ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ – ৭ (বালু)

বালু

নির্মাণ প্রকল্পের প্রতিটি কাজে কংক্রিট ঢালাই করার জন্য ‘বালু’ দ্বিতীয় অন্যতম একটি ম্যাটেরিয়াল, যাকে প্রকৌশল ভাষায় ‘ফাইন এগ্রিগেট’ বলা হয়ে থাকে। যেকোনো স্ট্রাকচার নির্মাণকল্পে সিমেন্ট, বালু ও খোয়ার সংমিশ্রণে কংক্রিট ঢালাইয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয় এর বিভিন্ন কম্পোনেন্ট। এসব কম্পোনেন্টের গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে একটি স্ট্রাকচারের গুণগত মান ও স্থায়িত্বতা। অন্যদিকে, কংক্রিটের গুণগত মান নির্ভর করে ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহৃত বালুসহ এর প্রতিটি উপাদানের গুণগত বৈশিষ্ট্যের ওপর।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্মাণকাজে ব্যবহৃতব্য সব ধরনের বালুই প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত একটি উপাদান, যা প্রাপ্তিস্থান বা উৎসভেদে দুই ভাগে বিভক্ত:

১. পিট স্যান্ড (ভূগর্ভ থেকে প্রাপ্ত বালু) এবং

২. রিভার স্যান্ড (নদীগর্ভ থেকে প্রাপ্ত বালু)

প্রাপ্তিস্থান বা উৎসভেদ ছাড়াও গঠনগত মান কিংবা বালুর দানার সাইজ-ব্যবহারের ক্ষেত্রভেদে বালুকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন:

১. ফাইন স্যান্ড

২. মিডিয়াম স্যান্ড ও

৩. কোর্স স্যান্ড

ফাইন স্যান্ড

আনুপাতির হারে অনেক চিকন দানাযুক্ত বালুকে ফাইন স্যান্ড বলা হয়, যার ফাইননেস মডুলাস সংক্ষেপে এফ.এম. সর্বোচ্চ ১.০০ (ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে নির্ণীত) হয়ে থাকে। এই বালু সাধারণত নিচু জায়গা বা গর্ত ভরাটের কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন- ফাউন্ডেশনের জন্য তৈরি করা গর্ত রিফিল করা, প্রকৃতিগতভাবে বিদ্যমান কোনো গর্ত ভরাট করা এবং ইমারতসহ অন্যান্য যেকোনো স্থাপনার ফ্লোর লেভেল উঁচু করার জন্য ফ্লোরের নিচের অংশ ভরাটের কাজে এই ফাইন স্যান্ড ব্যবহার করা হয়।

কোর্স স্যান্ড সাধারণত কংক্রিটের ঢালাই করার কাজে ব্যবহৃত হয়। ছবি: বন্ধন

মিডিয়াম স্যান্ড

যে বালুর দানা আনুপাতিক হারে মোটা এবং ফাইননেস মডুলাস বা এফএম ১.০০ থেকে ২.০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে, তাকে মিডিয়াম স্যান্ড বলা হয়। এই বালু ইট বা পাথরের গাঁথুনি ও প্লাস্টার করা এবং টালি কিংবা মার্বেল বসানোর জন্য মর্টার তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া প্রয়োজন ও অবস্থাভেদে কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে এটি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যবহৃতব্য বালুর ফাইননেস মডুলাস বা এফএম কত হবে তার জন্য সুনির্দিষ্ট একটা নীতিমালা দেওয়া হয়। ফলে নির্মিতব্য কাজের গুণগত মান রক্ষার্থে প্রদত্ত এসব নীতিমালা মেনে চলা অত্যাবশ্যক।

কোর্স স্যান্ড

সর্বোচ্চ মোটা বালু অর্থাৎ যার ফাইননেস মডুলাস বা এফএম ২.০০ থেকে ৩.০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে, তাকে কোর্স স্যান্ড বা মোটা বালু বলা হয়। এই বালু সাধারণত কংক্রিটের ঢালাই করার কাজে ব্যবহৃত হয়। কংক্রিটের ধরন বা বৈশিষ্ট্য এবং স্ট্রাকচারের গুরুত্ব অনুযায়ী কোথাও ১০০% কোর্স স্যান্ড, আবার কোথাও কোথাও নির্দেশিত অনুপাতে কোর্স স্যান্ড ও মিডিয়াম স্যান্ড একত্রে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। এই কোর্স স্যান্ড ও মিডিয়াম স্যান্ড ব্যবহারের অনুপাত নির্মিতব্য কংক্রিটের কাক্সিক্ষত ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল।

