আর্থ রেইনফোর্সমেন্ট স্ট্রাকচার

প্রায় ৪০ বছর আগে আর্থ রেইনফোর্সমেন্ট নামে বিশেষ ধরনের নির্মাণ প্রযুক্তির উদ্ভব। এ প্রযুক্তিতে গ্রানুলার সয়েল বা বেলেমাটির (যে মাটিতে কাদামাটির পরিমাণ সামান্য বা অনুপস্থিত) সঙ্গে রেইনফোর্সমেন্টের সমন্বয়ে প্রস্তুত করা হয় অত্যন্ত টেকসই ও শক্তিশালী নির্মাণ উপকরণ। আধুনিক নির্মাণে এই উপকরণটির ব্যবহার পাঁচ দশক (৫০ বছর)-এর বেশি না হলেও মূল ধারণা কিন্তু প্রাচীন। এমনকি প্রকৃতিতেই এর ব্যবহারের নানা উদাহরণ রয়েছে। অনেক পশুপাখি তাদের আশ্রয় নির্মাণে এই কৌশল ব্যবহার করে। শুনতে অবাক লাগছে, তাই না? পশুপাখিরা সাধারণত মাটির সঙ্গে খড়কুটা, গাছের সরু ডাল, আঁশ প্রভৃতি বুনে তৈরি করে বাসা। ফলে শুধু খড় বা মাটির তৈরি বাসা থেকে যা হয় সেটা হয় আরও মজবুত ও দৃঢ়। তাই বলা চলে প্রকৃতির কাছ থেকেই মানুষ আসলে নির্মাণকৌশলের এই ধারণাটি পেয়েছে। আগে মানুষ বাড়ি তৈরিতে মাটির সঙ্গে নানা উপাদান মিশিয়ে বাড়িকে আরও মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করত। এ ছাড়া মাটির তৈরি বাড়ির নির্দিষ্ট আকৃতি বজায় রাখার জন্যও সেটি ছিল জরুরি। এসব ধারণা থেকেই মূলত উদ্ভব হয়েছে আর্থ রেইনফোর্সমেন্ট নির্মাণকৌশলের।

আর্থ বা মাটির রেইনফোর্সমেন্ট তৈরিতে মাটির সঙ্গে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী মিশিয়ে তা নির্মাণশিল্পের নানামাত্রিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। উপকরণগুলোর মধ্যে যা রয়েছে ইট বা পাথরের সুরকি, সিমেন্ট মেশানো বালু বা মাটি, রড, স্টিল, ধাতব বার বা কলাম প্রভৃতি। রেইনফোর্সমেন্টের ব্যবহার মাটির ধারণক্ষমতা ও দৃঢ়তা বাড়ায়। এটি মাটির হেলে পড়া ও ধসে পড়া রোধ করে। প্রাকৃতিকভাবেই মাটির স¤প্রসারণ ক্ষমতা কম, অন্য দিকে সংকোচনশীলতা অনেক বেশি। রেইনফোর্সমেন্টের ব্যবহারে মূল উদ্দেশ্য মাটির এই গুণাগুণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা। এমনিতে মাটির তৈরি যেকোনো কিছু রেইনফোর্সমেন্টের ব্যবহার ছাড়া সহজেই ভেঙে পড়ে বা এর প্রকৃত আকার নষ্ট হয়। এ কারনেই মাটির তৈরি তৈজসপত্রকে দৃঢ়তা দিতে একে আগুনে পোড়ানো হয়। রেইনফোর্সমেন্ট আর্থ কতটা দৃঢ় হবে সেটা নির্ভর করে এতে ব্যবহৃত রেইনফোর্সমেন্টের নিজস্ব শক্তি ও মাটির বুননের ওপর। সাধারণত রেইনফোর্সমেন্টের শক্তি থেকে নির্মিত আর্থ রেইনফোর্সমেন্টের শক্তি বা ভরের সমান বা বেশি হয়। রেইনফোর্সমেন্ট আর্থ নির্মাণশিল্পে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, কেননা এটি প্রচলিত অন্যান্য প্রযুক্তির থেকে অনেক বেশি সাশ্রয়ী, দীর্ঘস্থায়ী, মজবুত এবং সহজ ব্যবহারের উপযোগী।

