ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ – ১৩ (পেইন্টিং ও পলিশিং)

একটি স্থাপনা নির্মাণ প্রকল্পে সিভিল কাজের মধ্যে সর্বশেষ ধাপ (ফিনিশিং আইটেম) ‘পেইন্টিং ও পলিশিং’-এর কাজ। নির্মাণ পরবর্তী ব্যবহারকালীণ সময়ে এর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ এবং আবহাওয়াজনিত কারণে ক্ষয়রোধ নিশ্চিত করে দীর্ঘস্থায়ীত্বতা বৃদ্ধি করা, নির্মিত ইমারতটিতে স্বাস্থ্যসম্মত ও স্বাচ্ছন্দ্য চিত্তে বসবাসের নিমিত্তে কাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সার্বিক সৌন্দর্যবর্ধন করাই পেইন্টিং ও পলিশিং কাজের প্রধান উদ্দেশ্য। 

প্রতিটি ইমারত নির্মাণ প্রকল্পের বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন কাঁচা মালামাল ব্যবহারের মাধ্যমে নির্মিত হয়ে থাকে। তাই উপরোল্লেখিত উদ্দেশ্যাবলি কার্যকরভাবে সফল করার জন্য বিভিন্ন অংশের জন্য আলাদা আলাদা পেইন্ট ব্যবহার করা হয়। মালামাল এবং কাজের পদ্ধতি অনুসারে অত্র কাজকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে, যা হচ্ছে-

১. পেইন্টিং ও

২. পলিশিং।

সিভিল, স্যানিটারী, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল সকল কাজ সম্পন্ন করার পর এই ফিনিশিং আইটেমের কাজ সম্পাদন করা হয়।

পেইন্টিং

স্থান ও পাত্র ভেদে পেইন্টিংয়ের নানা প্রকারভেদ আছে, যেমন;

  • কংক্রিট বা ব্রিক সারফেস
  • উডেন সারফেস ও 
  • স্টিল সারফেস।

উপরোল্লেখিত প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পেইন্টিং মালামাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে উডেন ও স্টিল সারফেসে সাধারণত একই ধরণের পেইন্টিং মালামাল ব্যবহৃত হয়, যা ‘এনামেল পেইন্ট’ নামে পরিচিত। কিন্তু কংক্রিট বা ব্রিক সারফেসের ভিতর ও বাহিরের অংশে জন্য পেইন্টিং মালামালের ধরণ ও মান আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। যার বিস্তারিত একটি তালিকা উল্লেখ করা হলো-

বাহিরের অংশে ব্যবহৃতব্য পেইন্ট;

  • হোয়াইট ওয়াশ (চুনকাম) 
  • কালার ওয়াশ 
  • স্নো-সেম 
  • ওয়েদার কোট ইত্যাদি।

কালের আবর্তে প্রথম তিনটি পেইন্টের ব্যবহার বিলুপ্ত প্রায়। অতীতকালে মানুষের রুচি এবং আর্থিক সংগতির ওপর নির্ভর করে ১ থেকে ৩ নং পর্যন্ত পেইন্টগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে ব্যবহার করা হতো। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রভুত উন্নতি সাধিত হওয়ায় এখন ধনী গরিব নির্বিশেষে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ওয়েদার কোট ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে ব্যক্তি মালিকানায় ইমারত নির্মাণ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়ায় সর্বক্ষেত্রেই ওয়েদার কোটের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। 

স্বাস্থ্যসম্মত ও স্বাচ্ছন্দ্য চিত্তে বসবাসের জন্য কাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টি করাই পেইন্টিং ও পলিশিং কাজের প্রধান উদ্দেশ্য। ছবি: ইন্ডিয়ামার্ট

ভিতরের অংশে ব্যবহৃতব্য পেইন্ট:

  • হোয়াইট ওয়াশ (চুনকাম) 
  • কালার ওয়াশ
  • ডিসটেম্পার 
  • প্লাস্টিক পেইন্ট ইত্যাদি।   

ইমারতের বাহিরের অংশের মত ভিতরের অংশে ব্যবহারের জন্যেও একই ভাবে ১ ও ২ নং পেইন্টের ব্যবহার একবারেই উঠে গেছে। এখন রুচি এবং আর্থিক সংগতি অনুযায়ী ডিসটেম্পার ও প্লাস্টিক পেইন্টই সর্বত্রই ব্যবহৃত হচ্ছে। প্লাষ্টিক পেইন্টের আবার নানা প্রকারভেদ আছে, আছে ব্যবহারিক স্থান এবং দামের পার্থক্যও। ফলে একই ভাবে রুচি এবং আর্থিক সংগতি অনুযায়ী প্লাষ্টিক পেইন্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে।  

স্থানভেদে পেইন্টিংয়ের সারফেস প্রিপারেশন, অ্যাপ্লিকেশন এবং অন্যান্য মালামাল আলাদা হয়। তবে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই পেইন্টিং কাজেরই মূল উদ্দেশ্য এক। তাই এসব কাজের জন্য ব্যবহৃতব্য মালামাল এবং কাজের গুণগত মান রক্ষা করা অতীব জরুরী। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, সব ধরণের পেইন্টই বিদ্যমান বাজারে রেডি মিক্সড্ আকারে পাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী নিজেরাও বিভিন্ন রং মিশ্রণ করে নেয়া যেতে পারে। 

