ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ – ১১ (মোজাইক)

মোজাইক অতি প্রাচীন একটি বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস। অতীতে এর বহুল প্রচলন থাকলেও বর্তমানকালে মোজাইকের ব্যবহার বিলুপ্তপ্রায়। মোজাইক সাধারণত ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। নির্মাণ পদ্ধতিভেদে মোজাইকের কাজ দুভাবে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে- ১. সিটু মোজাইট ও ২. মোজাইক টাইলস। সরাসরি ফ্লোরের ওপর ঢালাই করে যে মোজাইক ফিনিশিং দেওয়া হয়, তাকে ‘সিটু মোজাইক’ বলা হয় এবং বিভিন্ন সাইজ ও নকশা অনুযায়ী অন্যত্র প্রস্তুত করে ফ্লোরে বসানো মোজাইককে ‘মোজাইক টাইলস’ বলে। 

সিটু কিংবা টাইলস উভয় প্রকার মোজাইকই সাধারণত ১ঃ১ অনুপাতে মার্বেল চিপস ও সিমেন্টের মিশ্রণ দ্বারা ঢালাই করে প্রস্তুত করা হয়। এই মোজাইক প্রস্তুতের কাজ বেশ শ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুলও বটে। তবে এর দীর্ঘস্থায়িত্বতা অনেক বেশি। মোজাইক ঢালাইয়ের কাজে হোয়াইট ও গ্রে দুই ধরনের সিমেন্টই ব্যবহার করা যেতে পারে। মার্বেল চিপসেরও বিভিন্ন ধরন ও কোয়ালিটি আছে, আছে তদানুযায়ী দামের পার্থক্যও। ফলে, অত্র কাজের জন্য মালামাল নির্বাচনের বিষয়টি ব্যবহারকারীর রুচি এবং আর্থিক সামর্থ্যরে ওপর নির্ভরশীল। 

‘সিটু মোজাইক’-এর পুরুত্ব খুবই কম (৩/৮ ইঞ্চি) হয়ে থাকে, তাই মোজাইক ঢালাই করতে সম্পূর্ণ এলাকাটিকে ছোট ছোট প্যানেলে ভাগ করে নিতে হয়। নইলে সারফেসে ফাটল দেখা দেয় এবং মোজাইকের স্থায়িত্বতা কমে যায়। এই প্যানেল তৈরির জন্য সাধারণত গ্লাসের স্ট্রিপ ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রাশ বা পিতলের স্ট্রিপও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় প্যানেল তৈরির শেষে প্রথমে ১ ইঞ্চি পুরু প্যাটেন্ট স্টোন (সিমেন্ট, বালি ও ৩/৮ ইঞ্চি ডাউন গ্রেডেড ব্রিক/স্টোন চিপস ব্যবহারে ১ঃ২ঃ৪ অনুপাতে ১ ইঞ্চি পুরু সি.সি.) ঢালাই করে পৃষ্ঠদেশ আনফিনিশড অবস্থায় রাখা হয়। প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাই শক্ত হওয়ার পর অন্তত তিন দিন কিউরিং করার পর মার্বেল চিপস ও সিমেন্ট মিশ্রণের মাধ্যমে মোজাইক ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়।

মোজাইক নির্মাণসংশ্লিষ্ট সব কাজই সুদক্ষ কারিগর ও সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে করানো প্রয়োজন। ছবি: ফ্রিপিক

আগেই বলা হয়েছে, এই কাজটি বেশ শ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল। কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে ধাপে ধাপে এগোতে হয়, যার পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো হলো:

  • পূর্বে ঢালাইকৃত আরসিসি ফ্লোর ভালোমতো চিপিং করা 
  • আলগা ময়লা-মাটি পরিষ্কার করা এবং পানি দিয়ে ওয়াশ করা
  • ফিনিশিং লেভেল নির্ধারণ করে নকশা মোতাবেক গ্লাস স্ট্রিপ বসানো 
  • মোজাইক টপিংয়ের জায়গা খালি রেখে প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাই করা 
  • প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাইয়ের পর ভালোমতো কিউরিং করা
  • মোজাইক টপিং (১ঃ১ অনুপাতে মার্বেল চিপস ও সিমেন্ট) ঢালাই করা
  • মোজাইক ঢালাই করার পর কমপক্ষে ২১ দিন কিউরিং করা
  • কাটিং মেশিন দ্বারা ঢালাইকৃত মোজাইকের টপ সারফেস কেটে লেভেল করা
  • মোজাইক কাটিং পাথর ও সিরিশ কাগজ দ্বারা হাতে কেটে ফিনিশিং দেওয়া এবং 
  • অ্যাসিড ও মোম পলিশ করা ইত্যাদি। 

