পার্কিং সমস্যা উত্তরণে

ঢাকা মহানগরের যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ পার্কিং সমস্যা। ছোট-বড় রাস্তাগুলোর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না পার্কিংসংকটের কারণে। রাস্তা দখল করে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির সিংহভাগের গন্তব্যই বিপণিবিতান। বিপণিবিতান খোলা থাকার দিনের অতি সাধারণ ও পরিচিত দৃশ্য হচ্ছে মার্কেটসংলগ্ন রাস্তার ওপর ব্যক্তিগত গাড়ির দাঁড়িয়ে থাকা। একটি জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে ব্যক্তিগত গাড়িগুলো যতক্ষণ রাস্তায় থাকে তার ৯৫ শতাংশ সময়ই গাড়িগুলো পার্কিংরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। দিন দিন ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় পার্কিংয়ের কারণে যানজট সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। এ বাস্তবতায় পার্কিং সমস্যা নগর পরিকল্পনাবিদদের অন্যতম চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বিপণিগুলোতে চাহিদার তুলনায় পার্কিং স্পেসের স্বল্পতাহেতু এখানে আসা গাড়িগুলোকে বাধ্য হয়েই রাস্তার পাশে কিংবা ফুটপাতের ওপর কখনো কখনো পার্কিং করতে হয়। কেননা যে হারে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে সে হারে বাড়ছে না পার্কিং স্পেস। কিন্তু বাস্তবচিত্র কী বলে?

রাজধানী ঢাকায় প্রায় তিন হাজার বিপণিবিতান বা শপিং সেন্টার আছে। এগুলোর মধ্যে বসুন্ধরা সিটি, নিউমার্কেট, রাপা প্লাজা, মেট্রো শপিং কমপ্লেক্স বেশ আলোচিত। নিউমার্কেট ছাড়া প্রতিটি শপিং সেন্টারে ভূগর্ভস্থ পার্কিং-ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এখানে আসা গাড়িগুলো রাস্তার ওপর পার্ক করা হয়। এর মধ্যে বসুন্ধরা শপিং মলের কথা না বললেই নয়। বিশ্বের ১২তম বৃহৎ শপিং সেন্টার এটি। এখানে প্রায় দুই হাজার ৩২৫টি দোকান রয়েছে। ১৯ তলা বিল্ডিংয়ের ৮ তলা পর্যন্ত শপিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে আগত ক্রেতাদের ব্যবহৃত ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য রয়েছে ২ তলা ভূগর্ভস্থ পার্কিং-ব্যবস্থা। অথচ মার্কেট খোলা থাকার দিনে মার্কেটের সামনে উভয় পাশের রাস্তায় দুই-তিন লেন বরাবর গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। জরিপ বলছে, রাস্তার ওপর পার্ক করার প্রধান কারণ পার্কিং সম্পর্কে অসচেতনতা কিংবা পার্কিংয়ের জন্য জায়গা না থাকা। রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো চার্জ না থাকায় মার্কেটের অফ স্ট্রিট (off street) পার্কিংয়ের জায়গা থাকার পরও রাস্তার ওপর পার্কিং করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা কি ধরে নেব যে পার্কিং স্পেস যথেষ্ট নয়?

বসুন্ধরা সিটির মতো একই দৃশ্য দেখা যায় নিউমার্কেটে। কেনাকাটার জন্য জায়গাটি ঢাকাবাসীর কাছে অত্যন্ত পরিচিত। ১৯৫৪ সালে নির্মিত মার্কেটটিতে রয়েছে ৪৬৮টি দোকান। যার পণ্যসম্ভার বিভিন্ন শ্রেণীর ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে। নিউমার্কেটে আগত ক্রেতাদের মধ্যে ২০ শতাংশ ক্রেতা শুধু ব্যক্তিগত গাড়িতে আসেন। যাঁদের জন্য মার্কেটটিতে ১৩৪টি গাড়ির রাখার অন স্ট্রিট (on street) পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু নেই কোনো অফ স্ট্রিট পার্কিং-ব্যবস্থা। এই অন স্ট্রিট পার্কিংয়ের কারণে নিউমার্কেটের ২ নম্বর গেটের সামনে ৬০ ফুটের রাস্তার ২৩ ফুট দখল হয়ে থাকে। পিক আওয়ারে যখন চাহিদা থাকে বেশি তখন পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির সংখ্যা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়েও ৩৮.৫ শতাংশ বেশি থাকে। তখন অতিরিক্ত এ গাড়িগুলোর পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত লেন ছাড়াও আরও এক বা একাধিক   লেনে গাড়ি পার্ক করা হয়। ফলে ২ নম্বর গেটের সামনে বড়জোড় দু-একটি লেনে গাড়িগুলো চলাচল করতে পারে। মাঠ পর্যায়ের ২০১১ সালের জরিপে দেখা যায় এভাবে পার্কিংরত গাড়ির সংখ্যা বাড়ার মূল কারণ ন্যূনতম পার্কিং চার্জ ধার্য না করা এবং রাস্তার ওপর পার্কিংয়ের কারণে শাস্তি না হওয়া। 

