ইমারতে ফ্লোর ফিনিশিং – ৪র্থ পর্ব

ইমারত নির্মাণ এবং এক্সটেরিয়র ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে সম্প্রতি বহুল ব্যবহৃত আরেকটি উপকরণ পেভমেন্ট টাইলস। আশির দশক থেকে শহরাঞ্চলের মানুষের বসবাসের জন্য হাঁটি হাঁটি পা পা করে বহু মালিকানাধীন অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়, যা এখন সচ্ছল শ্রেণির মানুষের জন্য একমাত্র অবলম্বন হিসেবে পরিগণিত। আগে এ দেশের মানুষ শহর-গ্রাম সর্বত্রই বাসস্থান বলতে একক ব্যক্তিমালিকানাধীন আলাদা একটি বাড়ি বুঝত। সেসব বাড়ি শহর ও গ্রামের জন্য আলাদা আলাদা আদলে নির্মাণ করা হতো। শহরাঞ্চলের বাড়ির আদল ছিল ৫/১০/১৫/২০ কাঠা কিংবা ততোধিক জমির ওপর গাড়ি বারান্দাসহ ছোট্ট একটা ইমারত। চারপাশে থাকত খোলা আঙিনা, শাকসবজি এবং ফল-ফুলের বাগান। আলাদাভাবে নির্মাণ করা হতো গাড়ির গ্যারেজ, ড্রাইভার এবং অন্যান্য কাজের লোকজনের জন্য বাসস্থানসহ প্রয়োজনীয় নানা স্থাপনা।

আর গ্রামাঞ্চলের বাড়ির বিশালতা ছিল অন্য রকম। যেমন- বিশাল এলাকাজুড়ে নির্মিত হতো মূল বাসস্থান। তার সামনে বিস্তৃত উঠান। বাসস্থানের পাশাপাশি নির্মাণ করা হতো কৃষি মালামাল রাখার জন্য গুদাম ঘর, গবাদিপশুর থাকার ঘর, পশুর খাবার সংরক্ষণের ঘর, মাছের পুকুর ইত্যাদি। কালের বিবর্তনে শহর-গ্রাম সব ক্ষেত্রেই সনাতনী প্রথার সেই একক মালিকানাধীন বাড়ি আজ বিলুপ্তির পথে। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছে বাড়ির সেই আগের আদল। শহর-গ্রামনির্বিশেষে প্রতিটি ক্ষেত্রেই একক বাড়ির আদল আজ স্বপ্ন ছাড়া আর বেশি কিছু ভাবা যায় না।

স্লিপলেস পেভমেন্ট টাইলস। ছবি: বিল্টকমএলটিডি

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো কোনো দিন জানতেও পারবে না যে ধানমন্ডি কিংবা গুলশান এলাকায় ২০ কাঠা জমির ওপর দুটো ফ্লোর (একতলা ও দোতলা) মিলে ৩ থেকে ৪ হাজার বর্গফটের ডুপ্লেক্স টাইপ একটি ইমারত নির্মাণ করা হতো, যেখানে বসবাস করত একটি মাত্র পরিবার। আজ সেই ২০ কাঠা জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে বহুতলাবিশিষ্ট একটি ইমারত, যেখানে বসবাস করছে ২০ থেকে ৩০টি পরিবার।

গ্রামের অবস্থাও একই, বিশাল সেই এলাকাকে খন্ডবিখন্ড করে তার ওপর তৈরি হচ্ছে আলাদা আলাদা বাড়ি। একেকটি বাড়িতে একেকটি পরিবারের বাস। নেই কোনো বিস্তৃত উঠান, নেই কোনো গবাদিপশু, নেই গোয়াল ঘর, নেই পশুর খারার সংরক্ষণের ঘর, নেই কোনো পুকুর। গ্রাম এখন আর গ্রাম নেই। গ্রামের পাশে নেই নদী, নেই পাখির কলরব, নেই ঝিঁঝি পোকার গান। সবকিছু মিলে অন্য এক জগতের বাসিন্দা আজ আমরা।

এবার আসা যাক মূল কথায়। অর্থাৎ পেভমেন্ট টাইলস নিয়ে আলোচনায়। পেভমেন্ট টাইলস স্থানীয় প্রযুক্তিতে দেশেই প্রস্তুত করা হচ্ছে। পেভমেন্ট টালি সিমেন্ট, বালু ও নুড়িপাথর কিংবা ৩/৮” ডাউন গ্রেডেড স্টোন চিপস পানি দিয়ে মিশ্রণ করে নির্ধারিত ছাঁচে ঢেলে মেশিনের সাহায্যে কম্প্যাক্ট করে জমানো হয়। এই টালি সাধারণত ১’-০”x ১’-০” সাইজ এবং ১” পুরু হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন ও রং ব্যবহার করে এই টালি প্রস্তুত করা হয়। নিয়মানুযায়ী টালি জমানোর পর অন্যান্য কংক্রিটের মতো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিউরিং করার পর তা কাজে লাগানো হয়ে থাকে।

