নির্মাণে চাই সচেতনতা

ডিপ্লোমা শেষ হওয়ার আগেই বিদেশে ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ আসে। পরিবারের সবাই তাঁকে বিদেশেই পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন দেশে থেকে স্বাধীনভাবে কিছু করতে। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা শেষ করে গড়ে তোলেন টোটাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন। এর আগে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছিলেন আল হেলাল। তাঁর এক ভাই পড়তেন অনার্সে কিন্তু সেশনজটের কারণে শিক্ষাবর্ষ শেষ করতেই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত কয়েক বছর লেগে যায়। এতে তিনি অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়েন। সেই ভাইয়ের পরামর্শে তিনি উৎসাহী হয়েছিলেন কারিগরি শিক্ষায়। যদিও এটা তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা; নতুন পরিবেশ। সে চ্যালেঞ্জটি তিনি বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই সম্পন্ন করেন। নিজের গড়া টোটাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। রাজধানীর মিরপুর-১-এ মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সে অবস্থিত এই নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি।

বন্ধন-এর নিয়মিত আয়োজন ‘প্রকৌশলীর গল্প’ পর্বে এ নির্মাণশিল্পীর গল্প তুলে ধরছেন মাহফুজ ফারুক

প্রকৌশলী আল হেলাল ১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল নাটোরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. খাইরুল ইসলাম ও মা মোছা. আলেয়া বেগম। তিনি ২০০২ সালে জোনাইল এমএল উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ২০০৪ সালে জোনাইল ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি ২০০৯ সালে পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা এবং ২০১৩ সালে ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি টুডি-থ্রিডি ডিজাইন করতেন। পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাইয়ের কনসালট্যান্সি ফার্মে বেশ কিছুদিন প্রকৌশল চর্চাও করেছেন। এরপর যোগ দেন চাকরিতে। অ্যাসেট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড হোল্ডিংস লি., রূপায়ণ গ্রুপ, মদিনা গ্রুপ, জিকে বিল্ডার্স প্রভৃতি স্বনামধন্য ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে গড়ে তোলেন নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন ফার্ম। সঙ্গে সহযোগী হিসেবে নেন ডুয়েটের কয়েকজন জুনিয়রকে। আর সেই ফার্মটির মাধ্যমেই সুনামের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রকৌশল চর্চা ও নির্মাণ কর্মকান্ড।

ডুপ্লেক্স, টাঙ্গাইল

দেশের প্রথম সারির ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার ফলে নির্মাণজগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন প্রকৌশলী হেলাল। এই খাতে তিনি হয়ে ওঠেন পরিচিত মুখ। অনেকের সঙ্গেই তাঁর জানাশোনা হয়। ফলে ব্যক্তিগতভাবে ফার্ম প্রতিষ্ঠার পরপরই রাজধানীর মিরপুরে বেশ কিছু বহুতল ভবনের কাজ পেয়ে যান। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তা ছাড়া দীর্ঘদিন মিরপুরে থাকার সুবাদেও পেয়েছেন বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ। তাঁর বন্ধু ও পরিচিতমহলও এ ক্ষেত্রে অনেক সহযোগিতা করেছেন। ফলে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে তিনি নির্মাণ করেছেন একাধিক আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন, শিল্প স্থাপনা, ডুপ্লেক্স প্রভৃতি। পাশাপাশি কনসালট্যান্সিও করছেন। ঢাকার বাইরে মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, টাঙ্গাইল, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় তাঁর ডিজাইনে নির্মিত স্থাপনা রয়েছে। সাভার ও আশুলিয়ায়ও রয়েছে বেশ কিছু প্রকল্প।

