপ। প্রলেপটির গাঢ়ত্ব নির্ভর করে ভাস্কর্যটির ওজনের ওপর। অর্থাৎ ভাস্কর্যটির ওজন বেশি হলে প্রলেপের পরিমাণও বেশি হয়। মাটির প্রলেপের এই পর্যায়টি সম্পন্ন করতে প্রায় ১২ থেকে ১৪ দিন সময় লাগে। এরপর তৃতীয় ধাপে প্রলেপ শুকানোর পর তা আগুনে পোড়ানো হয়। আগুনে পোড়ানোর কারণ মূলত প্রলেপের ভেতরে থাকা মোমকে গলিয়ে ফেলা। চতুর্থ ধাপে এই শুকনো মোমবিহীন মাটির কাঠামোটি একটি ফর্মা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরে মাটির ভাস্কর্য আকৃতির কাঠামোটিতে গলিত তামা ঢেলে দেওয়া হয়, যা প্রকৃতির নিয়মেই কিছুক্ষণের ভেতর ভাস্কর্যের আকৃতি ধারণ করে। এরপর শিল্পীর হাতের ছোঁয়ার প্রতিটি ভাস্কর্য রূপ নেয় জীবন্ত প্রতিকৃতিতে। 

তামা-কাঁসার নান্দনিক ভাস্কর্য

নান্দনিক এসব ভাস্কর্যের মূল্য প্রায় এক হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। এসব ভাস্কর্যের মূল্যের তারতম্য নির্ভর করে বিশেষত কারুকার্য ও আকার-আকৃতির ওপর। তামা-কাঁসার দক্ষ এ শিল্পীরা ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী তৈরি করে দিতে পারেন যেকোনো আকৃতির ভাস্কর্য। বলাবাহুল্য, হাতে তৈরি এসব ভাস্কর্য প্রতিটিই স্বতন্ত্র প্রকৃতির। প্রতিটি সৃষ্টিই যেন এক-একটি প্রাচীন গল্প আর ইতিহাসের সাক্ষ্যবাহী। কোনোটি আর্য সভ্যতার, কোনোটি প্রাচীন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের, কোনোটি আবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেব-দেবীর ভাস্কর্য। প্রাচীন ইতিহাসবাহী এসব ভাস্কর্য আপনার গৃহশয্যায় যোগ করবে ভিন্ন ও নতুন এক মাত্রা।

প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক তামা-কাঁসার ভাস্কর্যশিল্পটি। খাতটিতে সরকারের তরফ থেকে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে যদি দেশের বিত্তবান উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন, তবে তা দেশের সুনাম অর্জনের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।  

শিপলু খন্দকার

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৯ তম সংখ্যা, মে ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top