রাজধানীর পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে রাজধানী ঢাকার ভূ-স্তরের উচ্চতা ৫০ ফুট। আর এই হিসাব অনুযায়ী ভূপৃষ্ঠ থেকে পানির স্তর গড়ে ২১০ ফুট নিচে অবস্থান করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এক গবেষণায় এ তথ্য জানা যায়।
এমতাবস্থায় মাটির নিচ থেকে নিয়মিতভাবে পানি তোলা হলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ঢাকায় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। শুধু লবণাক্ততাই নয়, এর পাশাপাশি ভূগর্ভে পানিশূন্যতার সৃষ্টি হলে রাজধানী ঢাকা ক্রমেই হয়ে উঠতে পারে ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ শহর মত বিশেষজ্ঞদের। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভবন হেলে পড়া এবং সুউচ্চ ভবনে ফাটলের কারণ কিন্তু এটাই। যদিও অনেকের ধারণা এর সঙ্গে ভূমিকম্পের কোনো সম্পর্ক নেই।

বিএডিসির গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ অনুযায়ী, গত বছরের মার্চ-এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ১৫ দিন সারা দেশের প্রায় ২৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। গবেষণামতে, এখনই ঢাকাসহ সারা দেশে মাটির নিচ থেকে পানি তোলা বন্ধ করা না হলে বিপজ্জনক হুমকির মুখে পড়বে ঢাকায় বসবাসরত কোটি মানুষ। সেই সঙ্গে অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের ফলে বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ছয় কোটি মানুষ ও পরিবেশ-প্রতিবেশ।
অন্যদিকে, ঢাকাকে ঘিরে থাকা চার নদীর পানিতে পয়োনিষ্কাশনজনিত দূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীর বেশির ভাগ মানুষ। এ ছাড়া আর্সেনিকদূষণের কারণে দেশের প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ জনগোষ্ঠীর ২৬ শতাংশ রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। সম্প্রতি পালিত বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে বেশ কয়েকটি এনজিও ফোরাম ও সংস্থা আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা এ তথ্য জানান। ২০১১ সালের উপাত্ত মতে, পৃথিবীর মোট শক্তি জোগানের ৩১ দশমিক ৫, ২৮ দশমিক ৮ ও ২১ দশমিক ৩ শতাংশ আসে যথাক্রমে জ্বালানি তেল, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। তেল ও গ্যাসকূপ খননের কাজের পাশাপাশি উত্তোলিত অপরিশোধিত তেলের পরিশোধনে পানির রয়েছে ব্যাপক ব্যবহার।
এনজিও ফোরামগুলোর জরিপ অনুসারে, রাজধানীতে ভূ-গর্ভস্থ পানি বেশি উত্তোলনের কারণে প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবছরই পানির স্তর নিচে নামছে। খাবার পানি সংগ্রহের জন্য টিউবওয়েল স্থাপনে যেতে হচ্ছে গভীর থেকে গভীরে। অথচ ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে বসানো যেত। এখন ১৫০ ফুট নিচে বসানো হলেও পানি মেলে না। দেশে ১৩ লাখ অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে আট লাখ নলকূপ ব্যবহার করলেই হয় কিন্তু ব্যবহৃত এ সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে পাঁচ লাখ বেশি। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক অপচয় হচ্ছে পানি ও অর্থের। আর আর্সেনিকের দূষণও ডেকে আনছে ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয়।

জাতিসংঘের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে পানি ব্যবহৃত হয় ৮৮ শতাংশ চাষাবাদের জন্য, ১০ শতাংশ গৃহস্থালির কাজে আর বাকি মাত্র দুই শতাংশ শিল্প খাতে। দেশে প্রায় ১২ লাখ সেচপাম্প রয়েছে, যার ৮৫ শতাংশ ডিজেলচালিত। বছরে সব মিলিয়ে চাহিদা রয়েছে প্রায় আট লাখ টন ডিজেলের। বাকি ১৫ শতাংশ পাম্প বিদ্যুৎচালিত।
রাজধানীবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকির তথ্য তুলে ধরে জরিপে বলা হয়, ঢাকা ও এর আশপাশে সাত হাজার কল-কারখানা থেকে প্রতিদিন ১৫ লাখ কিউবিক তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীতে পড়ছে। শুধু ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ২০ হাজার ঘন মিটার পয়োবর্জ্য নির্গত হচ্ছে। এর ৭০ শতাংশ শোধনাগার পর্যন্ত পৌঁছায় না কিংবা শোধন করার কোনো ব্যবস্থা নেই। নারায়ণগঞ্জের পাগলায় অবস্থিত একমাত্র পয়োশোধনাগারটি মাত্র ১০ শতাংশ তরল শিল্পবর্জ্য শোধন করার ক্ষমতা রাখে।

বিএডিসির তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল মাটির নিচ থেকে পানি ওঠায়। এসব টিউবওয়েল ২২ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচ থেকে পানি ওঠায়। কিন্তু এখন আর মাটির ২৪ ফুট নিচে গিয়ে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কৃষক পাঁচ ফুট মাটি গর্ত করে সেখানে শ্যালো টিউবওয়েল বসাচ্ছে। তার পরও অনেক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় পানি।

মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫০ তম সংখ্যা, জুন ২০১৪