রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার লালদিঘি নামক স্থানে অবস্থিত বলে মসজিদটির নাম এই স্থানের নামেই নামাঙ্কিত। এই মসজিদ ব্রিটিশ আমলে আবিষ্কৃত হয়। আগে এটি জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, মোগল আমলে এটি নির্মিত। এরপর কোনো এক অজানা কারণে এটি কালের অতলে হারিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে মসজিদটি আবিষ্কারের সময় কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি বলে এর সঠিক তথ্য কোনো ইতিহাসবিদ দিতে পারেননি। তবে কিংবদন্তি অনুসারে ‘দিলওয়ার খান’ নামের একজন ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের মূল ফটকের ওপরের অংশে একটি দাগ দেখে ধারণা করা যায় যে সেখানে খুব সম্ভবত মসজিদটির নাম ও নির্মাণফলক বসানো ছিল, সেটি আর পাওয়া যায়নি।
লালদিঘি মসজিদটি আধুনিক ম্যাট ফাউন্ডেশন বেইজ সিস্টেমে বানানো। একটি সলিড বেদির ওপর পুরো মসজিদটি বসানো। আধুনিক বেইজমেন্টসমৃদ্ধ ভবনগুলোতে এই সিস্টেমে নির্মাণ করা হয়। অথচ আজ থেকে কত আগে এই মসজিদ নির্মিত হয়। বেদি বা মঞ্চটির উচ্চতা ১ মিটার। বেদির অর্ধেকটাজুড়ে রয়েছে মসজিদ ও বাকি অর্ধাংশ আজান দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়। সামনে রয়েছে বড় একটি প্রবেশপথ। মসজিদের অংশে থেকে বেদির অপর অংশে পৌঁছানো যায় একটি সিঁড়ি দিয়ে। মসজিদটির বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ইট ও চুন-সুরকি। এর কাছেই আছে ছোট একটি ঘাট বাঁধানো পুকুর।
মোগল আমলের মসজিদগুলোর সঙ্গে এই মসজিদের মূল তফাত এর গম্বুজ ডিজাইনে। অন্য মসজিদগুলোতে সাধারণত ৩টি গম্বুজ থাকলেও এই মসজিদটিতে মোট ৯টি গম্বুজ রয়েছে, যার প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ৯.৪৫ মিটার। এটিই এই মসজিদের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়। পুরো মসজিদটির উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের দেয়ালে মোট তিনটি করে ৯টি প্রবেশপথ রয়েছে। প্রতি দেয়ালের মাঝের প্রবেশপথটি অপর দুটি থেকে কিছুটা বড় আকৃতির। মাঝের প্রবেশপথ যে বড়, এটাই শুধু মোগল রীতিকে মনে করিয়ে দেয়। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি মিহরাব, এদের মধ্যে মাঝের মূল মিহরাবটি অপর দুটির চেয়ে বড় আকৃতির।
বাইরে থেকে মসজিদের মূল অংশের প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ৯.৪৫ মি.। পুরো প্ল্যাটফর্মটি ১৬.৭৬ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯.৭৫ মিটার প্রস্থের। এর মধ্যে মাঝেরটি পার্শ্ববর্তী অন্য দুটির চেয়ে বড়। উচ্চতা ও প্রশস্ততায় উত্তর ও দক্ষিণ পাশের মধ্যবর্তী দরজা দুটি পূর্বদিকের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটির সমান। দুই পাশের অন্য দুটি উন্মুক্ত অংশ জানালা ও ইটের জালি দিয়ে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করে দেওয়া হয়েছে। সব প্রবেশপথ ও মিহরাবে রয়েছে বহুখাঁজবিশিষ্ট মনোমুগ্ধকর খিলান। পাঁচটি প্রবেশদ্বারই উন্মুক্ত হয়েছে একটি করে অর্ধগম্বুজাকৃতির ভল্টের নিচে। মসজিদের চার দেয়ালেরই মাঝে রয়েছে দেয়াল থেকে সামান্য বের হয়ে থাকা এক্সেন্ট ডিজাইন। পশ্চিম দিকের কেন্দ্রীয় মিহরাব এবং বাকি তিন দিকের কেন্দ্রীয় দরজাগুলোকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে এই ডিজাইন। এই চারটি প্রক্ষেপণেরই কোণের দুই প্রান্তে