সড়ক বাঁধ নির্মাণে আর্থ রেইনফোর্সমেন্ট

পুরকৌশলে ভিন্ন শক্তি ও স্থায়িত্বের আলাদা দুটি বস্তুর সমন্বয়ে আরও দৃঢ় ও স্থায়ী কোন নতুন বস্তুর নির্মাণ ও ব্যবহার খুব প্রচলিত একটি বিষয়। দেয়াল নির্মাণে ইটের সঙ্গে সিমেন্ট ও বালুর ব্যবহারও এমন একটি বিষয়। সাধারণ ঘরবাড়ির মতো স্থাপনার চেয়ে সেতু, আন্ডারপাস, বাঁধ, কালভার্ট, রাস্তা ইত্যাদি নির্মাণে স্বভাবতই স্থাপনার স্থায়িত্ব, দৃঢ়তা ও খরচের দিকে বেশি সতর্ক থাকতে হয়। এই স্থাপনাগুলো দীর্ঘমেয়াদি এবং এর ব্যবহারও বহুবিধ। রেইনফোর্সমেন্ট আর্থ টেকনিকের ব্যবহারের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে এটি খুবই সাশ্রয়ী, কম সময়ে ও সহজেই ইচ্ছেমতো আকৃতিতে তৈরি করা যায়। ফলে এটির ব্যবহারে প্রকৌশলীরা পান অনেক সুবিধা। রেইনফোর্সমেন্ট আর্থ টেকনিকের আরেকটি দিক হচ্ছে শহর এলাকায় বিশেষত যেখানে কনস্ট্রাকশন সাইটের জায়গা স্বল্প, সেখানে খুব সহজেই এটি ব্যবহার করা যায়।

নির্মাণ উপাদান
গ্রানুলার সয়েল বা ঝুরা মাটি আর্থ রেইনফোর্সমেন্টের মূল উপাদান। নির্মাণ উদ্দেশ্যে এর স্থায়িত্ব ও অন্যান্য দিক বিবেচনা করে এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করা হয়। এর প্রধান তিনটি উপাদান-

  • রেইনফোর্স এলিমেন্ট
  • সয়েল ব্যাকফিল
  • ফেচিং এলিমেন্ট।

রেইনফোর্স এলিমেন্ট
রেইনফোর্সমেন্ট হিসেবে বেশ কিছু উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্টিল, কংক্রিট, গ্লাস ফাইবার, কাঠ, রাবার, অ্যালুমিনিয়াম, থার্মোপ্লাস্টিক প্রভৃতি। রেইনফোর্সমেন্ট স্ট্রিপ্স, গ্রিড, নোঙর, শিট বা পাতলা পাত, শিকল, দড়ি কিংবা এর সমন্বয়ে যেকোনো আকৃতিতে হতে পারে।

সয়েল ব্যাকফিল
ব্যাকফিল হিসেবে ব্যবহৃত মাটি আগে থেকেই মোটা দানার হতে হয় যেন কোনো অবস্থাতেই ১০ শতাংশের বেশি ৭৫ মাইক্রোন সিভ অতিক্রম না করে। মাটিতে থাকা উপাদান যেমন লবণের অংশ এগুলো যেন রেইনফোর্স এলিমেন্টের সঙ্গে রাসায়নিক বা তড়িৎ বৈদ্যুতিক কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখায়। সতর্ক থাকতে হয় সেদিকেও। ব্যাকফিলের জন্য বিভিন্ন ধরনের মাটি ব্যবহার করা যায়, যেমন- গুঁড়া পাথর, নুড়ি মাটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ল্যাগ বা শিল্পে ব্যবহৃত ধাতব বর্জ্য, ছাই চূর্ণ ও কাদামাটি।

আর্থ রেইনফোর্সমেন্ট স্ট্রাকচার তৈরি ও স্থাপনার কাজ, আর্থ রেইনফোর্সমেন্ট তৈরিতে স্টিল বার স্থাপন

