রংবেরঙের রং
যত প্রকারের রং

হরেক রকম পেইন্ট

রংকে সাধারণত পেইন্টের পাসপোর্ট বলা হয়। তাই রং দিয়ে যেকোনো জিনিস নিচের পদ্ধতিগুলোতে পেইন্ট করা হয়। আর তা হচ্ছে –

  •  পানিভিত্তিক পেইন্ট
  •  তেলভিত্তিক পেইন্ট
  •  মেটাল পেইন্ট
  • কালার চেঞ্জিং বা রং পরিবর্তনকারী পেইন্ট

পানিভিত্তিক পেইন্ট

পানিভিত্তিক পেইন্ট সাধারণত ইমালসন নামে পরিচিত। এটা সচরাচর ঘরের দেয়াল ও ছাদে ব্যবহার করা হয়। এই পেইন্ট প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক উন্নত। বিশেষ করে এক্সেলিকের উচ্চমানসম্পন্ন কাজে যখন মেটাল বা কাঠজাতীয় কিছুতে পেইন্ট করা হয়।

ইমালসন পেইন্ট তেলভিত্তিক পেইন্ট থেকে অধিক সুবিধাজনক। কারণ, এতে তেলভিত্তিক পেইন্টের তুলনায় গন্ধ কম থাকে এবং যে ব্রাশ দিয়ে পেইন্ট করা হয়, সেটি পানিতে সহজেই ধোয়া যায়। এটি পুনরায় ব্যবহার করতে অসুবিধা হয় না।

তেলভিত্তিক পেইন্ট

তেলভিত্তিক পেইন্ট সাধারণত বেশি ব্যবহৃত হয় শক্ত ও অসমতল এবড়োখেবড়ো স্থানে। যেমন- টিম্বারের ভেতর ও বাইরে। আসবাবপত্রে বিভিন্ন ধরনের সমতল জায়গায় এর ব্যবহার বেশি। ব্রাশ দিয়ে পেইন্ট করার পর ব্রাশ টারপিন বা ওয়াইট স্প্রিট দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়। ব্রাশটি পেইন্ট করার পর ধুয়ে না রাখলে শক্ত হয়ে যায়। সেই ব্রাশ দিয়ে পুনরায় ভালোভাবে পেইন্ট করতে সমস্যা হয়।

মেটাল পেইন্ট

মেটাল পেইন্টের মাধ্যমে প্রলেপ দেওয়া অনেকটা ব্যয়সাধ্য কিন্তু যে স্থানে পেইন্ট করা হবে সেটি থাকে সুরক্ষিত। মেটাল পেইন্ট মেশিনের সাহায্যে করা হয়। এতে পাম্পসহ ব্রাশ থাকে। যে স্থানটিতে মেটাল পেইন্ট করা হয় তা সূর্যের আলোয় থাকলে ভালো হয়। কারণ, মেটাল পেইন্ট করা স্থানটিতে রং করার পর অতি সহজে এবং অল্প সময়ের তা শুকিয়ে যায়।

যদি কোনো স্থানে পুনরায় পেইন্টিংয়ের প্রয়োজন হয়, সেখানে আগে থেকে পেইন্টিংয়ের প্রলেপ দিয়ে তার ওপর মেশিন দিয়ে পেইন্ট করা হয়। এতে মেটালের গায়ে পেইন্টের উজ্জ্বলতা বাড়ে। তা ছাড়া মেটালে ক্ষয় বা মরিচা পড়া রোধের জন্য প্রাথমিকভাবে রেড-অক্সাইড পেইন্ট করা হয়। তারপর সেটার ওপর যেকোনো রঙের অয়েল পেইন্ট করলে মেটালের রঙের স্থায়িত্ব বেশি হয়।

মেটাল পেইন্ট দেওয়ার আগে যে স্থানটিতে পেইন্ট করা হবে তার পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা কত তা জানা প্রয়োজন। যেমন বয়লার, স্টিম পাইপ, মেটাল চিমনি, রেডিয়েটর ইত্যাদিতে পৃষ্ঠদেশ তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। তাই যেকোনো মেটালে পেইন্ট করা উচিত নয়। বিশেষ বিশেষ ধরনের মেটালে পেইন্ট করতে বিশেষ ধরনের পেইন্ট ব্যবহার করা হয়।

পরিবর্তনশীল পেইন্ট

বর্তমানে এমন প্রযুক্তি রয়েছে, যেখানে পেইন্ট করার পর রঙের পরিবর্তন হয়। থার্মোক্রোমিক পেইন্ট এমনই এক পদ্ধতি। এ জন্য তরল ক্রিস্টাল ব্যবহৃত হয়। ফটোক্রোমিক পেইন্ট ব্যবহার করা হয় ফিল্মের জন্য। যখন ফিল্মটি অতিবেগুনি রশ্মিতে ধরা হয় তখন রঙের পরিবর্তন ঘটে। এই বিশেষ ধরনের পেইন্ট বেশি ব্যবহৃত হয় আই গ্লাস প্রস্তুতিতে।