রাজধানীতে প্রকৌশল চর্চা ও নির্মাণকাজ পরিচালনা করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। এখানে যেমন রয়েছে অসংখ্য ফার্ম, তেমনি প্রকৌশলীও প্রচুর। ফলে ব্যাপক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে হয়। অধিকাংশ প্রকল্পের কাজে চাঁদাও দিতে হয়। তবে প্রকৌশলী হেলাল তাঁর কর্মদক্ষতা ও পরিচিতির সুবাদে নিজের অবস্থান সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজের ফার্ম শুরুর বছরখানেক পরই দেখা দেয় মহামারি করোনা। অন্যান্য সবার মতো তিনিও ঝুঁকিতে পড়েন। তবে অনিশ্চয়তার ঠিক সে সময়েই এক শুভাকাক্সক্ষীর মাধ্যমে মিরপুরে একটি জায়গা কিনতে সমর্থ হন কয়েকজন অংশীদার মিলে। কিন্তু পুরো টাকা পরিশোধ করার মতো অর্থ তাঁদের হাতে ছিল না। বাধ্য হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে হয়। জমির বিক্রেতা তাঁদের চার মাসের সময় দেন। কিন্তু তাঁরা মাত্র দুই মাসের মধ্যে বাকি শেয়ার বিক্রি করতে সমর্থ হন। আবাসন প্রকল্পটি থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি মুনাফা আসে। এই সাফল্য তাঁদের আরও উৎসাহিত করে নতুন কিছু প্রকল্প গ্রহণ করতে। বর্তমানে এ ধরনের ১০টির বেশি প্রকল্প রয়েছে এ প্রকৌশলীর অধীনে।

স্থাপনা নির্মাণে রাজউক ও বিএনবিসির নিয়ম মেনে ডিজাইন করা ও তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন প্রকৌশলী হেলাল। তা ছাড়া প্রতিটি নির্মাণ উপকরণ ল্যাব ও ফিল্ড পর্যায়ে টেস্ট করেই তবে ব্যবহার করেন। তবে বেশি গুরুত্ব দেন সয়েল টেস্টের ব্যাপারে। এ জন্য তাঁর একটি দক্ষ টিমও রয়েছে। জায়গা, নির্মাণ উপকরণ, শ্রমিক মজুরি, পরিবহনব্যয়সহ প্রতিটি উপকরণের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এ জন্য নির্মাণের ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি। বিশেষ করে ডিজাইনে। অনেক প্রকল্পে দেখা যায় অনভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা ওভার ডিজাইন করেন, যাতে নির্মাণব্যয় বেড়ে যায় বহুগুণে। অনেকে প্রকৌশলী একই ডিজাইন বা কিছুটা পরিবর্তন করে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহার করেন, যা মোটেও সমীচীন নয়। এমনভাবে প্রকল্প করা উচিত যেন ক্লায়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত না হন।

সায়েদুজ্জামান খান, উত্তর বিশিল, ঢাকা

প্রকৌশলীদের নিজ কাজে অনেক যতœবান হওয়া উচিত। কারণ ভুল ডিজাইনে যেমন জীবন ও সম্পদ পড়তে পারে ঝুঁকির মধ্যে, তেমনি নির্মাণব্যয়ও বেড়ে যেতে পারে বহুগুণে। এ জন্য তরুণ প্রকৌশলী ও শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর পরামর্শ, তাঁরা যেন স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের আদ্যোপান্ত আয়ত্ত্ব করেন এবং শিক্ষারত অবস্থাতেই টুডি-থ্রিডি ম্যাক্স ও ডিজাইনবিষয়ক অন্যান্য সফটওয়্যারের কাজ শিখে নেন। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে কাজ করে বাস্তবিক জ্ঞান অর্জন করেন। আর এই কাজে বড় বড় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সহাযোগিতা তিনি কামনা করেন।

টোটাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন যেসব সেবা প্রদান করে থাকে-

আর্কিটেকচারাল ডিজাইন
স্ট্রাকচারাল ডিজাইন
রাজউক প্ল্যান অ্যাপ্রোভাল
হাউজিং ড্রয়িং অ্যাপ্রোভাল
ইন্টেরিয়র ডিজাইন
সয়েল টেস্ট
সাইট সুপারভিশন
থাই গ্লাস অ্যান্ড এসএস ওয়ার্ক
ইলেকট্রিক্যাল ডিজাইন
স্যানিটারি অ্যান্ড প্ল্যাম্বিং ডিজাইন
পাইলিং ওয়ার্ক
এস্টিমেশন অ্যান্ড কস্টিং
ম্যাটেরিয়াল সাপ্লাই
ডিজিটাল সার্ভে
থ্রিডি ভিউ ডিজাইন
রেট্রোফিটিং প্রভৃতি

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৪ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top