ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ – ১৪ (শেষ পর্ব)

‘ভবন নির্মাণ এবং মান নিয়ন্ত্রণ’ বিষয়ক আমার এই ধারাবাহিক লেখা শুরু করতে গিয়ে মনে হলো, কেউ যদি এই লেখাটি নিয়মমাফিক না পড়ে, তার জন্য বিষয়গুলো বেশ খানিকটা এলোমেলো মনে হবে। তাই পাঠকবৃন্দের প্রতি আমার অনুরোধ, অত্র লেখার শিরোনাম সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে হলে লেখাগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে পড়ার চেষ্টা করবেন। কেউ যদি এই লেখাটি নিয়মানুযায়ী পড়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই মনে করতে পারবেন যে আমি আমার অলোচ্য বিষয়গুলোকে প্রথম পর্যায়েই বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করেছি। যার বিস্তারিত একটি অংশ পুনরায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যেমন;

  • কাজের ধরন ও
  • প্রয়োজনীয় জোগান।

কাজের ধরন

প্রকৌশল ভাষায় নির্মিতব্য একটি ভবনের সব কাজ প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে, যার প্রতিটি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল, যন্ত্রপাতি, লোকবল এবং কর্মপদ্ধতি আলাদা। আলাদা এসব কাজের কর্মপরিধি, কর্মপরিকল্পনা এবং কাজের বৈশিষ্ট্যও। ফলে, একটি ইমারতের নির্মাণকাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নির্মিতব্য ভবনের সব কাজকে যে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়, তা আবার উল্লেখ করা হলো। যথা: 

  • সিভিল
  • স্যানিটারি 
  • ইলেকট্রিক্যাল ও 
  • মেকানিক্যাল। 

প্রয়োজনীয় জোগান

টেকসই ও গুণগত মানসম্মত একটি ভবনের নির্মাণকাজ বাস্তবায়নকালে যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা দরকার তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদাভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি আছে, যা মেনে চলা অত্যাবশ্যক। প্রসঙ্গত, প্রধান যে চারটি বিষয়ের ওপর নির্মাণকাজের সার্বিক মান নির্ভর করে তার প্রতিটিই একটি অপরটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। ফলে, এই বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সর্বক্ষেত্রেই মান নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে কোনো রূপ অবহেলা দেখানো সমীচীন নয়। যেমন; 

  • সঠিক মালামাল নির্বাচন ও সরবরাহ নিশ্চিত করা
  • প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জোগান 
  • অভিজ্ঞ ও কর্মদক্ষ লোকবল নিয়োগ এবং
  • সকল কাজ সম্পাদনকল্পে যথাযথ পদ্ধতিসমূহ মেনে চলা। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উপরোল্লিখিত সিভিল, স্যানিটারি, ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল প্রতিটি কাজ সম্পাদন করার লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রয়োজনীয় মালামাল, যন্ত্রপাতি ও লোকবল জোগান দিতে হয়। সেই বিস্তারিত আলোচনায় দশম পর্ব পর্যন্ত সিভিল কাজের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। এরপর অলোচ্য বিষয় সিভিল কাজে ব্যবহৃতব্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং তা ব্যবহারের গুরুত্ব। মনে রাখা দরকার, একটি বড় প্রকল্পের কাজ সময়মতো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।

একটি বহুতলবিশিষ্ট ইমারত নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নকল্পে সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে কাজের ক্রমানুসারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন দেখা দেয়, যা প্রকল্পের কাজ শুরু করার আগেই কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক।

বর্তমানে, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, টেকনোলজিক্যাল সুযোগ-সুবিধা অনেক কিছুই বৃদ্ধি পেয়েছে। ছবি: ফ্রিপিক

সিভিল কাজে ব্যবহৃতব্য যন্ত্রপাতি:

  • সার্ভেয়িং/লেভেলিং ইনস্ট্রুমেন্ট
  • এক্সকাভেটর
  • ট্রাক/ডাম্পার
  • পে-লোডার
  • আর্থ/স্যান্ড কম্পেক্টর
  • জেনারেটর
  • ওয়াটার/মাড পাম্প
  • সাব-মার্সিবল পাম্প
  • হোয়েস্টার/এলিভেটর
  • কংক্রিট/মর্টার মিক্সার
  • ভাইব্রেটর 
  • স্লাম্প কোন
  • সিলিন্ডার কিংবা কিউব টেস্ট করার জন্য মোল্ড প্রভৃতি।