পরিবর্তনশীল পেইন্ট হ্যালোক্রোম যৌগের সঙ্গে অন্যান্য জৈব রঞ্জক পদার্থ মিশ্রিত করে তৈরি করা হয়। পেইন্টটি ভেজা থাকলে গোলাপি আর শুকিয়ে গেলে সাদা রং ধারণ করে। পেইন্টের এই বৈশিষ্ট্যের জন্য এই পেইন্ট দিয়ে দু-তিনবার পেইন্ট করা যায়।

মাধ্যমভেদে পেইন্ট

পেইন্টের ব্যবহার সাধারণত তিনটি মাধ্যমে। কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় মাধ্যমে। পেইন্ট কোন মাধ্যমে ব্যবহৃত হবে তা নির্ভর করে পরিবেশ, পরিস্থিতি ও প্রযুক্তির ওপর।

কঠিন মাধ্যম

শিল্পকারখানা এবং গাড়িসংক্রান্ত কাজে পেইন্টের ব্যবহার কঠিন মাধ্যমের সবচেয়ে উত্তম উদাহরণ। পেইন্টের গুঁড়ো বা পাউডার স্প্রের মাধ্যমে গাড়িতে রং করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পেইন্ট করার কারণ রঙের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় গাড়ির বনেটের ওপর পেইন্টের প্রলেপ যাতে ভালোভাবে লাগে। এই প্রক্রিয়াটিকে পাউডার কোটিং বলা হয়।

তরল মাধ্যম

তরলকৃত পেইন্ট প্রক্রিয়ায় রং সরাসরি ব্রাশের, রোলার, ব্লেড বা অন্য কিছুর সাহায্যে পেইন্ট করা হয়। রোলারের সাহায্যে পেইন্ট করার জন্য রোলারের হাতলটি বেশ লম্বা রাখা হয়, যাতে উঁচু স্থানেও পেইন্ট করতে অসুবিধা না হয়। অপেক্ষাকৃত অর্ধেক বা ছোট আকারের রোলার ব্যবহার করা হয় যদি পেইন্ট করার স্থানটি ছোট বা অসমতল হয়। সাধারণত রোলার দিয়ে রং করলে রঙের প্রলেপ দেয়ালে দুবার দিলে ভালো হয়।

তরল পেইন্ট লাগানোর পর কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। কারণ, এই পেইন্টের সঙ্গে যদি অন্য পেইন্ট লাগানো হয় তাহলে দুটো পেইন্ট ভালোভাবে মিশতে সময় প্রয়োজন। এই সময়টিকে ওপেন টাইম বলা হয়। সাদা স্প্রিরিট মিশ্রিত করে তেলের ওপেন টাইম অথবা এলকালাইড বেইস ইমালসন পেইন্টের ওপেন টাইম বাড়ানো হয়।

গ্যাসীয় মাধ্যম

গ্যাস মিশ্রিত অবস্থায় স্প্রে পদ্ধতিতে পেইন্টকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। স্প্রে করা স্থানে রং আটকে থাকে। একে স্প্রে পেইন্টিং বলে। এই প্রক্রিয়ায় পেইন্টিং খুব ভালো হয় যদি সঠিকভাবে সব নিয়মকানুন মানা হয়। যেমন প্রথমে যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে যে স্থানে বা ঘরে এই প্রক্রিয়ায় পেইন্টিং করা হবে সেখানকার সব আসবাবপত্র, ছবি, টেবিল ইত্যাদি ঘর থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। পরবর্তী কাজ ঘরের মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে দিতে হবে, যাতে মেঝেতে কোনো রং না পড়ে। পরবর্তী কাজ ঘরের দেয়ালকে সম্পূর্ণভাবে সিরিশ কাগজ দিয়ে ঘষা। প্রাথমিকভাবে এ কাজগুলো শেষ করার পর রোলার দিয়ে রং করার কাজটি করলে ভালো হয়। প্রথমবার পেইন্ট করার পর রং দেয়ালে শুকানোর জন্য সময় দিতে হবে। তারপর দ্বিতীয়বার রোলারের মাধ্যমে রং দিতে হবে। লক্ষণীয়, ঘরের দেয়াল পেইন্ট করার পর কমপক্ষে দুই সপ্তাহ দেয়াল ধোয়া যাবে না।

পেইন্টের বহুমুখী ব্যবহার

ইমালসন পেইন্ট বা পানিভিত্তিক রঙে ভেতর ও বাইরের পৃষ্ঠে পেইন্ট করা যায়।

ফ্ল্যাট ফিনিস পেইন্ট ঘরের ছাদে এবং দেয়ালে যেখানে এবড়োখেবড়ো স্থান রয়েছে এমন জায়গায় দেওয়া  হয়, যা পরবর্তী সময়ে রং করা দেয়ালকে সম্পূর্ণ মসৃণ দেখায়।

