রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বাড়ির ছাদে করা বাগান ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অধিকাংশ বাড়ির ছাদে এখন বিভিন্ন ধরনের বাগান দেখা যায়। যেসব বাগান গড়ে উঠছে তার অধিকাংশই অপরিকল্পিতভাবে। ইচ্ছে করলেই শহরবাসী ফলের বাগান বা সবজির বাগান করতে জায়গা পান না। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বিকল্প আয়ের উৎস হতে পারে ছাদে করা বাগান।
ছাদে বাগান তৈরিতে ছাদের কোনো ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক আবু সুফিয়ান কুশল জানান, ‘ছাদে ছোট আকারের বাগান করলে ছাদের কোনোই ক্ষতি হয় না। তবে খেয়াল রাখতে হবে, বাগানের গাছ পানিতে যেন পচে না যায়। তাহলে ছাদ স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাবে। আর যদি বড় পরিসরের বাগান তৈরির ইচ্ছা থাকে, তাহলে অবশ্যই বিল্ডিং নির্মাণের সময় সেই অনুযায়ী ছাদ নির্মাণ করতে হবে।’
বাগানের রকমফের
ছাদে দুইভাবে বাগান করা যায়।
১. কাঠ বা লোহার ফ্রেমে এঁটে বেড তৈরির মাধ্যমে।
২. অন্যটি হলো টব, ড্রাম, পট কনটেইনার ব্যবহার করে।
প্রথম ক্ষেত্রে পুরো ছাদ বা ছাদের অংশবিশেষ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্নিশের পাশে বা আলাদা ফ্রেম করে সুন্দরভাবে ডিজাইন করে সেটিং করা যায়। ফ্রেম তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় কাঠ, লোহা, স্টিল, মোটা রাবার। তবে যা দিয়ে যেভাবেই বেড তৈরি হোক না কেন, তিন-চার বছর পর পুরো বেড ভেঙে নতুন করে তৈরি করতে হয়। এতে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ছাদে বাগান করার শুরুতেই মাটিকে ফরমালডিহাইড দিয়ে (প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ১০০ মিলিলিটার ফরমালডিহাইড) শোধন করে নিতে হয়। মাটি শোধনের কৌশল হিসেবে প্রয়োজন অনুযায়ী মাটি নিয়ে বর্ণিত মাত্রায় ফরমালডিহাইড মিশ্রিত পানি মাটিতে ছিটিয়ে দিয়ে পুরো মাটিকে মোটা পলিথিন দিয়ে তিন-চার দিন ঢেকে রাখতে হবে। পরবর্তী তিন-চার দিন পলিথিন উঠিয়ে সূর্যের আলোয় খুলে রাখতে হবে। এতে মাটি বাগানের জন্য ব্যবহারের উপযোগী হবে।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ড্রাম, বালতি, টব, কনটেইনার এসবের যেকোনো একটি বা দুটি নির্বাচন করার পর পাত্রের তলায় কিছু পরিমাণ ইটের খোয়া দিতে হবে। এ ক্ষেত্রেও অর্ধেক মাটি এবং অর্ধেক পচা জৈব সার মেশাতে হবে। শাকসবজি, ফুলের জন্য ছোটখাটো টব বা পাত্র হলেও চলে। কিন্তু ফলের ক্ষেত্রে পাত্র-ড্রাম যত বড় হয়, তত ভালো। কেননা ফলগাছের শিকড় প্রকৃতিগতভাবে বেশ গভীরে যায়। কিন্তু ড্রাম, টব, পাত্রের সীমিত জায়গার অভাবে বাগানের গাছ যথাযথভাবে বিস্তার লাভ করতে পারে না।
বিশ্বের অনেক দেশে এখন ছাদে বাগান করা সে দেশের সিটি করপোরেশনের বাধ্যতামূলক আইন। শহরের ইট-পাথর যেন সবুজের স্পর্শ পায়, তাই কেউ কেউ ছাদে বাগান করছেন। কিন্তু নির্মল পরিবেশের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় যা একবারেই অপ্রতুল।
গাছের প্রজাতির ওপর নির্ভর করে গাছটি ছাদে করা বাগানের জন্য তা হাফ ড্রাম, টব নাকি চৌবাচ্চা কাঠামো করে লাগানো হবে এবং এসব গাছের জন্য পরিচর্যার ধরন কী হবে, তা আগেই ঠিক করে নিতে হবে। খোলামেলা ছাদে এটা সম্ভব। স্থায়ী বাগান করার জন্য ছাদে সিমেন্টের স্থায়ী টব তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে।