মোজাইক নির্মাণসংশ্লিষ্ট সব কাজই সুদক্ষ কারিগর ও সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে করানো প্রয়োজন। ব্যবহৃতব্য মালামাল এবং কাজের গুণগতমান ভালো হওয়া জরুরি। মার্বেল চিপস, সিমেন্ট, মোজাইক কাটার পাথর, সিরিশ কাগজ, অ্যাসিড, মোম সব কিছুরই গুণাগুণ ও মানের তারতম্য অনেক। ফলে, পুরো কাজের মান ও স্থায়িত্বতা নির্ভর করে ব্যবহৃতব্য মালামাল ও কাজের গুণগত মানের ওপর। তাই প্রয়োজনীয় মালামাল নির্বাচন ও কাজের তদারকির ব্যাপারে ব্যবহারকারী কর্তৃক সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যাবশ্যক। 

সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে অভিজ্ঞ মিস্ত্রির কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে প্রয়োজন অভিজ্ঞ লোকবল দ্বারা সুষ্ঠু তদারকি নিশ্চিত করা। প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাইয়ের কাজটি পূর্বে আলোচিত নিয়ম অনুযায়ী হওয়া জরুরি। মোজাইক টপিংয়ের কাজের জন্য মার্বেল চিপস চালনিতে চেলে ডাস্ট ফ্রি করা এবং অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা থাকলে তা পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ওয়াশ করে নেওয়া অপরিহার্য। মোজাইকের কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন রঙের মার্বেল চিপস পাওয়া যায়, যা মিশ্রণ করে নিজেদের ইচ্ছামতো নকশা প্রস্তুত করা যেতে পারে।

নির্মিতব্য মোজাইকের নির্বাচিত কালার অনুসারে বিভিন্ন ধরনের চিপসের অনুপাত ঠিক করে তা মিশিয়ে নেওয়ার পর সিমেন্ট ও চিপস ১ঃ১ অনুপাতে শুকনো অবস্থায় ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হয়। অতঃপর অল্প অল্প করে পানি দিয়ে সব মালামাল একত্রে মিলিয়ে ঢালাইয়ের কাজটি সম্পন্ন করা হয়। ঢালাই মেলানোর সময় পানির পরিমাণটা অবশ্যই লক্ষণীয়। মিস্ত্রিরা সাধারণত তাঁদের কাজের তাৎক্ষণিক সুবিধার্থে অধিক পানি ব্যবহার করে থাকেন, যা কাজের মান রক্ষায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে মোজাইকের স্থায়িত্বতা কমিয়ে দেয়। 

সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে অভিজ্ঞ মিস্ত্রির কোনো বিকল্প নেই। ছবি: ফ্রিপিক

মোজাইক ঢালাই শেষ করার ১০ ঘণ্টা পর অত্র এলাকায় পানি আটকিয়ে কমপক্ষে ২১ দিন পর্যন্ত কিউরিং করা জরুরি। প্রয়োজনীয় কিউরিং শেষে মোজাইক কাটা মেশিনে বিভিন্ন সাইজের (৪০, ৬০, ৮০, ১২০ নম্বর নামে নানা ধরনের পাথর বাজারে পাওয়া যায়) পাথর ব্যবহার করে সারফেস ফিনিশিং দিতে হয়। মেশিনে কাটা শেষ হলে পুনরায় পাথর ও সিরিশ কাগজ ব্যবহারের মাধ্যমে হাতে কেটে ফিনিশিং দিতে হয়। সবশেষে, অ্যাসিড ও মোম পলিশ করা হয়, যাতে মসৃণ ও চকচকে ব্যবহারের উপযোগী একটি অবস্থার সৃষ্টি করে। 

মোজাইক ফ্লোরের চারদিকের দেয়ালেও ৬ ইঞ্চি উচ্চতা পর্যন্ত মোজাইক করা হয়, যাকে স্কার্টিং বলে। এ ছাড়া কোনো লন এবং টয়লেট/বাথরুমের ফ্লোর ও দেয়ালেও মোজাইক করা হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, খাড়া দেয়ালের মোজাইক কাটার জন্য মেশিন ব্যবহার করা যায় না, এক্ষেত্রে পাথর ও সিরিশ কাগজ দ্বারা হাতে কেটে ফিনিশিং দিতে হয়। এতবিধ ঝামেলাপূর্ণ এবং ব্যয় ও শ্রমসাধ্য কাজের কারণেই বর্তমানে সর্বত্রই মোজাইকের স্থলে সিরামিক টাইলস স্থান করে নিয়েছে। 

– প্রকৌশলী মোঃ হাফিজুর রহমান পিইঞ্জ

ভাইস চেয়ারম্যান, লাইফ ফেলো, দি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ
লাইফ সদস্য-বিএসটিকিউএম, বিএএএস, এওটিএস (জাপান)
লিড অডিটর, আইএসও-৯০০১:২০০৮ অ্যান্ড ২০১৫ (কিউএমএস)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top