সারা দিনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ক্লান্ত শরীর যখন একটু স্বস্তির পরশ খোঁজে; তখন মন চায় সবুজ প্রকৃতির নিবিড় ছায়ায় বসে নির্মল আর মুক্ত বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিতে। নিয়তি বুঝি এ সময়েই আড়াল থেকে অট্টহাসি হাসে! কোলাহলমুখর যান্ত্রিক এ নগরে এমন পরিবেশ কোথায়? যা খুঁজে পাওয়াটা সত্যিই দুষ্কর। ইট-কাঠ আর কংক্রিটের এই নগরে হাজারো দালানের মাঝে কিছুটা হলেও স্বস্তি মেলে ধানমন্ডি লেকে এলে।
অপরূপ ও দৃষ্টিনন্দন ধানমন্ডির লেকে শহুরে যান্ত্রিকতা থেকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও মুক্ত হয়ে নেওয়া যায় বুক ভরে নিঃশ্বাস। এমন মনোরম পরিবেশ কেবল এ নগরের এখানেই পাওয়া যায়। ধানমন্ডি লেকের একাংশের শুরু বিজিবি (৪ নং) গেট অর্থাৎ ২ নং ধানমন্ডি রোড থেকে সাতমসজিদ রোড পর্যন্ত। এ ছাড়া ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোড থেকে ৩২ নম্বর রোড পর্যন্ত বিস্তার এ লেকের। ধানমন্ডির ঐতিহ্যবাহী এ লেকের আয়তন ৯৮ একর।
উৎপত্তি ও ব্যবস্থাপনা
ধানমন্ডির সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে এখনকার লেকের অবস্থান হলেও আজ থেকে ২০ বছর আগের দৃশ্যটা কিন্তু এমন ছিল না। সৌন্দর্যমন্ডিত ও পরিবেশবান্ধব এ লেকটি অতীতে ছিল মানুষের দুর্ভোগের কারণ। শুরুতে এ লেক ছিল গভীর জলাশয়। এ জলাশয়ে ধানের মন্ডি রাখত আগেকার মানুষেরা। ধানের মন্ডি পেরিয়ে উৎপত্তি ধানমন্ডি নামক জায়গাটির। ধীরে হলেও ভরাট হয় জলাশয় ও নর্দমা। ভালো পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি জনবান্ধব পার্ক করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে ধানমন্ডির লেকের পরিবেশ সৌন্দর্যবর্ধণের কাজ শুরু করে। ২০০০ সালে শেষের দিকে এসে শেষ হয় এ কাজ। সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি এলাকাবাসীও এ লেকের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে নিজ দায়বদ্ধতা থেকে।
লেকের অবস্থার উন্নতিকল্পে
লেকের বর্তমান অবস্থার উন্নয়নে গৃহীত হয়েছে নানা উদ্যোগ। ধানমন্ডি লেকের উন্নয়নে ২৩ কোটি ৬৩ হাজার ৭৮ লাখ টাকার নতুন প্রকল্প (ইমপ্রুভমেন্ট অব ড্যামেজ স্ট্রাকচার অ্যান্ড সিভিক অ্যামিনিটিস ইন ধানমন্ডি লেক) হাতে নিয়েছিল ঢাকা সিটি করপোরেশন। প্রকল্পটির জন্য সরকার দিয়েছিল ২১ কোটি ২৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ডিসিসির পক্ষে ‘ইমপ্রুভমেন্ট অব ড্যামেজ স্ট্রাকচার অ্যান্ড সিভিক অ্যামিনিটিস ইন ধানমন্ডি লেক’ প্রকল্পটির কাজ ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এসডব্লিউ ও ১৬ ব্যাটালিয়ন। এখানকার পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিতের দায়িত্বে সরকার। এ ছাড়া ২৪ দশমিক ৮ কোটি টাকায় ওয়াকওয়ে মেরামত, কিছু কিছু জায়গায় ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ফুটওভার ব্রিজ, শিশুপার্ক, শরীর চর্চাকেন্দ্র, গভীর নলকূপ স্থাপন, বৃক্ষরোপণ, রবীন্দ্রসরোবর ও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি ছিল অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজের অন্যতম। এ ছাড়া লেকের পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে তৈরি করা হয় ঝরনা এবং পানিতে ব্যবস্থা করা হয় অক্সিজেন দেওয়ার। লেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গঠন করা হয়েছে একটি উপদেষ্টা কমিটিও।

ধানমন্ডির লেকসংলগ্ন ১৫ নম্বর রোডে নামলে প্রথমেই নজর পড়বে ব্যাচেলর পয়েন্টের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা খাঁজাবাড়ি বা জাহাজবাড়ি নামের অট্টালিকাটি। ইটা রঙের তৈরি বাড়িটি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি জাহাজের স্টাইলে তৈরি কাঠামোটি দৃষ্টিমনোহর। এই বাড়িটি দেখতে প্রতিদিনই আসে হাজারো দশনার্থী। এ ছাড়া ব্যাচেলর পয়েন্ট ঘিরে চায়ের আড্ডা আর গল্প-গুজবে মেতে ওঠে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এ লেকে রয়েছে একাধিক সুন্দর ফুটওভার ব্রিজ। লেকটিতে আছে পানিতে ভাসমান স্থির অবস্থায় কয়েকটি দ্বীপও। দ্বীপে বসে কেউ কার্ড খেলে, কেউ বা ছবি তোলে। আবার কেউ আড্ডার ঘোরে হারায় নিজেকে। লেকের ভেতর দিয়ে ৩২ নম্বর রোডে যেতে ক্ষণিকের বিশ্রাম নেওয়া যায় বিভিন্ন ছাউনিতে। নান্দনিক কারুকার্যে নির্মিত এ ছাউনিগুলো সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। এ ছাড়া ৩২ নম্বর রোডে যেতে ডিঙি রেস্তোরাঁয় সেরে নিতে পারেন নাশতার পর্বটাও। এখানে রয়েছে চমৎকারভাবে সাজানো ডিঙি বা নৌকা। যেগুলো ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া পাওয়া যায়। যাতে চড়ে লেকের পুরো দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ধানমন্ডি লেকের মনোরম পরিবেশের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে যায় রবীন্দ্রসরোবর নামের আড্ডাস্থলটি। এটি ধানমন্ডি লেকের দর্শনীয় দ্রষ্টব্য। রবীন্দ্রসরোবরের সিঁড়িতে প্রতিদিন বসে জম্পেশ আড্ডার আসর। নানা বয়সী শ্রেণী-পেশার মানুষ এ আড্ডার প্রাণ। রবীন্দ্রসরোবরের মূল পয়েন্টে বড় বড় পিলার ও গোলাকার সিঁড়ি সমন্বয়ে সাজানো চমৎকার এক মঞ্চ।