তিন ভাগ মাটি, দুই ভাগ গোবর সার আর এক ভাগ পাতা পচা সার দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে টব পূর্ণ করতে হবে। বর্ষার আগে আগে টবে চারা কলম লাগাতে হবে। এই টবে ফুল, ফল, সবজির চাষ করা যেতে পারে। ফুলের মধ্যে গোলাপ, গাঁদা, দোলনচাঁপা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ইউফোরবিয়াসহ মৌসুমি সব ফুলেরই চাষ করা যায়। ছাদবাগানে সবজিও ফলাতে পারেন। বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মরিচ, শসা, লাউ, কুমড়া, ঢেঁড়শ, বরবটি, সিম, ক্যাপসিকাম, লেটুসপাতা, পুদিনাপাতা, ধনেপাতাসহ প্রায় সব ধরনের সবজি টবে ফলানো সম্ভব। ফলের মধ্যে আম, জাম, লিচু, শরিফা, সফেদা, কামরাঙ্গা, বাতাবিলেবু, জলপাই, কদবেল, ডালিম, পেয়ারা, কমলা, মালটা, কুল ছাদবাগানকে আকর্ষণীয় ও অনন্য করে তোলে। আজকাল অনেকেই ছাদে বাগান করার জন্য এগিয়ে আসছেন।
ছাদে যে ধরনের গাছ লাগাবেন
ছোট আকারের গাছ লাগাতে হবে এবং ছোট আকারের গাছে যাতে বেশি ফল ধরে সে জন্য হাইব্রিড জাতের ফলদ গাছ লাগানো যেতে পারে। আম্রপালি ও মল্লিকা জাতের আম, পেয়ারা, আপেল কুল, জলপাই, করমচা, শরিফা, আতা, আমড়া, লেবু, ডালিম, পেঁপে, এমনকি কলাগাছও লাগানো যাবে।

ছাদে বাগানের প্রথম শর্ত হচ্ছে, গাছ বাছাই। বীজের চারা নয়, কলমের চারা লাগালে অতিদ্রুত ফল পাওয়া যায়। আজকাল বিভিন্ন ফলের গুটি কলম, চোখ কলম ও জোড় কলম পাওয়া যাচ্ছে। টবে আমের মধ্যে আম্রপালি, আলফানসো, বেঁটে প্রজাতির বারোমেসে, লতা, ফিলিপাইনের সুপার সুইট, রাঙ্গু আই চাষ করা যেতে পারে। লেবুর মধ্যে কাগজিলেবু, কমলা, মালটা, নারকেলি লেবু, কামকোয়াট, ইরানি লেবু, বাতাবি লেবু (অ্যাসেম্বল) টবে খুবই ভালো হয়। এ ছাড়া কলমের জলপাই, থাইল্যান্ডের মিষ্টি জলপাই, কলমের শরিফা, কলমের কদবেল, ডালিম, স্ট্রবেরি, বাউকুল, আপেলকুল, নারিকেলকুল, লিচু, থাইল্যান্ডের লাল জামরুল, গ্রিন ড্রপ জামরুল, আপেল জামরুল, আঙুর, পেয়ারা, থাই পেয়ারা, ফলসা, খুদে জাম, আঁশফল, জোড়া কলমের কামরাঙা, এমনকি ক্যারালা ড্রফ প্রজাতির নারিকেলের চাষ করা যেতে পারে। সঠিক মানের চারা হলে এক বছরের মধ্যেই ফল আসে। আজকাল বিদেশ থেকে উন্নত মানের কিছু চারা কলম দেশে আসছে। ছাদবাগানের সাধ পূরণ করার জন্য এসব সংগ্রহ করে লাগানো যেতে পারে। বাহারি পাতার জামরুল, পেয়ারা, সফেদা গাছও বিভিন্ন নার্সারিতে এখন কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। ছাদে এসব গাছ লাগানো হলে ছাদবাগানের সৌন্দর্য অনেক বেড়ে যায়।
গাছ লাগাবেন যেখানে
টব
দরকারমতো সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টব সরানো যায়। ছাদের টবে গাছ লাগানো অনেকেই পছন্দ করেন। টবে সার মাটি দেওয়া খুব সহজ। অনেকেই পোড়ামাটি এবং প্লাস্টিকের টব ব্যবহার করেন। টবে গাছ লাগানোর সময় মনে রাখতে হবে যেন ওই গাছ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টবের অল্প মাটিতে ওই গাছের খাদ্যপুষ্টি থাকে।
হাফ ড্রাম
বড় আকারের ড্রামের মাঝামাঝি কেটে দুই টুকরো করে বড় দুটি টব তৈরি করা যায়। বড় জাতের এবং ফলের গাছের জন্য হাফ ড্রাম ভালো। এগুলো সরাসরি ছাদের ওপর না বসিয়ে কয়েকটি টুকরো ইটের ওপর বসানো ভালো।
চৌবাচ্চা
