শাহ সুজা মসজিদ

মোগলদের ঐতিহ্য বহনকারী ইমারতগুলোর মধ্যে কুমিল্লাহ শাহ সুজা মসজিদ নিঃসন্দেহে সবার ওপরের সারিতে স্থান নেবে। কুমিল্লা জেলার মোগলটুলি এলাকার শাহ সুজার মসজিদ একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যা মোগল যুগের ঐতিহ্যকে ধারণ করে। মোগলদের শাসনকালীন সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সম্রাট সুজা ক্ষমতায় ছিলেন ১৬৩৯ থেকে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। আর সেই সময়েই এই মসজিদ গোমতী নদীর তীরে নির্মিত হয়। এই মসজিদ সম্পর্কে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ কৈলাস চন্দ্র সিংহ তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এটি ইট নির্মিত একটি বৃহৎ মসজিদ। মসজিদটি শাহ সুজা ত্রিপুরা জয়ের পরেই নিজেকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য নির্মাণ করেন। কৈলাস চন্দ্র সিংহ আরও উল্লেখ করেন যে ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দ মানিক্য সুবাদার সুজার নাম চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। যেভাবেই নির্মিত হোক না কেন, এ মসজিদ কুমিল্লার কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এখানে অনেক মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করার জন্যই মূলত এই মসজিদ নির্মিত হয়। মসজিদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ সবাইকে মুগ্ধ করে। প্রতিদিন নতুন নতুন মুসল্লি এখানে আসেন নামাজ আদায় করার জন্য। এই মসজিদটি মোগলটুলি এলাকায় যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা।

মসজিদটি পাকিস্তান-ভারত উপমহাদেশের অন্যতম নিদর্শন। এটি আয়তনে খুব বেশি বড় না হলেও এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করার মতোই। তৎকালীন প্রতিষ্ঠাতাদের আভিজাত্য এবং রুচির পরিচয় বহন করে এই মসজিদটি। মসজিদটির সামনেই রয়েছে একটি সুন্দর দরজা। প্রবেশদ্বারের ঠিক আগেই রয়েছে কোরআন শরিফের একটি সুন্দর প্রতিকৃতি। মসজিদটি মূলত প্রবেশদ্বারের ভেতর দিয়ে হেঁটে পশ্চিম দিকে স্থাপিত। পূর্বদিকের মাঝখান বরাবর প্রধান প্রবেশদ্বার রয়েছে। এই প্রবেশদ্বারটি দোতলাবিশিষ্ট এবং ওপরে খুব সুন্দর ছাদ রয়েছে। মসজিদটি মূলত পশ্চিম প্রান্তে নির্মিত। এটি বাহ্যিকভাবে ১৬.৮৮ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭.৩৯ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট। মসজিদের চারপাশে অষ্টাভুজ আকৃতি চারটি টাওয়ার রয়েছে। টাওয়ারগুলো বেশ উঁচু, যার প্যারাপেট এর ওপরে গিয়ে অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে। ওপরে পদ্ম এবং কলসাকৃতির ডিজাইনে শোভা বর্ধন করেছে। চারপাশের এই টাওয়ারগুলো পুরো মসজিদকে যেন বেষ্টন করে রেখেছে এবং সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে অন্যান্য মসজিদের মতোই তিনটি গম্বুজ রয়েছে। প্রতিটি খিলান চার কেন্দ্রে। আবার ঠিক মসজিদের অভ্যন্তরে পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে, যা পূর্ব প্রান্তের দরজাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করে। পূর্ব পাশের কেন্দ্রীয় খিলান এবং পশ্চিম পাশের কেন্দ্রীয় মিহরাব তুলনামূলকভাবে তাদের উভয় পাশে খিলানের তুলনায় প্রশস্ত।

শাহ সুজা মসজিদ প্রাঙ্গণ, কুমিল্লা। ছবি: উইকিমিডিয়া

ভেতরের স্থানটি তিনটি গম্বুজ দ্বারা আবৃত। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি অন্য দুটির তুলনায় বড়। প্রতিটি গম্বুজ একটি ড্রাম আকৃতির বিমের ওপর স্থাপন করা হয় এবং মুকুট হিসেবে পদ্ম এবং কলস ডিজাইন করা হয়, যা প্রতিটি মোগল স্থাপনার চিহ্ন। তিনটি গম্বুজের মধ্যে কেন্দ্রীয় গম্বুজটি খিলানাকৃতির। গম্বুজের বেইজ মূলত অষ্টকোনাকৃতির, যা সাধারণত মোগল আমলের মসজিদগুলোতে দেখা যায় না। পুরো ভবনটি সাদা রঙে রঞ্জিত। এ রকম সাদা রঙের মসজিদ ও মোগল স্থাপনাগুলোতে বেশ বিরল। যদি ও ধারণা করা হয় শুরুতে মসজিদটি এরকম রঙের ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংস্কার করে এঁকে সাদা করা হয়েছে। মসজিদের গায়ে সাদা ও সবুজের মিশ্রণে যে ডিজাইন, সেটাও অন্যান্য মোগল স্থাপনার থেকে এটিকে বেশ আলাদা রূপ দান করেছে। সব মিলিয়ে এই মসজিদ বেশ দৃষ্টিনন্দন ও সব মোগল স্থাপনার মধ্যে বেশ আধুনিক।

বিজয়া চৌধুরী

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৫ তম সংখ্যা, মে ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top