ছাচে তৈরি পেভমেন্ট টাইলস। ছবি: ডেইলিমোশন

পেভমেন্ট টালি সাধারণত বেইজমেন্ট ফ্লোর ও গ্রাউন্ড ফ্লোরে অর্থাৎ গাড়ি পার্কিং এলাকাতে বসানো হয়। এই টালি বসানোর আগে নির্ধারিত স্থানটি ভালোমতো পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ভিজিয়ে নেওয়া জরুরি। এরপর ১ঃ৩ কিংবা ১ঃ৪ অনুপাতে সিমেন্ট ও বালুর মিশ্রণে তৈরি মর্টারের ওপর অন্যান্য টালির মতো একই নিয়মে বসানো হয়ে থাকে। এই টালি বসানোর ১০ ঘণ্টা পর থেকে কমপক্ষে ৭ দিন পর্যন্ত নিয়মিত কিউরিং করার পর এর ওপর গাড়ি চলাচল কিংবা পার্কিং করার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

পেভমেন্ট টালি ব্যবহারের ব্যাপারে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন। পেভমেন্ট টাইলস ফ্লোর ফিনিশিংয়ের ক্ষেত্রে বেইজমেন্ট ফ্লোর থেকে গাড়ি ওপরে তোলার জন্য যে র‍্যাম্প নির্মাণ করা হয়, সেখানেও বসানো হয়। এ ক্ষেত্রে টালির ডিজাইন সঠিকভাবে নির্বাচন করতে না পারলে গাড়ি ওঠাতে সমস্যা দেখা দেয়। অর্থাৎ গাড়ির চাকা স্লিপ করে। তাই এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে টালির ডিজাইন নির্বাচন করা অত্যাবশ্যক। এ ছাড়া টালি বসানোর সময় সর্বত্র লেভেল ঠিক রেখে পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।

সর্বোপরি, ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে সঠিক মালামাল নির্বাচন করা এবং সঠিকভাবে সব কাজ বাস্তবায়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন থাকা অপরিহার্য। পেভমেন্ট টালি যেহেতু স্থানীয় প্রযুক্তিতে প্রয়োজনানুযায়ী তৈরি করা হয়, তাই সাধারণত প্রস্তুতকৃত মালামালের মজুত কম থাকে। এমতাবস্থায়, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাপ্লাই অর্ডার নেওয়ার পর টালি প্রস্তুত করে এবং যথাযথ ম্যাচিউরড হওয়া কিংবা কিউরিং পিরিয়ড পার হওয়ার আগেই সাপ্লাই দিয়ে থাকে। ফলে, লোডিং আন-লোডিংয়ের সময় কিংবা পরিবহন করার সময় টালিতে ফাটল দেখা দেয়।

গাড়ি পার্কিং পেভমেন্ট লট। ছবি: কারগানআউটডোরলিভিং

এ ক্ষেত্রে টালির অপচয় বৃদ্ধি পায় এবং কাজের গুণগত মান লোপ পায়। অতএব, পেভমেন্ট টালির সাপ্লাই অর্ডার দেওয়ার সময় সাপ্লাইকারী প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত পরিমাণে টালি মজুত আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। অন্যথায় প্রস্তুতকৃত টালি ম্যাচিউরড হওয়া কিংবা পর্যাপ্ত কিউরিং পিরিয়ড হাতে নিয়ে সরবরাহ দেওয়া বা নেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিশ্চিত হতে হবে। এ ছাড়া কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য টালির অন্যান্য মালামাল এবং প্রস্তুতকৃত টালির সার্বিক গুণাগুণ যাচাই করে নেওয়া অত্যাবশ্যক।

যেকোনো স্ট্রাকচারের ক্ষেত্রে ফ্লোর ফিনিশিং সর্বশেষ একটি আইটেম, যার মালামাল ও কাজের গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে একটি স্থাপনার সার্বিক সৌন্দর্য ও স্থায়িত্ব। তাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রতিটি বিষয়ের ওপর সর্বোচ্চ নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।

ইমারতে ফ্লোর ফিনিশিং – ১ম পর্ব

ইমারতে ফ্লোর ফিনিশিং – ২য় পর্ব

ইমারতে ফ্লোর ফিনিশিং – ৩য় পর্ব

– প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান

পিইঞ্জ, চিফ ইঞ্জিনিয়ার (অপারেশন)
এনা প্রপার্টিজ লি.

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬২ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top