ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে শিশুদের খেলার মাঠ। বিশেষত রাজধানীতে। খেলার মাঠের অভাবে তারা বেড়ে উঠছে অন্তর্মুখী আর ঘরকুনো হয়ে; এতে বাড়ছে যন্ত্রনির্ভরতা। অথচ উন্মুক্ত পরিসরে খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক। শিশু মানেই বাঁধ ভাঙা আনন্দে ছোটাছুটি করা চঞ্চল এক চরিত্র। আজকের শিশুরা ভিন্ন এক পরিবেশে বেড়ে উঠছে, যা তাদের পরিচিত করছে ঝিমানো চরিত্রের অধিকারী হিসেবে। স্কয়ারফিটে বন্দী এসব শিশুর শৈশব-কৈশোর। বদ্ধ পরিবেশে মানসিক ও শারীরিক হতাশা নিয়ে বেড়ে উঠছে আগামীর নতুন এ প্রজন্ম।
শুধু ঢাকা নয়, খেলার মাঠের সংকট দেশজুড়ে। অধিকাংশই সংস্কারবিহীন; অবস্থা সঙিন। দেশের বিভিন্ন স্থানে খোলা মাঠের বিশাল পরিসরে একসময় খেলাধুলা হতো। ভূমি জরিপে স্থানগুলো খেলার স্থান হিসেবে উল্লেখিত। এগুলোকে ‘লিজ’ হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্কুল ও কলেজে এখন নিজস্ব খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার মাঠ থাকলেও তা ব্যবহারের কাহিনি মোটেই সুখকর নয়। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বছরে একবার মাঠ ভাড়া করে নিজেদের মধ্যে খেলাধুলার আয়োজনের মাধ্যমে আনন্দ-উৎসব করে থাকে।
বড় শহরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে দেয়ালঘেরা মাঠ, যার পরিচিতি স্টেডিয়াম হিসেবে। এগুলোর হিসাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খাতায় আছে। তবে মফস্বলের ক্রীড়াঙ্গনে ছোট-বড় মাঠের সংখ্যার সঠিক তথ্য নেই কারও কাছেই।

রাজধানীর খেলার মাঠের হালহকিকত
বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় মাঠ দখল করে খেলাধুলা বন্ধ রেখে মাঠ ভাড়া দেওয়ার ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। মাঠসংকটের পাশাপাশি এর অপব্যবহার গুরুতর এক সমস্যা। অপ্রিয় হলেও সত্য, জাতীয় এ সমস্যাটি বরাবরই অবহেলিত ও উপেক্ষিত। আইন বলছে, খেলার মাঠ দখল করে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না, স্কুল-কলেজের খেলার মাঠে গরু-ছাগলের হাট বসানো যাবে না, দেওয়া যাবে না যাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ওয়াজ-মাহফিল কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়াও। পরিবেশ গবেষক ও বাংলাদেশ ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সেফগার্ড (বি-ইয়েস) আহ্বায়ক ম. আব্দুর রহমান রানা জানান, নগরের স্বাভাবিক বসবাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য উন্মুক্ত স্থানের বিকল্প নেই। সাধারণত নগরে ১০ লাখ মানুষের বসবাস হলে তা আশপাশের গ্রামীণ জনপদের চেয়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি ধারণ করে। সে হিসাবে এক কোটি জনসংখ্যার নগর তো রীতিমতো জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড! উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ কিংবা উদ্যান চত্বর পরিবেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম অনুষঙ্গ, যা নগরের তাপমাত্রা হ্রাসে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তা ছাড়া উন্মুক্ত পরিসর কিংবা খোলা মাঠ হতে পারে নগরে বসবাসরত মানুষের জন্য বিশ্রামের জায়গা, হয়ে উঠতে পারে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যম, খেলাধুলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, মানসিক ও দৈহিক সুস্থতার বিকাশস্থল। শিশু-কিশোরদের মানস বিকাশে খেলাধুলার বিকল্প নেই। আর খেলাধুলার জন্য প্রয়োজন খোলা পরিসর তথা উন্মুক্ত খেলার মাঠ। কিন্তু এ সময়ে চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে শিশুরা বেড়ে উঠছে নির্জীব প্রাণ হয়ে। নগরে বসবাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য খোলা জায়গা বা খেলার মাঠের কোনো বিকল্প নেই। এই খোলা জায়গার অভাবে দিন দিন নগর হয়ে পড়ছে বসবাসের অযোগ্য। নগরবাসী মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে বরণ করছে পশুত্বকে।