ছাদে এক থেকে দেড় ফুট উঁচু এবং তিন থেকে চারটি পিলারের ওপর পানির ট্যাংক বা চৌবাচ্চা আকারের রিং স্ল্যাব বসিয়ে ইটের টুকরো এবং সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে স্থায়ী চৌবাচ্চা তৈরি করা যায়। এ ধরনের চৌবাচ্চায় মাছ এবং জলজ উদ্ভিদ চাষ করে ছাদের পরিবেশ সুন্দর রাখা যায় সহজেই।
স্থায়ী বেড পদ্ধতি
ছাদের কোনো অংশে স্থায়ী বাগান করতে চাইলে সুবিধামতো আকারের স্থায়ী বেড তৈরি করা যায়। তবে চার ফুট দৈর্ঘ্য, চার ফুট প্রস্থ এবং দুই ফুট উচ্চতার বেড তৈরি করা ভালো। এ ধরনের বেড তৈরি করতে নিচে পুরু পলিথিন দিয়ে ঢালাই করলে ছাদ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
টব সম্পর্কিত তথ্য
ফুল কিংবা ফল গাছ যা-ই হোক না কেন, টব ব্যবহার করার সময় লক্ষ রাখতে হবে, গাছের আকার কত বড় হবে। সেই মতো টবের আকার নির্ধারণ করা দরকার। পানি গড়িয়ে যাওয়ার জন্য টবের নিচে ছিদ্র থাকতে হবে। ছিদ্রের ওপর নারকেলের ছোবড়া বা ইটের টুকরো দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। যে গাছের চারা লাগানো হবে তা সাধারণ পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। এর ফলে রোগের সংক্রমণ অনেক কমে যায়। চারা কেনার সময় অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের চারা সংগ্রহ করা দরকার। গাছ বড় হলে প্রয়োজনে বড় টবে সাবধানে চারা স্থানান্তর করে নেওয়া যায়। তবে টব ভেঙে চারাগাছ বের করা ঠিক না।
টবের সার-মাটি
টবের গাছের খাদ্যপুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য মাটিতে দরকারি সার মেশাতে হবে। মাটি, গোবর সার, কম্পোস্ট, পচা পাতা, পরিমাণমতো রাসায়নিক সার মেশাতে হবে। শুকনো দূর্বা ঘাস টবের মাটির মাঝামাঝি দিয়ে তার ওপরে মাটি দিয়ে চারাগাছ লাগানো ভালো।
গাছ বা চারা নির্বাচন করে ছাদে বাগান করা যতটা না বাণিজ্যিক, তার চেয়ে বেশি নান্দনিক এবং শখের। উদ্দেশ্য যা-ই থাক, জাত নির্বাচনে সতর্ক সচেতনতা জরুরি। জমিতে যেভাবে চাষ করা যায় ছাদে সেভাবে করা যায় না। গাছ ছাদে সাধারণভাবে বাড়ার জন্য তেমন জায়গা পায় না। সে জন্য অতিরিক্ত যতœ নিশ্চিত করতে হবে। তবে ছাদের বাগানে কখনো ঝোপ, ঝাড়, বাঁশ টাইপের কোনো বড় গাছ না লাগানোই ভালো।

আমাদের দেশের আবহাওয়ায় কোনো গাছে পোকা বা রোগের আক্রমণ অহরহ হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রতিদিন দু-তিন বার যদি ছাদের বাগান পরিদর্শন করা যায় তাহলে বালাই আক্রমণ যেমন কম হবে তেমনি ফসলও পাওয়া যাবে অনেক। যদি হঠাৎ বেশি মারাত্মক আক্রান্ত হয়ে যায় তখন উপযুক্ত বালাইনাশক সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে হবে।
ছাদ বাগানের কিছু টিপস
- লম্বা গাছকে ছোট গাছকে সামনে রাখতে হবে।
- টবে বা ফ্রেমে খৈল দেওয়া যাবে না, এতে পিঁপড়ার উপদ্রব বাড়তে পারে।
- বাজার থেকে কেনা প্যাকেটজাত কম্পোস্ট সার ব্যবহার করা ভালো।
- বছরে একবার নতুন মাটি দিয়ে পুরোনো মাটি বদলে দিতে হবে। এটি অক্টোবর মাসে করলে ভালো।
- ছাদে বাগানের জন্য মিশ্র সার, গুঁটি ইউরিয়া, খৈল, হাড়ের গুঁড়া পচিয়ে ব্যবহার করা ভালো।
- স্টিল লোহার ফ্রেম ছাদে বাগান তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- অবস্থা বুঝে গাছের গোড়ায় চুনের পানি সপ্তাহে একবার ব্যবহার করুন।
তানজিনা আফরিন ইভা
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪০ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৩