প্লাস্টার অব প্যারিসের যত কথা
প্লাস্টারের রকমফের ও ব্যবহার

‘প্লাস্টার’ শব্দটি মূলত জিপসাম প্লাস্টার বা প্লাস্টার অব প্যারিস নামে পরিচিত। প্লাস্টার সিমেন্টের মতো শুষ্ক পাউডার রূপে থাকে। এটা পানিতে মিশিয়ে পেস্ট করা হলে প্রথমে তাপ নির্গত হয় এবং পরবর্তী সময়ে শক্ত হয়ে যায়। প্লাস্টার নরম অবস্থায় স্থিতিশীল। পরে ধাতুর সাহায্যে যেকোনো আকার ধারণ করে। প্লাস্টারের এই গুণাবলির জন্য যেকোনো স্থানে ফিনিশিংয়ে এটির কার্যকারিতা ব্যাপক। এটি ভারবাহী ক্ষমতাসম্পন্ন যৌগ। লাইম প্লাস্টার বা সিমেন্ট প্লাস্টার ভবন নির্মাণের সময় দেয়াল ও ছাদে প্রলেপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

ফিরে দেখা

প্লাস্টার অব প্যারিসের ইতিহাস বেশ পুরোনো। প্রায় নয় হাজার বছর আগে এটি আনাটেলিয়া ও সিরিয়ায় পাওয়া গিয়েছিল। পাঁচ হাজার বছর আগে মিশরীয়রা জিপসামকে উন্মুক্ত বাতাসে পুড়িয়ে চাপ প্রয়োগে পাউডারের মতো গুঁড়ো করত। তারপর ওই পাউডার পানিতে মিশিয়ে পেস্টের মতো করে বড় বড় ব্লকের মনুমেন্টের ভাঙা অংশগুলোকে জোড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করত। উদাহরণস্বরূপ পিরামিডের কথা বলা যেতে পারে। প্রাচীন মিশরীয়রা মানুষের দেহের মডেলও তৈরি করত প্লাস্টার অব প্যারিসের সাহায্যে। গ্রিকবাসী অতিরিক্ত স্বচ্ছ গুণসম্পন্ন জিপসাম ব্যবহার করত বিশেষত মন্দিরের জানালা নির্মাণে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭২-২৮৭ সালে বিজ্ঞানী থিওফ্রেস্টা প্লাস্টারের ধারণা দেন। তখন রোমানরা গ্রিক মূর্তি তৈরিতে প্লাস্টার অব প্যারিস ব্যবহার শুরু করে।

প্লাস্টার অব প্যারিসের বিভিন্ন কারুকাজ

নামকরণ বৃত্তান্ত

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জিপসাম খনির সন্ধানে খনি বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করছিল। প্যারিসের মন্টমেট্রিতে জিপসামের বৃহৎ খনি থাকায় তখন থেকে সাধারণ জিপসাম প্লাস্টারকে ‘প্লাস্টার অব প্যারিস’ বলা হতো। ১৭০০ সালে প্যারিসে কাঠের তৈরি বাড়িতে প্লাস্টার অব প্যারিস ব্যবহার করা হয়। আগুনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ১৬৬৬ সালে ফ্রান্সের রাজা এক প্রকার জোর করেই নিয়ম করেছিলেন, যাতে সব কাঠের বাড়িতে জিপসামের প্রলেপ দেওয়া হয়। এর পেছনে ছিল লন্ডন সিটিতে লাগা আগুন। জিপসামের খনি প্যারিস শহরের কাছে থাকায় সেখান থেকে উত্তোলন করা হতো প্লাস্টার অব প্যারিস।

জিপসাম থেকে প্লাস্টার অব প্যারিস

জিপসাম মূলত মাটির নিচে জমে থাকা এক ধরনের শিলা, যা দীর্ঘদিন সমুদ্রের পানিতে জমে থাকার ফলে ধীরে ধীরে শিলায় রূপান্তরিত হয়। যেহেতু সমুদ্রের পানিতে নানা ধরনের যৌগের সংমিশ্রণ থাকে, তাই জিপসাম সাদা থেকে বাদামি, হলুদ, খয়েরি ও গোলাপি রঙের হয়ে থাকে।

প্লাস্টারের রকমফের

জিপসাম প্লাস্টার 

জিপসাম প্লাস্টার তথা প্লাস্টার অব প্যারিস তৈরি হয় জিপসামকে ১৫০০ সেন্টিগ্রেডে তাপ প্রয়োগের ফলে। এরপর শুষ্ক প্লাস্টার পাউডার পানির সঙ্গে মেশানো হয়। এটা পুনরায় জিপসামে রূপান্তরিত হয়। পাউডার জিপসাম পানিতে মেশানোর পর প্লাস্টার জিপসাম তৈরি হতে ১০ মিনিট সময় লাগে এবং প্লাস্টার অব প্যারিস হতে ৪৫ মিনিট সময়ের প্রয়োজন হয়। যদি প্লাস্টার বা জিপসাম ২০০০ সেন্টিগ্রেড তাপ প্রয়োগ করা হয়, তখন এনহাইড্রাইড জিপসাম তৈরি হয়, যা পানিতে মেশালে পুনরায় জিপসামে পরিণত হয়।