রয়েছে সরু অলংকৃত সুন্দর দুটি মিনার (Turret)। এগুলো ছাদ থেকে গিয়ে প্যারাপেট ছাড়িয়ে ওপরে উঠে গেছে এবং এর সবচেয়ে ওপরে রয়েছে কলস আকৃতির নকশা, যার ওপর ছোট গম্বুজ। মসজিদের চার কোণের বাইরের দিকে রয়েছে বৃত্তাকার অর্ধবুরুজ। এগুলোও প্যারাপেট ছাড়িয়ে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। বুরুজগুলোর ভিত্তিতে রয়েছে কলস আকৃতির নকশার ছোট আকৃতির খাঁজকাটা গম্বুজ। মসজিদের ভেতরে স্থাপিত দুই সারিতে দুটি করে মোট চারটি ইটের তৈরি স্তম্ভের সাহায্যে এর অভ্যন্তরভাগকে তিনটি ‘আইল’ এবং তিনটি ‘বে’তে বিভক্ত। এতেই মসজিদ ৯টি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এগুলোর প্রতিটির ওপরে আচ্ছাদন হিসেবে রয়েছে একটি করে গম্বুজ, যা ছাতার মতো ওই বর্গকে ঢেকে রাখে। গম্বুজগুলোর আকৃতি সামান্য চাপা (Bulbous)। ভেতরের চারটি স্তম্ভ এবং প্রতি দেয়ালে দুটি করে মোট আটটি কলামের ওপর থেকে বানানো crisscrossed খিলান ডোমাকৃতির গম্বুজগুলোর ভার বহন করছে।

পরপর কৌণিক এবং বাইরের দিকে সাজানো ইটের সাহায্যে এখানে হানিকম্ব ডিজাইনে একটি সরল অথচ মনোমুগ্ধকর রূপ ফুুটে উঠেছে। সব গম্বুজই সরাসরি অষ্টভুজাকৃতির ড্রামের মতো বিমের ওপর স্থাপিত। আর এগুলোর একদম মাথায় আছে পদ্ম ও কলস ডিজাইনে শীর্ষচূড়া। ভেতরে ইটে তৈরি কলামগুলো খুব সুন্দরভাবে কার্ভিং করা এবং এগুলো অষ্টভূজাকৃতির। কলামের বেইজে কলস নকশা আর নিচ থেকে ওপরের দিকে এগুলো ধীরে ধীরে ছোট হয়ে অদ্ভুত সুন্দর আকৃতি দান করেছে, যা মোগল কোনো মসজিদেই দেখা যায় না।
পুরো ইমারতটির ভেতর ও বাইরের দেয়াল চুন-সুরকির প্লাস্টার করা। কিবলা দেয়াল ব্যতীত বাকি তিন দেয়ালের বাইরের অংশ এই প্লাস্টার দিয়ে তৈরি ছোট ছোট আয়তাকার খোপ-নকশা দিয়ে প্যাটার্ন তৈরি করে ডিজাইন করা। মসজিদের বাইরে সুন্দরভাবে অলংকৃত একটি কার্নিশের ব্যান্ড আছে। এর কোণজুড়ে আছে সুন্দর পদ্মপাপড়ির ডিজাইন। এ ধরনের কার্নিশ সাধারণত আমরা কোনো মোগল মসজিদেই দেখতে পাই না। গম্বুজসমূহের পিপার বাইরের অংশ এবং পার্শ্ববুরুজগুলোর ওপরের ছত্রীর ভিত্তিও অনুরূপ পদ্মপাপড়ি নকশা দিয়ে অলংকৃত করা হয়েছে।
আগে প্রতিটা মিহরাবে অলংকরণ ছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে সেগুলো বিস্মৃত। মিহরাবের মাথায় আধা গম্বুজ খিলান যুক্ত ছাদে পদ্ম নকশা ভেঙে গেছে অর্ধেকটা। আর এর চারপাশে আছে বন্ধ পদ্মপাপড়ির নকশার সারি। গম্বুজগুলোর ভিত্তিতেও একসময় নকশা ছিল বলে চিহ্ন পাওয়া যায়, এখন সবই স্মৃতি।
মসজিদে নামফলক পাওয়া না গেলেও এই মসজিদের অনেক বৈশিষ্ট্য মোগল আমলে তৈরি কিশোরগঞ্জের ‘গোরাই মসজিদ (১৩৮০)’ থেকে অনুপ্রাণিত বলে ধারণা করা হয়। বাগেরহাটের চাকশ্রী মসজিদ, বগুড়ার ফররুখ সিয়ার মসজিদ (১৭১৮)-এর সঙ্গেও এর একটা সাদৃশ পাওয়া যায়। তাই এটাকে সতেরো শতকের শেষ অথবা আঠারো শতকের শুরুতে তৈরি মসজিদ হিসেবে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন। বর্তমানে এই মসজিদে বেশ কিছু সংস্কার ঘটেছে। তবে এই সংস্কারের ফলে মূল মসজিদ বাইরে থেকে আর দেখা যায় না। আশা করি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই মসজিদের হারানো রূপ ফিরিয়ে আনবে অতি শিগগিরই, নইলে মোগল স্থাপত্যের এই অভূতপূর্ব মসজিদটি অচিরেই কালের অতলে হারিয়ে যাবে, যার দায় আমাদের সবার।
– বিজয়া চৌধুরী
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৭ তম সংখ্যা, জুলাই ২০২৪