বালুর গুণাগুণ

সব ধরনের বালুই যেহেতু প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত একটি উপাদান, তাই পিট স্যান্ড কিংবা রিভার স্যান্ড উভর প্রকারের বালুতেই বিভিন্ন ধরনের দূষিত পদার্থ থাকতে পারে। এসব দূষিত পদার্থের মধ্যে পলি বা কাদামাটি, কাঠ-কয়লা, ঝিনুক, খড়কুটো ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বালুতে লবণ কিংবা অন্যান্য অর্গানিক পদার্থ মিশ্রিত থাকে, ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে যার পরিমাণ নিরূপণ করা হয়ে থাকে। তাই কাজের গুণগত মান রক্ষার্থে সব ধরনের বালুই ব্যবহারের আগে চেলে নেওয়া, ধুয়ে নেওয়া এবং ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে নেওয়াটা জরুরি।

বালুর মধ্যে উপরোল্লিখিত দূষিত পদার্থসমূহের উপস্থিতি নিশ্চিত করে তার প্রতিকার করা ছাড়াও কাজের গুণগত মান রক্ষার্থে বালুর গ্রেডিং অর্থাৎ ফাইননেস মডুলাস বা এফএম টেস্ট করে নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই যেকোনো বালু কাজে ব্যবহারের আগে প্রয়োজনীয় স্যাম্পল কালেশন করে ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে এফএম জেনে নেওয়াসহ এর মধ্যস্থিত কাদামাটি, লবণ কিংবা অন্যান্য অর্গানিক পদার্থের মাত্রা জেনে নেওয়া দরকার। এসব ল্যাব টেস্টের ফলাফল যদি সহনীয় বা কাক্সিক্ষত মাত্রা অতিক্রম করে, তবে সেই বালু কাজে ব্যবহার করার আগে নিয়মানুযায়ী সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য।

খোয়া

নির্মাণশিল্পে কংক্রিট ঢালাই করার জন্য খোয়া অন্যতম উপাদান, যা কংক্রিটের কাক্সিক্ষত শক্তি সঞ্চারের প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। খোয়াকে প্রকৌশলের ভাষায় ‘কোর্স এগ্রিগেট’ নামে অভিহিত করা হয়। এই কোর্স এগ্রিগেট ইট কিংবা পাথর ভেঙে তৈরি করা হয়। যার ভৌতিক গুণাগুণ ব্যবহৃত ইট ও পাথরের গুণাগুণের ওপর নির্ভরশীল। ফলে, খোয়া তৈরি করার জন্য গুণগত মানসম্পন্ন ইট বা পাথর নির্বাচন করার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, খোয়া তৈরির কাজে ব্যবহৃতব্য ইট বা পাথরের গুণগত মানের ওপরই খোয়ার গুণগত মান নির্ভর করে।

নির্মাণশিল্পে কংক্রিট ঢালাই করার জন্য খোয়া অন্যতম উপাদান। ছবি: বন্ধন

এ ছাড়া, নির্মিতব্য কংক্রিটের কাঙ্ক্ষিত শক্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রস্তুতকৃত খোয়ার গ্রেডিং সঠিক হওয়াটা জরুরি। প্রসঙ্গত, একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে কংক্রিটের গঠনগত দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, খোয়ার মধ্যস্থিত ফাঁকা জায়গাগুলো বালু দ্বারা এবং বালুর মধ্যস্থিত ফাঁকা জায়গাগুলো সিমেন্ট দ্বারা ভরাট হয়ে থাকে। তাই এই ভরাট হওয়ার কাজটি যত বেশি নিবিড়ভাবে হয়, কংক্রিট তত বেশি শক্তি সঞ্চার করে। অতএব গুণগত মানসম্পন্ন ও শক্তিশালী কংক্রিট তৈরি নিশ্চিত করণার্থে বালু ও খোয়ার গ্রেডিং সঠিক হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

যেকোনো কংক্রিট ঢালাইয়ের জন্য সাধারণত ৩-৪” (০.৭৫ ইঞ্চি) ডাউন ‘ওয়েল গ্রেডেড’ খোয়া ব্যবহার করা হয়। এই ‘ওয়েল গেডেড’  বিষয়টির যথার্থতা যাচাই করা তথা কাজের মান নিশ্চিত করণার্থে ব্যবহৃতব্য খোয়ার স্যাম্পল নিয়ে ল্যাবরেটরি টেস্টের মাধ্যমে এর গ্রেডিং দেখে নেওয়া দরকার। এ ছাড়া মানসম্মত এবং কাঙ্ক্ষিত শক্তিসম্পন্ন কংক্রিট তৈরি করার জন্য খোয়া, বালু ও সিমেন্ট মিশ্রণের অনুপাত নির্ধারণ করার জন্য মূল কাজ শুরু করার আগে মিক্স ডিজাইন করে কংক্রিটের স্যাম্পল জামানো এবং ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে নির্মিতব্য কংক্রিটের শক্তি যাচাই করে নেওয়া হয়ে থাকে।

– প্রকৌশলী মোঃ হাফিজুর রহমান পিইঞ্জ, ভাইস চেয়ারম্যান,
লাইফ ফেলো, দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ
লাইফ সদস্য-বিএসটিকিউএম, বিএএএস, এওটিএস (জাপান)
লিড অডিটর, আইএসও-৯০০১:২০০৮ অ্যান্ড ২০১৫ (কিউএমএস)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top