চকবাজার। ৪০০ বছরের পুরোনো এক বাজার। এখনকার ঢাকার পশ্চিম পাশে পুরান ঢাকায় অবস্থান বিখ্যাত এই পাইকারি বাজারটির। মোগল শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত এই বাজার এখন পর্যন্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রকাশিত গ্রন্থানুসারে পাথরে নির্মিত এই বাজারের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন ঢাকার ডেপুটি গভর্নর মির্জা লুৎফুল্লাহ্ হলেও প্রকৃতপক্ষে চকবাজারের যাত্রা শুরু ষোড়শ শতাব্দীতে যখন রাজা মানসিংহ তাঁর রাজদপ্তর ভাওয়ালগড়ে স্থানান্তর করেন। তখন থেকেই এই বাজার তৎকালীন রাজা-বাদশাহদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। রাজা-বাদশাহ্রাই এই বাজারের মূল বণিক হওয়ার কারণে এটি ‘বাদশাহি বাজার’ বা ‘রয়েল মার্কেট’ নামে পরিচিত ছিল।
চকবাজার ছিল মূলত ২০০ বর্গফুটের একটি খোলা চত্বর। একটি রাস্তাকে ঘিরে তার চারপাশে দোকানপাট গড়ে উঠেছিল। চকবাজারকে শুধু বাজার বললে ভুল হবে। কারণ, এটি ছিল মানুষের অন্যতম মিলনস্থল। আশপাশের মানুষ এখানে গল্পগুজব আর আড্ডা দিতে আসত। সূর্যাস্ত দেখতে আসার পাশাপাশি বিভিন্ন উৎসবে সর্বস্তরের মানুষ এখানে একত্র হতো। চকবাজারের এই খোলাচত্বরে জনসমাগম যেমন হতো, তেমনি অপরাধীকে জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতেও এ জায়গাকে ব্যবহার করা হতো। যাতে করে লোকজন সামাজিক আইনকানুন সম্পর্কে সচেতন হয়।
বাজারের আশপাশের রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে বাজারটি সম্প্রসারিত হতে থাকে। ইসলাম খানের সময়ে রাজধানী ঢাকার প্রসার ছিল পশ্চিমে চকবাজার থেকে পূর্বে সদরঘাট পর্যন্ত। ধরা হয় যে ইসলাম খান বাস করতেন চকবাজারের একটি পুরোনো দুর্গে, যা ছিল বর্তমান জেলখানার ভেতরে। এটা অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু রয়ে গেছে দরজাগুলোর নাম, যা দিয়ে এলাকাটিকে চেনা যেত। যেমন ‘পূর্ব দরওয়াজা’ ও ‘পশ্চিম দরওয়াজা’। এ ছাড়া মোগল স্থাপত্যের কিছু নিদর্শনও রয়েছে। যেমন মোহাম্মদী বেগের মসজিদ। শায়েস্তা খানের ছোট কাটরা, চকবাজারের শাহি মসজিদ। শাহ্সুজার বড় কাটরা। এর মধ্যে ছোট কাটরা হচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণে দুটি দরজা দিয়ে আবদ্ধ আয়তক্ষেত্রকার বিশেষ কারুকার্যমণ্ডিত বিশাল ফটক, যার অধিকাংশই এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে বড় কাটরা একটি চতুর্ভুজাকার চত্বরকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে, যার উত্তর ও দক্ষিণে দুটি প্রবেশপথ রয়েছে। এর দক্ষিণ পাশে সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত তিনতলা প্রবেশপথ রয়েছে। অন্য পাশগুলো দ্বিতল এবং অষ্টভুজাকৃতির মিনার দিয়ে পরিবেষ্টিত। চকবাজার শাহি মসজিদ তিন গুম্বুজবিশিষ্ট একটি স্থাপনা। এ সময়কার সবগুলো স্থাপনাই সূ² কারুকার্য ও খিলানবিশিষ্ট। তাই এই বাজারকে লন্ডনের হাইড পার্কের সঙ্গে তুলনা করা হয়।

চকবাজার ও এর আশপাশের এসব মোগল স্থাপনার জন্য এটি তৎকালীন অভিজাত শ্রেণীর কাছে অতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খানের সময়ে পার্সিয়ান, গ্রিক, কাশ্মীরি, আমেরিকান ও পর্তুগিজরা এখানে বাণিজ্য করতে আসত। শুধু তা-ই নয়, এখানকার বিখ্যাত মসজিদ, মাদ্রাসা ও নৌপথে যাতায়াতের সুব্যবস্থার কারণে দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটক, ব্যবসায়ী, সুফি ধার্মিক এবং জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তিরা এখানে জমায়েত হতেন। এ ছাড়া ঈদ, মিলাদুন্নবী ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের সময় এখানে মেলা বসত, বিশাল জনসমাবেশ হতো রংবেরঙের পতাকা, সুসজ্জিত হাতি, উট, পালকি ও সার্কাস পার্টি সহযোগে। বাণিজ্যিক ও সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে সমৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি চকবাজার তখন বিখ্যাত ছিল সর্ববৃহৎ ইফতার বাজার হিসেবে। রমজান মাসে বিকেল হলেই হরেক রকমের মোগলাই খাবার নিয়ে শাহি মসজিদের সামনে বসত বিশাল ইফতার বাজার। এখনো রমজান মাসে চকবাজারে এই ইফতার বাজার বসে, যা দেশখ্যাত। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখনো মানুষ এখানে ভিড় জমায় রজমানের ইফতারির বাজার করতে।
