ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ – ৯ (কাঠ ও কাচ)

কাঠ

ভবনের অভ্যন্তরীণ ফিনিশিংয়ের কাজের জন্য ‘কাঠ’ অন্যতম নির্মাণ উপকরণ। ভবনের আসবাব তৈরির ক্ষেত্রে কাঠের ব্যবহার সর্বত্রই। এ ছাড়া আবাসিক-অনাবাসিক সব ধরনের ভবনেই দরজা-জানালার ফ্রেম (চৌকাঠ) ও পাল্লা বানানোর কাজে কাঠ ব্যবহার করা হয়। অতীতে দরজা-জানালা তৈরির কাজের জন্য কাঠই ছিল একমাত্র উপকরণ। বর্তমানে বিকল্প অনেক উপকরণ বেরিয়েছে। যেমন- স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক, গ্লাস ইত্যাদি। ফলে প্রচলিত সমাজে মানুষের আর্থিক সংগতি আর রুচি অনুযায়ী এসব মালামাল ব্যবহার করা হয়।

বর্তমান বাজারে কাঠের গুণগতমান, দাম ও দুঃষ্প্রাপ্যতা বিবেচনায় জানালা তৈরির কাজে কাঠের ব্যবহার একেবারেই উঠে গেছে। এ ক্ষেত্রে যে যার রুচি ও সংগতি অনুসারে স্টিল গ্লেইজড কিংবা অ্যালুমিনিয়াম গ্লেইজড জানালা ব্যবহার করছে। স্টিল গ্লেইজড জানালার তুলনায় অ্যালুমিনিয়াম গ্লেইজড জানালার দাম প্রায় দ্বিগুণ। তাই তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের কিংবা শ্রেণির ভবনে স্টিল গ্লেইজড জানালা ব্যবহার করা হয়। উচ্চ মানসম্পন্ন ভবনসমূহে অ্যালুমিনিয়াম গ্লেইজড জানালা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শহর-গ্রাম সর্বত্রই একই অবস্থা বিরাজমান। 

এ ছাড়া দরজার ফ্রেম (চৌকাঠ) ও পাল্লা তৈরির ক্ষেত্রে কাঠের ব্যবহার এখনো বহুলাংশে বিদ্যমান। বিশেষ করে আবাসিক ভবনে কাঠের দরজার কোনো বিকল্প এখনো অচিন্তনীয়। তবে টয়লেটে কাঠের দরজার প্রচলন ইদানীং নেই বললেই চলে। দীর্ঘস্থায়িত্বতা বিবেচনায় টয়লেটের জন্য সর্বত্রই কাঠের পরিবর্তে প্লাস্টিকের দরজা ব্যবহৃত হচ্ছে। দাম ও মানের দিক থেকে নানা ধরনের প্লাস্টিকের দরজা এখন বাজারে বিদ্যমান। তবে দরজা তৈরির ক্ষেত্রে অনাবাসিক ভবনে বিশেষ করে অফিস, বিদ্যালয়, মসজিদ সর্বত্রই এখন অ্যালুমিনিয়াম গ্লেইজড অথবা শুধু কাচের দরজার ব্যবহার বাড়ছে।  

কাঠ প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত একটি সম্পদ, প্রকৃতিস্থ বিভিন্ন ধরনের গাছ থেকে পাওয়া যায় এই কাঠ। পাহাড়ি ও সমতল ভূমি কিংবা অঞ্চলভেদে গাছ ও কাঠের গুণগত মানের পার্থক্য রয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত গাছের কাঠ অনেক মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী। এ ছাড়া আমাদের দেশে গাছের অনেক শ্রেণিভেদ আছে, আছে এর গুণগত মান ও ব্যবহারিক পার্থক্য। সাধারণত আসবাব ও জানালা-দরজার ফ্রেম ও পাল্লা তৈরিতে সব সময় এক ধরনের কাঠ ব্যবহৃত হয় না। বিশেষ করে, জানালা-দরজা তৈরির জন্য তুলনামূলকভাবে একটু শক্ত কাঠ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

আমাদের দেশে প্রাপ্ত যেসব গাছ থেকে জানালা-দরজা বা আসবাব তৈরির কাঠ পাওয়া, তার একটি তালিকা হলো-

  • আম
  • জাম 
  • কাঁঠাল
  • নিম
  • গর্জন
  • কড়াই
  • সেগুন
  • মেহগনি
  • টিক চাম্বল
  • চাপালিশ ইত্যাদি।

উপরোল্লিখিত গাছগুলো চিরাই করে প্রয়োজনীয় সাইজড কাঠ প্রস্তুত করা হয়। ব্যবহারিক প্রয়োজন, গুণগত মান এবং দাম বিবেচনা করে এসব কাঠ কাজে লাগানো হয়। এগুলোর মধ্যে সেগুনগাছ থেকে সর্বোৎকৃষ্ট মানের কাঠ পাওয়া যায়, যা ঘরের আসবাব ও দরজা-জানালা তৈরি উভয় ক্ষেত্রেই বহুল ব্যবহৃত হয়। সেগুন কাঠ খুবই দৃষ্টিনন্দন ও সর্বাধিক ব্যয়বহুল। অন্যদিকে আমগাছ থেকে পাওয়া কাঠ সব থেকে নিম্নমানের আর কম দামি। আম কাঠ সাধারণত তক্তা আকারে চিরাই করে ইমারত নির্মাণ প্রকল্পের কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজে শাটারিং হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া গর্জনগাছ থেকে প্রাপ্ত কাঠও সাধারণত শাটারিং করার কাজেই ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া পার্টিশন ওয়াল কিংবা ফলস সিলিংয়ের ফ্রেম তৈরির জন্যও গর্জন কাঠ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 