বিষয়টা যখন গবেষণার
বসবাসরত পরিবেশই মানুষকে প্রভাবিত করে বেশি। ব্যবহার আর প্রাত্যহিক কার্যকলাপে দারুণ প্রভাব ফেলে পরিবেশ। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, শহরের বেশির ভাগ পরিবেশই নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষের দ্বারা। গবেষণা বলছে, শিশুদের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশ অতীব জরুরি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্থপতি জাকিউল ইসলাম ঢাকার শিশুদের ওপর করা গবেষণায় পেয়েছেন সংকেতপূর্ণ তথ্য। গবেষণায় জানা যাচ্ছে, ঢাকার শিশুদের ওপর পরিবেশের বিরূপ প্রভাব কতটা। দেখা যাচ্ছে, ঢাকা শহরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকাগুলোয় ঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না শিশুরা। ঢাকা শহরের ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সী বিভিন্ন এলাকার ১২৫ জন শিশুর ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে দেখা যায়, ঢাকার শতকরা ১৬ জন শিশুর নিজের পাড়ায় কোনো বন্ধু নেই। শতকরা ৩০ জন শিশু বাসার বাইরে পাড়ায় এক মিনিটও খেলাধুলা করে না। শতকরা ১৬ জন শিশু বড়দের সাহায্য ছাড়া একা বাসার বাইরে বের হতে পারে না। বাসার বাইরে খেলাধুলার অভাব শিশুদের মানসিকতায় ফেলে বিরূপ প্রভাব। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া ১৯৬০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২৮টি দেশের ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের ওপর গবেষণা করে দেখাচ্ছে, এখনকার শিশুরা এক মাইল দৌড় শেষ করতে তাদের মা-বাবার (বাবা-মা যখন তাদের বয়সী ছিলেন) চেয়ে ৯০ সেকেন্ড সময় বেশি নিচ্ছে। এর কারণ হিসেবে গবেষকেরা দায়ী করছেন, শিশুদের অতিমাত্রায় ঘরমুখী আর প্রয়োজনীয় খেলাধুলা না করাকে।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পার্কগুলোর বর্তমান অবস্থা
রাজধানীর পার্ক আর মাঠগুলোর কোনোটিতেই হাঁটার পরিবেশ নেই। নেই শিশুদের জন্য খেলার ব্যবস্থা। কোনোটি দখল হয়ে গেছে। কোথাও বসেছে বাজার। কিছু পার্ক সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে এর পুরো অবয়বই। মতিঝিলে বাংলাদেশ বিমান কার্যালয়সংলগ্ন ডিসিসির ছোট পার্কটি ছিল জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত। এখানে ছিল গাছগাছালি। পার্কের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ডিসিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটি পার্কের বেশির ভাগ গাছ কেটে ফেলে। পার্কের পশ্চিমাংশ কয়েক ফুট উঁচু করে মাটি ফেলে চারদিক পাকা করে বাঁধাই করা হয়। পার্কের পূর্বদিকের বাকি অংশ আগের মতো নিচুই থেকে যায়। বাঁধাই করা অংশের পশ্চিম প্রান্তে কিছু অংশ আরও উঁচু করে লাগানো হয় ফুলের গাছ। সরেজমিনে দেখা যায়, পার্কের পশ্চিম প্রান্তে পার্কিং করে রাখা হয়েছে সারি সারি গাড়ি। উত্তরাংশে নিচে ভাসমান দোকানদার চা, বিস্কুটসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছেন, দক্ষিণাংশে পুরোনো বিল্ডিং ভাঙা ইট, সিমেন্ট ও ময়লা-আবর্জনা পড়ে আছে। দর্শনার্থীদের অভিযোগ, সৌন্দর্যবর্ধনের নামে পার্কটির আসল চেহারা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এমন অবস্থা ঢাকা শহরের প্রায় সব পার্কের।
