যে আগুনে সভ্যতার শুরু, সেই আগুনই হতে পারে সর্বগ্রাসী ধ্বংসের কারণ। আগুন সব সময়ই বিপজ্জনক। আগুন লেগে যেকোনো মুহূর্তে নষ্ট হতে পারে সম্পদ, এমন কি জীবনও! এ জন্যই যেকোনো ভবন বা স্থাপনাকে নিরাপদ করে গড়তে একে অগ্নিনিরোধক করা অপরিহার্য। কংক্রিট মজবুত, টেকসই এবং ভারবহনে সক্ষম হওয়ায় এখন প্রায় সব স্থাপনাতেই এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। কিন্তু কংক্রিট অগ্নিনিরোধক নয় বলে আগুন থেকে যে ঝুঁকি, সেটা রয়েই গেছে। তাই নির্মাণসামগ্রী হিসেবে কংক্রিট অগ্নিনিরোধক হওয়াটা খুব জরুরি।
কংক্রিটকে অগ্নিনিরোধক করার বেশ কিছু উপায় রয়েছে। প্রচলিত বেশির ভাগ কংক্রিট পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট অথবা পোর্টল্যান্ড ব্লেন্ডেড সিমেন্ট দিয়ে তৈরি, যেটি ৩০০ (৩০০০ সে.) সেন্টিগ্রেডের ওপরে তাপমাত্রা হলেই এর গুণাগুণ হারাতে শুরু করে। তাপমাত্রা ৬০০ (৬০০০ সে.) সেন্টিগ্রেডের ওপরে গেলে এর স্ট্র্যাকচারাল পারফরম্যান্স নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য কংক্রিট আগুনের প্রতি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটি আগুনের ব্যাপকতা ও সর্বোচ্চ তাপে পৌঁছাতে কত সময় নিচ্ছে এর ওপরই নির্ভর করে। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী হিসেবে বর্তমানে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিটের ব্যবহার দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এখানে আমরা সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিটকে অগ্নিনিরোধক করে উৎপন্ন করতে যে বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে সে সম্পর্কে জানব।
উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিটের বিশেষ দুর্বলতা, আগুনের সংস্পর্শে এলে এতে ফাটল বা চিড় ধরে। ফলে কংক্রিটের ভারবহন ক্ষমতা কমে যায়। সুইজারল্যান্ডের বৈজ্ঞানিকেরা স¤প্রতি সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিট উৎপাদনের নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এই পদ্ধতিতে তৈরি করা সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিট আগুনের প্রতি তুলনামূলক কম প্রতিক্রিয়াশীল। ফলে এটি অগ্নিনিরোধক কংক্রিট হিসেবে ব্যবহারের উপযোগিতা পেয়েছে।
আগুনের সংস্পর্শে এলে কংক্রিট ফেটে যায়, চিড় ধরে। এটি স্পোলিং (Spalling) নামে পরিচিত। স্পোলিংয়ের কারণ হচ্ছে, যখন উচ্চতাপে কংক্রিট জমানো হয় তখন এর কণাগুলোর মধ্যে পানি আটকে যায়। পরে কোনো কারণে আগুনের তাপ পেলে যখন এই পানি বাষ্প হতে থাকে, তখন কংক্রিটের গায়ে ফাটলের সৃষ্টি হয়। ফলে দেয়াল, সিলিং ইত্যাদির গা থেকে কংক্রিট খসে পড়ে। কংক্রিটের নিজস্ব ভারবহন ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর ফলে আগুনে পোড়া বিল্ডিংয়ের ধসে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে।
প্রচলিত কংক্রিটের ক্ষেত্রে এটরি তাপ সহনীয় ক্ষমতা বাড়ানো যায় সহজেই। প্রতি ঘনমিটার কংক্রিট মিক্সিংয়ের সঙ্গে কয়েক কিলোগ্রাম পলিপ্রোপাইলিন ফাইবার (PP) মিশিয়ে নিলে সাধারণ কংক্রিটও তাপসহনীয় হয়ে ওঠে। যখন এই কংক্রিট আগুনের সংস্পর্শে আসে তখন আগুনের তাপে পলিপ্রোপাইলিন ফাইবার গলে যায় এবং কংক্রিটের মাঝে এটি ছড়িয়ে গিয়ে একধরনের অন্তর্জাল তৈরি করে। এটি কংক্রিটের ভেতরে আটকে পড়া পানিকে সহজেই বাষ্পীভূত হয়ে বেরিয়ে যেতে দেয়। ফলে কংক্রিটের ওপর বাড়তি কোনো চাপ সৃষ্টি হয় না, তাই কংক্রিটের কাঠামোটি অক্ষুণ্ণ থাকে আগের মতোই।
উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিটের সঙ্গে পলিপ্রোপাইলিন ফাইবার মেশালে এর গুণাগুণের পরিবর্তন হয়। তাই পলিপ্রোপাইলিন ফাইবারের পরিমাণ যথাসম্ভব সীমিত রাখা জরুরি। আবার পলিপ্রোপাইলিন ফাইবারের পরিমাণ কম হলে কংক্রিট আগুনের সংস্পর্শে এলে তাপে গলে গিয়ে যে অন্তর্জালের সৃষ্টি করতো সেটি ব্যাহত হয়। ফলে কংক্রিটের স্পোলিং এড়ানো সম্ভব হয় না। পলিপ্রোপাইলিন ফাইবার এবং সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিটের মধ্যে এই বৈপরীত্যের জন্য যে সমস্যা সেটি দূরীভূত করতে অনেক দিন ধরে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিটের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে পলিপ্রোপাইলিন ফাইবারের অনুপাত কম রেখে এটিকে কীভাবে অগ্নিনিরোধক ও নিরাপদ করে নির্মাণ করা যায়, সেটিই এই গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য।
এম্পার ‘কংক্রিট কনস্ট্রাকশন কেমিস্ট্রি’-এর গবেষকগণ এবং ‘মেকানিক্যাল সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিং’ ল্যাবরেটরি এই দুই মিলে এই সমস্যার একটি সমাধান খুঁজে পেয়েছে। তারা পাতলা দেয়ালের কংক্রিট স্ল্যাব তৈরি করে, যার ভেতরে কার্বন ফাইবার রেইনফোর্সমেন্ট পলিমারের কেবল্ দেওয়া হয়েছে। এই কংক্রিটের মিশ্রণে প্রতি ঘনমিটার হিসেবে ২ কিলোগ্রাম পলিপ্রোপাইলিন ফাইবার মেশানো হয়। গবেষকগণ কিছু কিছু স্ল্যাবে সামান্য পরিমাণে উচ্চ শোষণক্ষমতাসম্পন্ন পলিমার (Super Absorbing Polymer- SAP) মেশান। এই বিশেষ সিন্থেটিক পলিমার নিজের ওজনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পানি শোষণ করতে সক্ষম। এই স্ল্যাবগুলো পরীক্ষা করার জন্য আগুনে দেওয়া হয়। আগুনের তাপ এক হাজার সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রায় ৯০ মিনিট পরে দেখা যায় উচ্চ শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন পলিমার দেওয়া কংক্রিট স্ল্যাবে অতি সামান্য চিড় ধরেছে, অন্য স্ল্যাবগুলোতে স্পোলিং ঘটেছে।

এর কারণ হচ্ছে উৎপাদনের সময় উচ্চ শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন পলিমার যে পানির সংস্পর্শে আসে তা কংক্রিট শুকানোর সময়ে শোষণ করে নেয়। কংক্রিট সেট করার সময় বিশেষ সূ² নলের সাহায্যে এই পানি SAP পলিমার থেকে টেনে নেওয়া হয়। ফলে SAP সংকুচিত হয়ে কংক্রিটের ভেতরে পলিপ্রোপাইলিন ফাইবারের জালিকার জন্য জায়গা করে দেয়। এর ফলে SAP পলিমার এবং পলিপ্রোপাইলিন ফাইবার মিলে যে অন্তর্জাল তৈরি করে তা কংক্রিটের দৃঢ়তা ও আগুনের তাপ সহন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিল্ডিং ধসে পড়া থেকে সুরক্ষা দেয়।
বলা যায়, এম্পার গবেষকদের এই অভাবনীয় সাফল্য সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিটের জন্য নতুন এক দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিট তৈরির এই নতুন পদ্ধতির প্যাটেন্টের জন্য ইতিমধ্যে আবেদনও করা হয়েছে। এই সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিটের তৈরি কোনো ভবনকে আগুন থেকে নিরাপদ রাখতে তাই আর আগের মতো এর বহিরাবরণে থার্মাল ইন্সুলেশনের প্রলেপ দিতে হবে না বা আলাদা করে কোনো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থারও প্রয়োজন হবে না। সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিটের সঙ্গে SAP পলিমার ব্যবহারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা হচ্ছে কংক্রিট তৈরির জন্য ব্যবহৃত মেশিন যে উচ্চ শব্দ তৈরি করে সেটির মাত্রাও সহনীয় রাখা সম্ভব হবে।
– মহুয়া ফেরদৌসি