ফেচিং এলিমেন্ট
ফেসিং বা বহির্দেশ শক্ত বা নরম দুই ধরনেরই হতে পারে। এটা মূলত নির্ভর করে আর্থ রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহারের ওপর এবং এতে কী ধরনের সুরক্ষা প্রয়োজন সেটির ওপর যেমন- প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, ভূমিক্ষয় বা বন্যার কারণে ক্ষতি থেকে রক্ষা, ডাম্পিংয়ের মতো সমস্যা থেকে সুরক্ষা। ফেসিং নিচের যেকোনো একটি দিয়ে তৈরি হতে পারে। যেমন-

  • রেইনফোর্সমেন্ট কংক্রিট স্ল্যাব
  • প্লেইন সিমেন্ট কংক্রিট
  • রাজমিস্ত্রির কাজে যেমন প্রলেপ ব্যবহার করা হয়- নুড়ি, পাথর ও সিমেন্ট, বালুর সংমিশ্রণ
  • অন্যান্য প্রতিরোধক প্রলেপ প্রভৃতি।

শক্ত বা হার্ড ফেসিংয়ে কংক্রিট, স্টিল শিট, স্টিল গ্রিড, টিম্বারের যেকোনো একটি অথবা এদের সংমিশ্রণের সাহায্যে তৈরি করা হয়। এগুলো প্রয়োজনীয় ডিজাইন অনুসারে আকার ও আকৃতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইন্টারলকিং কংক্রিটের ব্লক, গ্যাবিওনস (Gabions বিভিন্ন অব্যবহৃত ও অপ্রয়োজনীয় বস্তু দিয়ে তৈরি বস্তার স্তূপ) বাইরের শক্ত আবরণের জন্য ব্যবহার করা হয়।

নরম বহির্দেশ বা সফট ফেসিংয়ে সাধারণত খাড়া দেয়ালের নির্মাণের সময় ক্ষয় থেকে রক্ষার জন্য অস্থায়ী প্রলেপ দেওয়া হয়। দুটি ব্লক বা গ্রিডের লেয়ারের মধ্যেও এটি ব্যবহৃত হতে পারে। রেইনফোর্সমেন্টের গ্রিডের ফিলিং সাইডে সফট ফেসিং হিসেবে প্রাকৃতিক এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের জন্য টার্ফ এবং টপ সয়েল ব্যবহার করা হয়।

এ ছাড়া ফেসিং এবং রেইনফোর্সমেন্টের মাঝে বন্ধনি ব্যবহার করা হয়। এটি দুইয়ের মধ্যে সংযোগ রক্ষার কাজ করে। খিলান, রড, ষড়্ভুজাকৃতির স্ক্রু, নাট, বল্টু ইত্যাদি বন্ধনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর এগুলো তৈরির প্রধান উপাদন মূলত প্লেইন স্টিল, গ্যালভানাইজিং স্টিল, স্টেইনলেস স্টিল, পলিমারস প্রভৃতি।

যেসব রেইনফোর্সমেন্টের ক্ষেত্রে পানির প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ সে ক্ষেত্রে ড্রেনেজ ব্যবস্থা রাখা হয়। সাধারণত বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে পানি প্রবাহের চাপ সহ্য করার জন্য এই পদ্ধতির উপযোগিতা অনেক।

আর্থ রেইনফোর্সড প্যানেল

সার্ভিস লাইফ
রেইনফোর্সমেন্ট সয়েল স্ট্রাকচারের জীবনকাল কতটুকু হবে সেটা মাথায় রেখেই এর ডিজাইন করা উচিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মূল স্থাপনার জীবনকালের সমান করেই রেইনফোর্সমেন্ট সয়েল স্ট্রাকচারের ডিজাইন করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন বাঁধ নির্মাণে সম্পূর্ণ স্থাপনার জীবনকাল বা স্থায়িত্ব রেইনফোর্সমেন্ট সয়েল স্ট্রাকচারের থেকে অনেক বেশি হতে পারে সে ক্ষেত্রে রেইনফোর্সমেন্ট এর মূল স্থাপনার শক্তি বৃদ্ধিতে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

রেইনফোর্সমেন্টের উপযোগিতা
রেইনফর্সমেন্টের ব্যবহার, উপযোগিতা ও উপকারিতা ব্যাপক। যেমন-