বিশেষজ্ঞ ভাবনা
পড়ার টেবিল থেকে মুখ তুললেই কম্পিউটারের পর্দায় আটকে থাকছে চোখ আজকাল এভাবেই কাটছে শিশুদের আনন্দময় শৈশব। তাদের জীবনে বিনোদন বলতে এটুকুই। ভার্চুয়াল এ জগতের খেলায় সাময়িক আমোদ মিললেও শরীর ও মনে রেখে যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি অবসাদ। এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগী হতে হবে শিশুর অভিভাবককেই।
শিশুদের নিতে হবে খেলাধুলার চর্চা হয় এমন সব জায়গায়। যেখানে আছে মাঠ, আছে খেলার যাবতীয় সুবিধা। শিশুরা খেলবে, দৌড়াবে এতে সতেজ ও প্রফুল্ল হবে ওদের মন। সুঠাম হবে শরীর। বুয়েটের এ সহযোগী অধ্যাপক মনে করেন, খেলার মাঠ না থাকায় শিশুদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত, ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে শিশুদের বিনোদনের পরিসর। বিশেষত শহরের শিশুরা বিনোদনের কোনো স্থানই খুঁজে পায় না। ওরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে ঘরমুখো বিনোদনে। কিন্তু এদের প্রয়োজন ছিল উন্মুক্ত পরিসরে খেলাধুলার, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে হতো দারুণ সহায়ক। হতাশা প্রকাশ করে অধ্যাপক জাকিউল ইসলাম বলেন, ব্যক্তিগত লাভালাভের আশায় মনের অজান্তে পরবর্তী প্রজন্মকে ঘরে বন্ধ করে রাখার সব ব্যবস্থাই পাকা করে রেখেছি আমরা। যার ফলে মানসিক ও শারীরিক হতাশা নিয়ে বেড়ে উঠছে আমাদের আগামী প্রজন্ম।

ফিটনেস ওয়ার্ল্ড হেলথ ক্লাবের জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষক মো. রাসেল জানান, যারা ব্যায়ামাগারে আসে না, সাইকেল চালানো হতে পারে তাদের বিকল্প মাধ্যম। নিয়মিত সাইকেল চালালে শারীরিক বৃদ্ধি দ্রুত হয়। মাংশপেশি হয় সবল, শারীরিক শক্তি-সামর্থ্যও বাড়ে অনেক। এ ছাড়া বাড়ে হাড় ও হাড়ের সংযোগস্থলের শক্তি। চর্বি জমে না পেটে।
এ মুহূর্তে যা করণীয়
ঢাকা শহরের পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত মাঠগুলোকে সংস্কারের মাধ্যমে খেলার উপযোগী করে তুলতে হবে। দেশের অন্যান্য শহরের মাঠগুলোতে নিশ্চিত করতে হবে খেলাধুলার পরিবেশ। গ্রামগঞ্জে একে একে মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে, মাঠ লিজ দেওয়া হচ্ছে, মাঠ কেটে বালু ও মাটি ভরাট করে বসতবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। গ্রামের কোথাও এখন আর মাঠ খুঁজে পাওয়া যায় না। শিশু, কিশোর, যুবক কিংবা ছাত্রছাত্রীরা খেলাধুলা করছে পতিত ফসলি জমিতে, বাগানবাড়িতে কিংবা রাস্তায়। নিয়মিত খেলাধুলা করার মাঠ চলে যাচ্ছে ব্যক্তিমালিকানায়। জমির দাম বাড়ায় সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট চক্র ভূমি অফিসের সঙ্গে যোগসাজশে খেলার মাঠ, পরিত্যক্ত খাল, জমি দখলে নিয়ে মাটি ভরাট করে বিক্রি করছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন; পবার খেলাধুলাবিষয়ক সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শামিম খান টিটু বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেদখল খেলার মাঠগুলো ফিরিয়ে আনতে সরকারকে আমরা চিঠি দিয়েছি। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খেলার মাঠের একটা তালিকা চেয়েছি। সরকারের কাছ থেকে তালিকা পাওয়ার পর আমরা এগুলো উদ্ধারে কাজ শুরু করব। পবার লক্ষ্য হচ্ছে এগুলোকে উদ্ধার করে এ মাঠকে আগামী প্রজন্মের জন্য বরাদ্দ দেওয়া। যাতে সুন্দর পরিবেশে খেলাধুলার সুযোগ পেয়ে আজকের শিশুরা আগামীর মেধাবী এক প্রজন্ম হিসেবে গড়ে ওঠে।
ম শাফিউল আল ইমরান
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৯ তম সংখ্যা, মে ২০১৪