যন্ত্রপাতি

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’, অর্থাৎ যুদ্ধ জয় করতে হলে যেমন ঢাল-তলোয়ারের প্রয়োজন পড়ে, তেমনি নির্মাণকাজের গুণগতমান নিশ্চিত করার জন্য উপরোল্লিখিত যন্ত্রপাতিগুলোর দরকার হয়। যদিও আমাদের দেশে একসময় কোনো যন্ত্রপাতি ছাড়াই নির্মাণকাজ পরিচালিত হয়েছে। এমনকি ছোটখাটো কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন কাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্টের সংশ্লিষ্টতা থাকত না। একজন ভালো রাজমিস্ত্রি একাই নির্মাণসংক্রান্ত সব কাজ পরিচালনা করত এবং এতদ্সংক্রান্ত কাজে প্রয়োজনীয় সব মালামাল ও কাজ সম্পর্কে তারা যেটা বলত, সেটাই বাস্তবায়ন করা হতো। তদুপরি, ভবনের নকশাও রাজমিস্ত্রিরাই সরেজমিনে করে দিত। 

বর্তমানে, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, টেকনোলজিক্যাল সুযোগ-সুবিধা অনেক কিছুই বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বহুতলবিশিষ্ট ইমারত নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন। ফলে যেকোনো ভবন নির্মাণকাজের গুণগত মান নিশ্চিত করণার্থে প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী সঠিকভাবে জোগাড় করার পাশাপাশি এতদ্সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি জোগাড় করার বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি। উল্লেখ্য, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি করার পাশাপাশি কাজকে সহজ করে দেয় এবং সময় ও খরচ সাশ্রয় করে। তাই আমি উপরোল্লিখিত প্রতিটি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে সম্যক কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।  

নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি করার পাশাপাশি কাজকে সহজ করে দেয় এবং সময় ও খরচ সাশ্রয় করে। ছবি: ফ্রিপিক

সার্ভেয়িং/লেভেলিং ইনস্ট্রুমেন্ট

একটি প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য সাইট নির্বাচন করার পর তার সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণার্থে যথাযথভাবে সার্ভে সম্পন্ন করা অপরিহার্য। যেমন-জমির পরিমাণ (শতাংশ, কাঠা, বিঘা, একর) এবং পরিমাপ (চারদিকের মাপ-দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, কৌণিক অবস্থান) নির্ণয় করা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা (আশপাশে কোথায় কী স্থাপনা আছে), সার্ভিস কানেকশনসমূহ (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ড্রেনেজ/সুয়ারেজ সিস্টেম)-এর বাস্তব অবস্থান (কানেকশনসমূহ কোথায় কীভাবে আছে, প্রকল্পের স্থান থেকে দূরত্ব কত), ভূমির অবস্থান (নির্দিষ্ট একটি বেঞ্চমার্ক থেকে কোথায় কত উঁচু নিচু) ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেওয়া অপরিহার্য। তাই এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য অভিজ্ঞ লোকবল নিয়োগ দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সার্ভেয়িং/লেভেলিং ইনস্ট্রুমেন্ট জোগাড় করা অত্যাবশ্যক।

মনে রাখা দরকার, উপরোল্লিখিত কাজগুলো সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা না হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা ধরনের প্রতিকূলতা/জটিলতা সৃষ্টি হওয়াসহ প্রকল্প সম্পাদনের সময়সীমা ও নির্মাণব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে। সেই সঙ্গে কাজের গুণগত মানও লোপ পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

প্রকৌশলী মোঃ হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ

লাইফ ফেলো, দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ
লাইফ সদস্য-বিএসটিকিউএম, বিএএএস, এওটিএস (জাপান)
লিড অডিটর, আইএসও-৯০০১:২০০৮ অ্যান্ড ২০১৫ (কিউএমএস)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top