সিলিংয়ের সৌন্দর্যে প্লাস্টার অব প্যারিস

প্লাস্টার সাধারণত কাঠের মসৃণতা বাড়াতে, পাথর বা লৌহ-জাতীয় পদার্থের ওপর ব্যবহার করা হয়। ছবি তৈরিতে ডামি হিসেবে এবং থিয়েটারে এর ব্যবহার প্রচলিত। প্লাস্টার অব প্যারিস শরীরের কোনো স্থানে হাড় ভেঙে গেলে তা জোড়া লাগানোর জন্য ব্যান্ডেজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটা অনেকটা কাদামাটির মতো যেকোনো আকার-আকৃতিতে লেপে দেওয়া যায়।

লাইম প্লাস্টার

লাইম প্লাস্টার হচ্ছে ক্যালসিয়াম হাইড্রো-অক্সাইড ও বালুর সংমিশ্রণ। সাধারণ বায়ুমণ্ডলে যে  কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকে তা প্লাস্টারকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। লাইম প্লাস্টার তৈরি করতে লাইম স্টোনকে (ক্যালসিয়াম কার্বোনেট) উত্তপ্ত করে কুইকলাইমে (ক্যালসিয়াম অক্সাইড) পরিণত করা হয়। পরবর্তী সময়ে পানি মিশ্রিত করে স্ল্যাযাক লাইম (ক্যালসিয়াম হাইড্রো-অক্সাইড) তৈরি করা হয়। এটা বাজারে সাদা পাউডার হিসেবে বিক্রি হয়। এরপর পানি মিশিয়ে পেস্টের মতো ব্যবহার করা যায়। বাতাসের সংস্পর্শে এলে ক্যালসিয়াম হাইড্রো-অক্সাইড ক্যালসিয়াম কার্বোনেটে পরিণত হয়। আর এভাবে প্লাস্টার জমে শক্ত হয়।

লাইম প্লাস্টার সাধারণত দেয়ালে প্লাস্টার করার জন্য ব্যবহৃত হয় বেশি। দেয়াল আরও বেশি মসৃণ করতে কিংবা ছোটখাটো ছিদ্র বা ফাঁক বন্ধ করতে লাইম প্লাস্টার দারুণ কার্যকর। কাঠের কাজে কোনো স্থানে খাঁজ কাটা থাকলে বা এবড়োখেবড়ো থাকলে লাইম প্লাস্টার দিয়ে তা ঢেকে দিলে এদিকে যেমন সুন্দর দেখায়, অন্যদিকে তা বেশ মজবুত হয়। অবকাঠামো নির্মাণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লাইম প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়। কারণ, এর কিউরিংয়ে প্রায় এক মাসের মতো সময় লাগে। প্লাস্টার যাতে স্থায়ীভাবে দেয়ালে অনেক দিন থাকে সে জন্য লাইম প্লাস্টারের কিউরিংয়ে সামান্য প্লাস্টার অব প্যারিস মেশানো হয়। কেননা প্লাস্টার অব প্যারিস খুব সহজেই জমে যেতে পারে। তবে ধীরে ধীরে প্লাস্টারের কিউরিং টাইম কমানো হয়, যদি কোনো বড় অবকাঠামোর জন্য বেশি পরিমাণ প্লাস্টার অব প্যারিস মিশ্রণের প্রয়োজন পড়ে। বর্তমানে মিশ্র এবং বাঁকানো স্থানে প্লাস্টার অব প্যারিস ব্যবহারের মাধ্যমে দেয়ালে নানা কারুকাজ করে ঘরের শোভাবর্ধন করা হচ্ছে। লাইম প্লাস্টারে সুবিধা হচ্ছে, এটি অগ্নিনিরোধক। যদি অগ্নিকাণ্ডের সময় তাৎক্ষণিক ফায়ার এক্সটিংগুইসার সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে ঘরের অভ্যন্তরে ও অবকাঠামোতে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

আস্থাভেদে বিভিন্নরূপে প্লাস্টার অব প্যারিসের

সিমেন্ট প্লাস্টার

সিমেন্ট প্লাস্টার তৈরি হয় বালু, পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট, প্লাস্টার আর পানির সংমিশ্রণে। সাধারণত চুন-সুরকি-সংক্রান্ত নির্মাণকাজে কোনো অবকাঠামোর অন্দর ও বহির্ভাগের দেয়ালকে মসৃণ করার জন্য সিমেন্ট প্লাস্টারের ব্যবহার বেশি। অবকাঠামোর অভ্যন্তর ভাগে শেষ প্রলেপ দেওয়া হয় জিপসাম প্লাস্টারে। দেয়ালের অভ্যন্তরে ইটের গাঁথুনির ওপর সিমেন্ট প্লাস্টারে মসৃণ আবরণ দেওয়া হয়। কিন্তু বাইরের দিকটা তেমন নয়। বিভিন্ন ধরনের সিমেন্টের প্লাস্টার অনেক সময় দেয়ালে স্প্রে করা হয় অগ্নিনিরোধক হিসেবে। পুরু স্তরযুক্ত সিমেন্ট প্লাস্টার বাইরের দিকে দেওয়া হয়, যাতে অগ্নিনিরোধক দেয়াল সুরক্ষিত থাকে।