অস্বাভাবিক উচ্চতার দেয়াল নির্মাণে
তাত্তি¡কভাবে রেইনফোর্সমেন্টের সাহায্যে যেকোনো উচ্চতার দেয়াল নির্মাণ করা সম্ভব। দেয়ালের উচ্চতা যা-ই হোক না কেন এর নির্মাণকৌশলে কোনো হেরফের হয় না। ফলে সহজেই এর ডিজাইন থেকে শুরু করে নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ সবকিছুই সহজেই নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করা যায়।

উচ্চচাপ ধারণক্ষমতা
রেইনফোর্সমেন্ট বেশি মাত্রার উচ্চচাপ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন করে তৈরি করা হয়। বিশেষত বৃহৎ সেতু ও বাঁধ নির্মাণে, যা অপরিহার্য। রেইনফোর্সমেন্ট আর্থ ওয়াল এসব ক্ষেত্রে ভারবহনের প্ল্যাটফর্ম এবং ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। পিলারকে যথাযথভাবে ধরে রাখা, ধস থেকে রক্ষা করা ও অন্যান্য চাপ রক্ষার্থেও এটি মূল ভূমিকা পালন করে।

নমনীয় অবকাঠামো
রেইনফোর্সমেন্ট আর্থ ওয়াল বা রেইনফোর্সমেন্ট সয়েল ব্যাকফিল কাঠামোগুলোর মধ্যে সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর ফলে মূল স্থাপনার চাপ সহনশীলতা বাড়ে। এ কারণে ভিত্তি নির্মাণে অতিরিক্ত কোনো স্ট্রাকচার বা ভারী কাঠামো নির্মাণ করতে হয় না।

দ্রুতগতির নির্মাণ
হাইওয়ের মতো স্থাপনা নির্মাণে এর নির্মাণ সময়ের সঙ্গে এর ব্যয় সরাসরি যুক্ত। নির্মাণকাল যত কম হয়, এর মেশিনারিসহ অন্যান্য ব্যয় ততই কমানো সম্ভব হয়। রেইনফোর্সমেন্ট স্ট্রাকচারের ব্যবহার এর নির্মাণকাল ও খরচ দুটোকেই উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেয়।

স্থানস্বল্পতা
শহর এলাকায় বিশেষত যেসব কনস্ট্রাকশন সাইটে কাজের জন্য বেশি জায়গা পাওয়া যায়, সেখানে রেইনফোর্সমেন্ট স্ট্রাকচারের ব্যবহার সবচেয়ে উপযোগী। রেইনফোর্সমেন্ট চাইলেই আগে থেকেই চাহিদামাফিক আকার ও নকশায় তৈরি করে কনস্ট্রাকশন সাইটে এনে কাজ করা যায়। এতে কনস্ট্রাকশন সাইটের জন্য খুব বেশি জায়গার দরকার হয় না।

দেয়ালে ব্যবহৃত আর্থ রেইনফোর্সড প্যানেল

দীর্ঘস্থায়ী
রেইনফোর্সমেন্ট স্ট্রাকচার ১০০ বছরেরও বেশি সময়ের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে তৈরি করা যায়। হাইওয়ে, সেতু ইত্যাদি নির্মাণের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থাপনার আয়ু ৩০ বছরের অধিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। রেইনফোর্সমেন্ট স্ট্রাকচারের ব্যবহার এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ বিকল্প।

স্বল্পখরচ
রেইনফোর্সমেন্ট স্ট্রাকচার নির্মাণ স্বল্পব্যয়ে ও সহজে করা সম্ভব। এর নকশা থেকে রক্ষণাবেক্ষণ সব ক্ষেত্রেই সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। ফলে সামগ্রিক বিচারেও এটি দারুণ কার্যকরী।

নান্দনিক সৌন্দর্য
আগে থেকেই নির্মাণযোগ্য রেইনফোর্সমেন্ট স্ট্রাকচার যেকোনো নির্দিষ্ট নকশাতে তৈরি করা সম্ভব। জ্যামিতিক আকারের ব্যবহার, কংক্রিটের প্রলেপ এই দুইয়ের মিশেলে অসংখ্য ফিনিশিং প্রোডাক্ট নির্মাণ করা সম্ভব। রেইনফোর্সমেন্ট স্ট্রাকচারের এটি আরেকটি সুন্দর ও ব্যবহার উপযোগী বৈশিষ্ট্য।

মহুয়া ফেরদৌসি

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top