ম্যাট ফিনিস পেইন্ট ফ্ল্যাট ফিনিসের প্রায় কাছাকাছি তবে খুব সহজে ধোয়া যায়।

এগসেল ফিনিস সাধারণত গোসলখানার দেয়ালে ব্যবহারের জন্য বেশি কার্যকর। এটা সহজেই ধোয়া যায়, পানি লেগে থাকে না এবং দেয়ালে উজ্জ্বল ভাব ধরে রাখে।

পার্ল ফিনিসের স্থায়িত্ব বেশি এবং আর্দ্রতা-নিরোধক। এর উজ্জ্বলতার জন্য এটি বাথরুম, আসবাবপত্র, রান্নাঘরের জন্য উত্তম কিন্তু দেয়ালের জন্য ঠিক নয়। এটি এগসেল থেকেও বেশি উজ্জ্বল।

ভার্নিস এবং সেলাক একটি রক্ষাকারী প্রলেপ কোনো রং পরিবর্তন করে না। এটিও একধরনের পেইন্ট কিন্তু এটাতে কোনো রঞ্জক পদার্থ নেই।

এনামেল পেইন্টের প্রলেপ শুকিয়ে শক্ত হয়ে মসৃণ উজ্জ্বল তল তৈরি করে। এনামেল পেইন্টে গ্লাস পাউডার এবং খুব ছোট ছোট মেটালের টুকরো থাকে। এনামেল পেইন্টে কখনো কখনো ভার্নিস অথবা ইউরোথেন ব্যবহার করা হয় এর উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি এবং কাঠিন্যের জন্য।

ফিঙ্গারপ্রিন্ট একধরনের পেইন্ট, যা সাধারণত হাতের আঙুলের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয় এবং ছোট ছোট পাত্রে পাওয়া যায়।

অ্যান্টিক্লাইম্ব পেইন্ট একটি অশুষ্ক পেইন্ট, যা সাধারণত পিচ্ছিল। এটি ড্রেন পাইপ লাইনে অধিক ব্যবহার করা হয়। সিঁধেল চোর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মইয়ে এ পেইন্ট ব্যবহার করা হয়।

পেইন্টিংয়ে যা লক্ষণীয়

যেসব স্বাভাবিক ত্রুটির জন্য কোনো পৃষ্ঠদেশে সুন্দর ও ভালো পেইন্ট হয় না। তা হলো-

ফোসকা ওঠা : বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, পেইন্ট করার আগে স্থানটি আর্দ্রতাপূর্ণ ছিল কি না তা যাচাই না করেই পেইন্টিং করা হয়, যে কারণে রং করার পর অনেক স্থানেই মনে হয় রঙের ফোসকা পড়েছে।

খড়িমাটির গুঁড়া : যে স্থানটিতে পেইন্ট করা হয় তাতে খড়িমাটির গুঁড়ার প্রলেপ অনেকটা পেইন্টের প্রাথমিক ফিল্ম হিসেবে ধরা হয়। 

ভেঙে যাওয়া : কোনো স্থানে পেইন্টের  প্রলেপ দেওয়ার পর যদি সেখানে অসমানভাবে প্রসারণ বা সংকোচন ঘটে, তাহলে পেইন্ট ফেটে যায়। এটা সাধারণত ঘটে কোনো স্থানে পেইন্ট করার পর সেখানে তা শুকানোর জন্য যথেষ্ট সময় না দেওয়ায়। যদি তা না করে দ্বিতীয়বার পেইন্টের প্রলেপ দেওয়া হয় তাহলে পেইন্ট ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

পেইন্টে ফোসকা পড়া : কোনো স্থানে পেইন্ট করার পর যদি সে স্থানটিতে ফুলে যায় বা ফোসকা পড়ার মতো মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে অসমতল পৃষ্ঠে যে পেইন্ট করা হয়েছে তা দীর্ঘ সময় সূর্যোলোকে উন্মুক্ত অবস্থায় ছিল। 

বিপজ্জনক পেইন্ট : পেইন্টের মধ্যে যেসব উদ্বায়ী পদার্থ রয়েছে, সেগুলো খুবই বিপজ্জনক। পেইন্টকেন্দ্রিক বেশির ভাগ দুর্ঘটনা পেইন্টে নিহিত উদ্বায়ী জৈব পদার্থের জন্য হয়। বর্তমানে পরিবেশবিদদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে অনেক রং প্রস্তুতকারকেরা সহনীয় উদ্বায়ী পদার্থ দিয়ে পেইন্ট তৈরি করছেন, যা পরিবেশবান্ধব।

  • প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৫ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top