প্লাস্টার অব প্যারিসের বহুমুখী ব্যবহার

স্থাপত্যশিল্পে 

নান্দনিক সৌন্দর্যের জন্য স্থাপত্যশিল্পে প্লাস্টারের ব্যবহার বেশি হয়। ঘরের অভ্যন্তরে পাথর বা কাঠের ওপর কারুকাজ করে শোভাবর্ধনের জন্য এই উপকরণটির বহুল ব্যবহার প্রচলিত।

ছবি আঁকতে 

আগে ইউরোপে অনেক বড় বড় মুর‌্যাল পেইন্ট করা হতো পানি মিশ্রিত প্লাস্টার দ্বারা। এ অবস্থায় এগুলো অনেক দিন ভালো অবস্থায় থাকত। সরাসরি কাদায়ও প্লাস্টার ঢালাই করে মোল্ড তৈরি করা যায়। সাধারণত কোনো বস্তুর ছাঁচ তৈরির জন্য প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়। ছাঁচটি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় মন্ডটি নতুন কোনো ছাঁচ তৈরির কাজে ব্যবহার করা যায়। টেরাকোটার নকশায় প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টারের পাতলা আবরণ ঢালাই করা কোনো ভাস্কর্যে বেশি ব্যবহার করা হয়। কেননা এটা দামে সস্তা ও এর স্থায়িত্ব বেশি।

চিকিৎসায়

প্লাস্টার মানুষের শরীরে ভাঙা হাড়ের অবলম্বন হিসেবে কাজ করে। প্লাস্টারসহ ব্যান্ডেজ করে ভাঙা হাড়ের ওপর পেঁচিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ভাঙা হাড়টি ঠিক স্থানে সঠিকভাবে জোড়া লাগতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে অর্থোপেডিক কাস্ট। রেডিওথেরাপিতেও প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টার ব্যান্ডেজ ব্যবহৃত হয় রোগীর মাথা বা ঘাড়ে ব্যথা পেলে তার প্রতিচ্ছবি নিতে। দাঁত ভেঙে গেলে নকল দাঁত প্রতিস্থাপনে প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়, যা বেশ শক্ত ও মজবুত। 

আগুন প্রতিরোধে

অনেক আগে থেকেই প্লাস্টার আগুন প্রতিরোধে নিরাপত্তা সহায়ক উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আগে ব্যবহার করা হতো এসবেসটোস ফাইবার হিসেবে আগুন প্রতিরোধের জন্য। কিন্তু বর্তমানে শিল্পকারখানায় প্লাস্টারের ব্যবহার হচ্ছে-

ফাইব্রস (মিনারেল উল এবং গ্লাস ফাইবার দ্বারা তৈরি)।

সিমেন্টের সঙ্গে মিনারেল উল অথবা ভারমিকুলিট সংমিশ্রণে তৈরি হচ্ছে প্লাস্টার।

অবকাঠামোর ভেতরের দেয়ালে যে প্লাস্টার দেওয়া হয় তা অগ্নিনিরোধক গুণসম্পন্ন কমমূল্যের। কিন্তু দেয়ালের বাইরের দিকে প্লাস্টার অধিক গুণসম্পন্ন অগ্নিনিরোধক হওয়ায় মূল্য বেশি।

সীমাবদ্ধতা 

প্লাস্টার অব প্যারিস ব্যবহার করা উচিত নয়, যদি তাপমাত্রা ৪০০ ফারেনহাইটের নিচে থাকে। কখনো ঠান্ডায় জমে থাকা জায়গায় এটি ব্যবহার করা যায় না। অভ্যস্তরস্থ স্থানে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভেজা কিংবা আর্দ্র জায়গায় ব্যবহার করা ঠিক নয়। 

চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্লাস্টার অব প্যারিস

ফুটনোট

সেটিং টাইম প্রাথমিক সময় : ০৫ মিনিট

সর্বশেষ সময় : ১০ মিনিট

কম্প্রেসিভ শক্তি : অঝঞগ-১৯১

রং : সাদা

কিউরিং : প্লাস্টার অব প্যারিস নিজে নিজেই কিউরিং হয়। মোল্ড সরানোর আগে সাধারণ ঢালাইকৃত প্লাস্টার শুকানোর জন্য এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়।

প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৬ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top