ঢাকার পরিবেশগত অবক্ষয় ও উন্নয়ন (পর্ব-২)

ঢাকার মহাপরিকল্পনা
১৯৪৭ সালে পাক-ভারতের স্বাধীনতার পর ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী করা হয়। বৃহত্তর (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-টঙ্গীর সমন্বয়ে) ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য ১৯৫৬ সালে গঠন করা হয় ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (DIT)। ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ উপদেষ্টাদের তত্ত্বাবধানে প্রণীত হয় ঢাকার প্রথম মহাপরিকল্পনা (Master Plan)। ৩২০ বর্গমাইল এলাকার ওপর প্রণীত ওই মহাপরিকল্পনার প্রতিবেদনে অনেক সুপারিশ ছিল; তন্মধ্যে এলাকাভিত্তিক (Zonal) প্ল্যান প্রণয়ন করে পর্যায়ক্রমে নগরের উন্নয়ন, বন্যাপ্রবণ ভূমির সংরক্ষণ, উত্তর দিকে (মিরপুর-টঙ্গী-সাভার এলাকায়) উঁচু ভূমিতে নগরের সম্প্রসারণ, কুর্মিটোলার পাশে ফয়েদাবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশবিশেষ স্থানান্তর এবং বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে জিনজিরায় রাষ্ট্রীয় স্থাপনা (পার্লামেন্ট কমপ্লেক্স) নির্মাণের প্রস্তাবনা ছিল উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া নগরের অভ্যন্তর থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক স্থাপনাগুলোও অপসারণের সুপারিশ ছিল।

পাঁচ বছর অন্তর অন্তর সুপারিশ ছিল মহাপরিকল্পনাটির মূল্যায়নেরও। কিন্তু ২০ বছর মেয়াদের (১৯৫৯-৭৯) জন্য প্রণীত ওই মহাপরিকল্পনার আওতায় একটি এলাকার জন্যও ‘জোনাল’ প্ল্যান প্রণীত হয়নি। হয়নি মহাপরিকল্পনাটির পুনর্মূূল্যায়ন। বরং মহাপরিকল্পনার সুপারিশের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ১৯৬২ সালে সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের পর তড়িঘড়ি করে তেজগাঁওয়ের পশ্চিমে মহাপরিকল্পনায় Experimental Farms এলাকা হিসেবে চিহ্নিত জায়গায় ‘আইয়ুব নগর’ (স্বাধীনতার পর থেকে যা ‘শেরেবাংলা নগর’ নামে) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেখানে নির্মিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের পার্লামেন্ট কমপ্লেক্স। পাশাপাশি তখন বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা; যেমন-দিলকুশা-মতিঝিল, কাওরান বাজার, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, গুলশান-বনানী, উত্তরা, টঙ্গী শিল্প এলাকা ইত্যাদির পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু ঢাকার অভ্যন্তরে বিমানঘাঁটি, ক্যান্টনমেন্ট ও পিলখানায় রাইফেল কমপ্লেক্স রয়ে যায় এবং উত্তরোত্তর এসব জায়গার অধিকতর সম্প্রসারণ ঘটে। 