পেইন্টিং কাজের ফিনিশিং ভালো হওয়া এবং এর দীর্ঘস্থায়ীত্বতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে মালামাল সংগ্রহ করা এবং কাজের পদ্ধতিসমূহ সঠিকভাবে মেনে চলা অত্যাবশ্যক। প্রতিটি কাজের গুণগতমান রক্ষার্থে যে কোন সারফেসে পেইন্টিং মেটারিয়্যালস্ লাগানোর আগে প্রয়োজনীয় সারফেস ট্রিটমেন্ট (অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ফিনিশিং দেয়া এবং ঘষা-মাজা করা) করার পর তা উত্তমরূপে পরিষ্কার করে নিতে হয় যাতে ধুলা-ময়লা কিংবা অন্যান্য কোনো আবরণ না থাকে।

সঠিকভাবে সারফেস ট্রিটমেন্ট শেষে নির্বাচিত পেইন্টিং মেটারিয়্যালস্ সংগ্রহ করতঃ প্রস্তুতকারী কোম্পানীর ম্যানুয়াল অনুযায়ী পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রাইম কোট, সেকেন্ড কোট ও ফাইনাল কোট প্রয়োগ করে পেইন্টিং কাজের ফিনিশিং দিতে হয়। পেইন্টের প্রতিটি কোট লাগানোর পর পরবর্তী কোট লাগানোর আগে ভালোভাবে শুকানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া জরুরী। খেয়াল রাখা দরকার, কোন অবস্থাতেই ভেজা সারফেসে পেইন্টিং মেটারিয়্যালস্ লাগানো যাবে না। 

প্রাথমিকভাবে পেইন্টিং কাজের প্রিপারেশন নেয়ার আগে সমস্ত সারফেস ভালোভাবে শুকানোর ব্যাপারটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে-‘সব ভাল যার শেষ ভাল তার’। সুতরাং পেইন্টিংয়ের কাজে সারফেস প্রিপারেশনের ব্যাপারে কোনরূপ অবহেলা করা ঠিক নয়। সামান্যতম অবহেলার কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে অত্র কাজের সার্বিক দৃষ্টি নান্দনিকতা এবং স্থায়ীত্বতা।  

সবশেষে বলতে চাই, পেইন্টিংয়ের কাজের জন্য সঠিক রং (কালার) নির্বাচন করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। রংয়ের ব্যবহারই একটা মানুষের রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ফলে পারিপার্শি¦ক সব কিছুর সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে পেইন্টের কালার নির্বাচন করা প্রয়োজন। সর্বপোরি, গুণগতমান সম্পন্ন কাজ করতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মিস্ত্রী দ্বারা নিয়মমাফিকভাবে কাজ করানো এবং অভিজ্ঞ লোকবল নিয়োগ দিয়ে সার্বক্ষণিক তদারকি নিশ্চিত করা জরুরী।

ফার্নিচার, জানালা-দরজার চৌকাঠ ও পাল্লা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পলিশিংয়ের কাজ করা হয়। ছবি: ফ্রিপিক

পলিশিং

পলিশিংয়ের কাজে মূলতঃ কোনো পার্থক্য নেই। ব্যবহারকারীর চাহিদা অনুযায়ী শুধু গুণগতমান আর রং (কালার) এর কিছু তারতম্য হয়ে থাকে। একটি ইমারত নির্মাণ প্রকল্পে ব্যবহৃত সকল কাঠের কাজ যেমন-ফার্নিচার, জানালা-দরজার চৌকাঠ ও পাল্লা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পলিশিংয়ের কাজ করা হয়। এই কাজটি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দনও বটে। মানসম্পন্ন পলিশে কাঠের আঁশগুলো প্রাকৃতিক নিয়মে দৃশ্যমান হয় এবং নান্দনিকতা বৃদ্ধি করে। 

ফলে এই কাজটি সঠিকভাবে সম্পাদন করার জন্য মান সম্পন্ন মালামাল সংগ্রহ করা এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মিস্ত্রী নিয়োগ দেয়া অত্যাবশ্যক। অনভিজ্ঞ মিস্ত্রী দ্বারা কাজ করানো হলে অতিরিক্ত রংয়ের প্রলেপ দিয়ে কাঠের আঁশগুলো ঢেকে ফেলে এবং উজ্জলতা ম্লান করে দেয়, ফলে এর নান্দনিকতা হারিয়ে যায়। তাই এই কাজটি করার আগেই সঠিক মালামাল সংগ্রহ করা, অভিজ্ঞ মিস্ত্রী নিয়াগ দেয়া এবং কাজের পদ্ধতিগত ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য।

– প্রকৌশলী মোঃ হাফিজুর রহমান পিইঞ্জ

ভাইস চেয়ারম্যান, লাইফ ফেলো, দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ
লাইফ সদস্য-বিএসটিকিউএম, বিএএএস, এওটিএস (জাপান)
লিড অডিটর, আইএসও-৯০০১:২০০৮ অ্যান্ড ২০১৫ (কিউএমএস)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top