রবীন্দ্রসরোবরের এ মঞ্চে মাদকবিরোধী দিবস, এইডস প্রতিরোধ দিবস, নারী দিবস, ভাষা, স্বাধীনতা, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিনে দেশাত্মবোধক, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত ও ব্র্যান্ডের গান পরিবেশিত হয়। হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। যা নাড়া দেয় মানুষের মন, নিয়ে যায় ভিন্ন এক আনন্দের জগতে। তাই তো এখানে শুধু ধানমন্ডিবাসীই নয়, অনেকেই ছুটে আসে দূর-দূরান্ত থেকে। এখানকার মনোরম পরিবেশ আনন্দভরে উপভোগ করে নগরবাসী।
লেক তত্ত্বাবধানে যাঁরা
ধানমন্ডি এ লেকের তত্ত্বাবধানে সিটি করপোরেশন, লেক উপদেষ্টা কমিটি ও এলাকাবাসী সার্বিকভাবে নিয়োজিত। এখানে দিনে ও রাতে নিরাপত্তার জন্য আছে সিকিউরিটি গার্ড। তারা তাদের দায়িত্ব পালনে সদা সচেষ্ট। আরবানাইজেশন ও গভর্নেন্স প্রোগ্রামের সদস্যসচিব, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ও পরিবেশবিদ ইকবাল হাবিব ধানমন্ডি লেকের ইতিবাচক দিক প্রসঙ্গে বলেন, ঢাকায় উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ৫০৩ দশমিক ৬৪ একর। বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতি এক হাজার জনে উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। ব্রিটেনের জাতীয় ক্রীড়া সমিতির মতে, প্রতি এক হাজারজনের জন্য ছয় একর পরিমাণ উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ থাকা উচিত। যার চার একর সর্বজনীন আর দুই একর ব্যক্তিগত। এ ছাড়া প্রতি এক হাজার জনে এক একরে থাকবে বাগান আর তিন একরে থাকবে বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ। এভাবে সর্বমোট ১০ একর খোলা জায়গা থাকতে হবে প্রতি এক হাজার লোকের জন্য। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় খেলার মাঠ, পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্রের পরিমাণ নিতান্তই অপর্যাপ্ত। জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বশেষ ঘোষিত মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে নির্মল বিনোদন অন্যতম। আশার কথা হচ্ছে, ইট-সিমেন্টের কংকালে ভরা এ শহরে স্বস্তি ও আনন্দের জন্য যে কয়েকটি জায়গা টিকে আছে এর মধ্যে ধানমন্ডি লেক অন্যতম। এ লেকের সুষ্ঠু পরিচর্যা ও এর মনোরম পরিবেশকে ধরে রাখতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেকের দর্শনার্থী
ধানমন্ডির এ লেকে প্রতিদিন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ আসে। আসে লেকসংলগ্ন ধানমন্ডিবাসীরাও। এ ছাড়া দেশ ও রাজধানীর নানা প্রান্ত থেকে এ লেকে আসে নতুন ও বাইরের পর্যটকেরা।
লেক রক্ষার্থে যা করণীয়
লেকের পরিবেশ নষ্ট না করে তা দ্রুত সংরক্ষণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
লেকের পানিতে পাতাসহ বিভিন্ন ধরনের ভাসমান ময়লা দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
লেকের পাড় ভাঙন রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
ময়লা-আবর্জনা ও ড্রেনেজ সিস্টেম সক্রিয় রাখতে হবে। যাতে বর্জ্য ব্যবহারে লেকের পানি নষ্ট না হয়।
নগর সভ্যতার এ যুগে পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠ হচ্ছে নগরবাসীর সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অক্সিজেন। ঘর থাকলে যেমন এর জানালা চাই, তেমনি সুন্দর নগরের জন্য চাই পার্ক, উদ্যান ও উন্মুক্ত পরিসর। প্রয়োজনীয়সংখ্যক পার্ক, উদ্যান নির্মাণ ও সংরক্ষণই সভ্য সোপান গড়ার পূর্বশর্ত। প্রকৃতির সঙ্গে অপূর্ব মেলবন্ধন গড়ে তোলা পরিবেশবান্ধব ধানমন্ডি লেক এ নগরের ফুসফুস। নগরের কর্মক্লান্ত মানুষ এখানে এসে প্রকৃতির অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বুক ভরে নেয় স্বস্তির নিঃশ্বাস। কিছুক্ষণের জন্য হলেও যাপিত জীবনের ক্লেদ আর কষ্ট ভুলে উপভোগ করে নির্মল আনন্দ।
গোলাম রব্বানী (শাকির)
Golamrabbani.shakir@gmail.com
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫২ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৪