নির্মাণকাজের জন্য গাছ নির্বাচন করার সময় গাছের উৎপত্তিস্থল এবং পরিপক্বতার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। ছবি: ফ্রিপিক

বিভিন্ন প্রকার গাছের মধ্যে শুধু আম ও গর্জন ছাড়া অন্যান্য গাছ থেকে প্রাপ্ত সাইজড কাঠ দরজা-জানালা এবং আসবাব তৈরি করাসহ সব ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সব ধরনের গাছের ক্ষেত্রেই উৎপত্তিস্থল এবং বয়সভেদে (পরিপক্বতা) সাইজড কাঠের গুণগত মানের তারতম্য হয়ে থাকে। বিশেষ করে অপরিপক্ব গাছ থেকে প্রাপ্ত কাঠে অল্প সময়ের ব্যবধানে পোকা (ঘুণ) লেগে কাঠ নষ্ট করে ফেলে। ফলে, ব্যবহৃতব্য কাঠ নির্বাচন করার সময় সার ও অসার (পরিপক্বতা ও অপরিপক্বতা) বেছে নেওয়ার একটা ব্যাপার থাকে, যা কাঠের গুণগত মান ও দীর্ঘস্থায়িত্বতার সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত।   

অতএব, নির্মাণকাজের জন্য গাছ নির্বাচন করার সময় গাছের উৎপত্তিস্থল এবং পরিপক্বতার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। এ ছাড়া জমিন থেকে তাজা গাছ কেটে প্রয়োজনমতো চিরাই করে সাইজড করা কাঠ কাজে লাগানোর আগে তা ভালোভাবে শুকিয়ে নেওয়া দরকার। অন্যথায়, কাজে লাগানোর পর কাঠ ফেটে যাওয়া কিংবা বেঁকে যাওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রয়োজনে এসব সাইজড কাঠ কাজে লাগানোর আগে কেমিক্যাল দিয়ে মেকানিক্যাল পদ্ধতির সাহায্যে সিজন্ড করে নিতে হয়। 

যা-ই হোক, প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত এসব কাঠের পরিবর্তে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত নানা ধরনের কাঠের বিকল্প তক্তা আকারে এখন বাজারে বিদ্যমান। যেমন-

  • প্লেইন পার্টিকেল বোর্ড
  • ভিনিয়ার্ড পার্টিকেল বোর্ড
  • প্লাই উডেন বোর্ড
  • ম্যালামাইন বোর্ড
  • প্লাস্টিক উডেন বোর্ড প্রভৃতি।

এসব বোর্ড বিভিন্ন প্রকার আসবাব তৈরি, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজ যেমন-কিচেন কেবিনেট কিংবা বেসিন কেবিনেট তৈরি, পাইপ ডাক্টিং, সারফেস লাইনিং ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই কাজের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে উপরোল্লিখিত সব ধরনের বোর্ডই বিভিন্ন সাইজ ও পুরুত্ব অনুযায়ী উৎপাদন করা হয়। ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত এসব বোর্ডের উৎপাদনভেদে গুণগত মান ও দামের পার্থক্য রয়েছে, যা বিচেনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজের জন্য বোর্ড নির্বাচন করা দরকার।

বর্তমানে আবাসিক ভবনে সর্বত্রই সম্পূর্ণ জানালা কাচের তৈরি করাসহ অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় কাচ ব্যবহার করা হচ্ছে। ছবি: ফ্রিপিক

কাচ

ইদানীং ভবন নির্মাণ প্রকল্পে কাচের ব্যবহার বাড়ছে। অতীতে শুধু আসবাব কিংবা দরজা-জানালা তৈরিতে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কাচ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে আবাসিক ভবনে সর্বত্রই সম্পূর্ণ জানালা কাচের তৈরি করাসহ অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় কাচ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া অনাবাসিক ভবনে দরজা-জানালা ছাড়াও ভেতর ও বাইরের দেয়ালও কাচ দিয়ে নির্মাণ করা হয়ে থাকে। ব্যবহারভেদে কাচের পুরুত্ব কমবেশি হয়। ফলে বর্তমান বাজারে বিদ্যমান রয়েছে বিভিন্ন সাইজ, পুরুত্ব, মান ও দামের কাচ।

– প্রকৌশলী মোঃ হাফিজুর রহমান পিইঞ্জ

ভাইস চেয়ারম্যান, লাইফ ফেলো, দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ
লাইফ সদস্য-বিএসটিকিউএম, বিএএএস, এওটিএস (জাপান)
লিড অডিটর, আইএসও-৯০০১:২০০৮ অ্যান্ড ২০১৫ (কিউএমএস)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top