নিউমার্কেট কর্তৃপক্ষ গাড়িপ্রতি ১০ টাকা চার্জ নেয়। আশ্চর্য হলেও সত্য, এই ১০ টাকা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়। দেখা গেছে ৪ শতাংশেরও বেশি গাড়ি তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একটি পার্কিং স্পেস ব্যবহার করে মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে। অথচ এমন ঘটা বাইরের যেকোনো দেশেই অকল্পনীয়। জরিপানুসারে দিনে পাঁচ ঘণ্টায় একটি পার্কিং স্পেস ব্যবহার করে মাত্র তিনটি গাড়ি। আরও লক্ষণীয় যে পার্কিং চার্জের স্বল্পতা হেতু আরও গাড়ি রয়েছে, যাদের গন্তব্য নিউমার্কেট নয়। তারাও গাড়ি রাখার জন্য নিউমার্কেটের অন স্ট্রিট পার্কিং ব্যবহার করে। এ থেকে সহজেই অনুমেয়, পার্কিংয়ের স্থানস্বল্পতা রাস্তার ওপর পার্কিং করতে বাধ্য করায় না বরং পার্কিং চার্জের স্বল্পতার কারণে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার ওপর গাড়ি পার্ক করে রাখে। এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পার্কিংয়ের বর্তমান অবস্থার উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও অতি দ্রুত তার বাস্তবায়ন।

বিপণিবিতান খোলা থাকার দিনের অতি সাধারণ ও পরিচিত দৃশ্য হচ্ছে মার্কেটসংলগ্ন রাস্তার ওপর ব্যক্তিগত গাড়ির দাঁড়িয়ে থাকা। ছবি: দ্য ডেইলি স্টার
  • মেট্রোপলিটন এরিয়ার জন্য নির্ধারিত পার্কিং পলিসি বা নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়াও অন্যান্য শহর এবং উপশহরের জন্য উপযোগী পার্কিং নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
  • অন স্ট্রিট পার্কিং নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ রাস্তার ওপর পার্কিংয়ের সুযোগ থাকলে রাস্তার পাশের ফুটপাত দোকান দিয়ে দখল হতে থাকে। এসব দোকানে ক্রেতাদের ভিড়ের কারণে পথচারীকে ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নামতে হয়। এতে পথচারীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি রাস্তায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়। ফলে সৃষ্টি হয় যানজটের। এ ছাড়া রাস্তার পাশের  অবৈধ দোকানগুলোর কারণে রাস্তার ওপর যে পার্কিং হয়। এই গাড়িগুলোর পার্কিং স্পেস থেকে আসা-যাওয়ার সময়ও রাস্তায় যান চলাচল বিঘ্নিত হয়।
  • নতুন নির্মিত কিংবা নির্মাণাধীন বিপণিবিতানগুলোতে অত্যাবশ্যকীয় পার্কিং স্পেস থাকতে হবে। এবং এই পার্কিং স্পেসগুলোর সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। একটি পার্কিং স্পেসের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পার্কিং চার্জ বাড়াতে হবে, যাতে করে একটি গাড়ি দীর্ঘ সময় ধরে পার্কিং স্পেসে বসে না থাকে। কাজেই পার্কিংয়ের চার্জ ধার্য করার সময় পার্কিংয়ের সময় ও স্থায়িত্ব বিবেচনা নিতে হবে। জরিপে দেখা যায়, যদি নিউমার্কেটের পার্কিং স্পেসের সময় দুই ঘণ্টা বেঁচে দেওয়া হয় তাহলে অতিরিক্ত ৪৫ গাড়ির পার্কিং-ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
  • বিপণিবিতানের সামনের রাস্তায় বা ফুটপাতে পার্কিং আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ করতে হবে।
  • নতুন পার্কিংয়ের স্পেস ঠিক করার সময় শেয়ার পার্কিং-ব্যবস্থা বিপণি কিংবা অফিসগুলোতে চালু করা যেতে পারে, যাতে করে পিক আওয়ারে পার্কিংয়ের স্বার্থে পার্শ্ববর্তী অন্য বসত বাড়ি কিংবা ইনস্টিটিউটে পার্কিং শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ধরনের সমাধান ঢাকা শহরের মিক্সড ডেভেলপমেন্ট- এর জন্য অতি জরুরি।
  • প্রতিটি বিপণিবিতানের আশপাশে রাস্তাগুলোতে উঁচু এবং অবিভক্ত ফুটপাতের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে ফুটপাত পার্কিংয়ের উদ্দেশ্য ব্যবহৃত না হয়।
  • ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানোর জন্য পথচারী ও বাইসাইকেল চালকদের চলাচলের সুব্যবস্থা করতে হবে।
  • পার্কিং চার্জ সংগ্রহ এবং পার্কিংয়ের নিয়ম ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য কমিটি করতে হবে।
  • পার্কিং চার্জ থেকে আয়ের একটি অংশ পার্কিং ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবহার করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, পার্কিংয়ের চাহিদা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, এভাবে পার্কিংয়ের চাহিদা বাড়তে থাকলে চাহিদা অনুযায়ী পার্কিংয়ের জোগান দেওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে পড়বে। কাজেই পার্কিং সমস্যা নিরসনে পার্কিং স্পেসের সরবরাহ বাড়ানোকে নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং পাশাপাশি পার্কিং ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। কিছুসংখ্যক বিশেষ পার্কিংয়ের ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে বিপণিগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থে। তবে লক্ষ রাখতে হবে এই ব্যবস্থা যেন আকর্ষণীয় না হয়, যা ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে। এ ক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী পার্কিং দেওয়ার পরিবর্তে পলিসি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্কিংয়ের চাহিদা কমানোই হবে টেকসই সমাধান। কারণ, এটি প্রমাণিত সত্য যে সরবরাহই চাহিদা তৈরি করে।

– স্থপতি ড. সজল চৌধুরী

লেখক: শিক্ষক ও জলবায়ু এবং পরিবেশ গবেষক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top