মোগল শাসনের অবসানের পর থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামল থেকে চকবাজারের স্থাপনা ও সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মোগল স্থাপত্যের প্রভাব ধীরে ধীরে মলিন হতে শুরু করে। ডস ও ওয়ালটারের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ৪৬০ ফুট লম্বা, ৪ ফুট উচ্চতা ও ০.৫ ফুট চওড়া একটি দেয়াল দিয়ে বাজারটিকে ঘিরে ফেলা হয়। পূর্বের সেই খোলা চত্বর ধীরে ধীরে দোকানপাঠ দিয়ে ভরে ওঠে। এভাবেই সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে চকবাজারের পূর্বপরিচয় স্তিমিত হতে থাকে।
ব্রিটিশ শাসনামলেও চকবাজার বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে তার পরিচিতি ধরে রেখেছিল। আশপাশের গ্রামের লোকজন চকবাজারে দোকান থাকাকে অনেক লাভজনক মনে করত। তাই তারা চকবাজার ও তার আশপাশের জায়গাগুলোতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ফলে চকবাজার ও তার আশপাশের জায়গাগুলো আরও বেশি ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। অধিক ঘনবসতির কারণে চকবাজারে যাতায়াতের ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে খারাপ হয়। এ ছাড়া মোগল স্থাপনাগুলো হারাতে শুরু করে তাদের ঐতিহ্য। যেমন বড় কাটরা ‘জামিয়া হুসাইনিয়া আশরাফুল’ মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ প্রকল্পের অভাবে ঐতিহ্যবাহী এসব স্থাপনার অধিকাংশেরই আগের সেই দাম্ভিক রাজকীয় ও কারুকার্যময় অবস্থা এখন আর নেই।
১৯৪৭-এর পর পাকিস্তান শাসনামলে চকবাজার আরও বেশি ঘনবসতিপূর্ণ ও কোলাহলপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু যুগের চাহিদা অনুযায়ী চকবাজার তার নিজেকে আর পরিবর্তন করতে পারেনি। ফলে দেশের অন্যান্য জায়গায় চকবাজারের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সবকিছু মিলে চকবাজারের যে ঐতিহ্য ও দেশীয় আমেজ আধুনিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তন হতে শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধের পর চকবাজারের সব অস্থায়ী স্থাপনা পাকা করা হয়। কাঠ ও মাটির বাড়িগুলো ইটের বাড়িতে পরিবর্তিত হতে থাকে। একতলা বাড়িগুলো দ্বিতল ও তিন তলাবিশিষ্ট বাসগৃহে পরিণত হয়। ইটের প্রথম স্থাপনা নির্মিত হয় ১৯৭৪ সালের অগ্নি-দুর্ঘটনার পর। ধীরে ধীরে কংক্রিটের রাস্তার পাশাপাশি মোটরযানের প্রচলন শুরু হয়। মতিঝিল অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। চকবাজারের অপরিকল্পিত বিস্তৃতির দরুন ঢাকার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে চকবাজারের পরিচিতি লোপ পেতে থাকে। চক সার্কুলার রোড থেকে তৈরি অন্যান্য সরু রাস্তা চকবাজারের পরিবেশের আরও অবনতি ঘটায়। ভূমির মূল্য দিন দিন বাড়তে থাকলে ভূমির মালিকেরা ন্যূনতম সেটব্যাক, ফার ও ভিত্তির চিন্তা না করেই বাড়ি নির্মাণ করতে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, নতুন তৈরি স্থাপনাগুলোর আগের স্থাপনাগুলোর রং, উপকরণ ও আকার-আকৃতির কোনো সামঞ্জস্য নেই। কাজেই বর্তমান বহুতল ঘনবসতিপূর্ণ, ঘিঞ্জি চকবাজারের সঙ্গে আগের খোলা চত্বরের রয়েছে বিশাল ফারাক।

শুধু চকবাজারই নয়, আমাদের দেশে এমন আরও অনেক ঐতিহ্য আছে, যা আমাদের অবহেলা আর অযতেœ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই ঐতিহ্যকে হারিয়ে দিন দিন আমরা জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়ছি। খুব সহজ একটি কথা, আমরা আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে কদর করতে জানি না, তাহলে বিশ্ববাসী কেন আমাদের কদর করবে? আজকে আমাদের অবহেলা না থাকলে যে চকবাজার দর্শনীয় এক স্থান হিসেবে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারত, সেই চকবাজার এখন বস্তিতে পরিণত হয়েছে। চকবাজারের বিখ্যাত শরবত উৎসব, কাজিয়া মিছিল, ইফতার মার্কেট হয়তো একদিন ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতেও পারবে না একসময় রাজা-বাদশাহরা বাংলার কোথায় এসে বাণিজ্য করতেন। তাঁদের রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলোই বা কী ছিল? সরকারের একটি দৃঢ় পদক্ষেপ পারে আমাদের এই ঐতিহ্যগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অবিকৃত অবস্থায় বহাল রাখতে হবে। চকবাজারের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এটাই এখন সময়ের দাবি।
খাতুন এ জান্নাত
প্রভাষক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম-৪৩৪৯।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৭ তম সংখ্যা, মে ২০১৩