জলাভূমি ভরাট করে চলছে আবাসন প্রকল্প
জলাভূমি ভরাট করে চলছে আবাসন প্রকল্প

স্বাধীনতা-উত্তরকালে ঢাকার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কর্মকৌশল নির্ধারণে ১৯৭৯-৮২ সালে ইউএন হ্যাবিটেটের সহায়তায় DMAIUDP শীর্ষক একটি সমন্বিত কৌশলগত সমীক্ষা করা হয়। কিন্তু সমীক্ষাটির বিভিন্ন সুপারিশমালা সামরিক শাসক এরশাদের কাছে উপেক্ষিত হয়। বরং তখন প্রেসিডেন্ট এরশাদের নিজস্ব দর্শনে ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নকাজ গৃহীত হয়, যার বেশির ভাগই ছিল ঢাকার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। যেমন- কাঁঠালবাগান ও কলাবাগান খাল ভরাট করে ‘পান্থপথ’ সড়কটির নির্মাণ; ধানমন্ডি ও গুলশান-বনানীর লেক ভরাট করে দলীয় লোকজনকে প্লট বরাদ্দ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী-রামপুরা খালটি ভরাট করে সেখানে পূর্ব-পশ্চিমে একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্যও ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু, ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও রামপুরা খাল নিয়ে শহরের পানিনিষ্কাশনের প্রয়োজনে ওই সড়কটির নির্মাণ পরিকল্পনা আটকে যায়। ওই অবস্থায় ১৯৯৫ সালে বৃহত্তর ঢাকার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য ২০ বছর মেয়াদী নতুন মহাপরিকল্পনা ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান’ (১৯৯৫-২০১৫) প্রণীত হয়। উগউচ শীর্ষক এই পরিকল্পনার আওতায় রয়েছে Structure Plan, Urban Area Plan ও Detailed Area Plan (DAP)। ডিএমডিপি’র প্রধান আকর্ষণ ছিল ‘DAP’। কিন্তু এটির প্রণয়ন শেষ ও কার্যকর হতে অনেক সময় লেগে যায়।এর মধ্যে এতে প্রস্তাবিত অনেক সুপারিশই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

এমনিতে এই কৌশলগত পরিকল্পনার কিছু সুপারিশও ছিল বিতর্কিত! যেমন- রাজউকের স্বঅর্থায়নে ১৯৯৪-৯৬ সালে গৃহীত ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পটির জায়গায় ডিএমডিপি’তে ক্যান্টনমেন্ট স্থাপনের সুপারিশটি হতবাক করে দেওয়ার মতোই ছিল! হালে রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পটিকে ঘিরে এর আশপাশে আরও অনেক চমকপ্রদ ও বাহারি নামের পূর্বাচল প্রকল্প শুরু হয়েছে। DAP এর পাশাপাশি আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা বা STP- যেটির বাস্তবায়নও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অথচ একটা দীর্ঘ সমীক্ষা (DITS) এর মাধ্যমে দেশ-বিদেশের নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ২০০৩-০৮ সালে এই STP প্রণীত ও অনুমোদিত হয়। এতে নগরের স্থল, নৌ-পথের উন্নয়ন এবং আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা (MRT, BRT, LRT ইত্যাদি) সমন্বয়ে বৃহত্তর ও আশপাশের জেলাসমূহের সার্বিক পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু আজ অবধি এসব প্রস্তাবনা তেমন বাস্তব রূপ লাভ করেনি। কারণ, ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার’-মার্কা DTCA (ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ) নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই পরিকল্পনাটির নিয়ন্ত্রক। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে রাজধানীর গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নে নগরের উত্তর-দক্ষিণে মেট্রোরেল (MRT-6) এবং একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেস নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা বিভিন্ন সমস্যায় (বিশেষ করে এর রুট/এলাইনমেন্ট চূড়ান্তকরণে) পড়ে ঝুলে আছে। ওই দুটি প্রকল্পেন বাস্তবায়নে দাতা সংস্থার (জাইকার) অনুদান (মেট্রোরেলের জন্য) লাভ এবং ‘ইতাল-থাই’ নামক একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে PPP-এর ভিত্তিতে (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য) চুক্তি সম্পাদনের পরও প্রকল্প দুটির আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি নেই। পাশাপাশি এসটিপি ও ডিএমডিপি/ড্যাপের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিভিন্ন সংস্থার অধীনে স্ব-স্ব পরিকল্পনা ও উদ্যোগে ঢাকায় বিচ্ছিন্নভাবে ফ্লাইওভার, ওভার পাশ ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত কাজের বাস্তবায়ন চলছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে নগরের যানজট সমস্যা নিরসনের চেয়ে তা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার
গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার

অন্যদিকে, বিআইডব্লিউটির অধীনে ঢাকার চারদিকে বিদ্যমান নদী/নৌ-পথকে ব্যবহার করে ২০০৪-০৫ সাল থেকে একটি Circular Water-Ways গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তুরাগ-বুড়িগঙ্গা নদীকে ড্রেজিং করে টঙ্গীর আশুলিয়া থেকে কাঁচপুর/ইছাপুর পর্যন্ত ১০টি ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কোটি টাকার খরচ হয়েছে, অথচ এই নৌ-পথটিকে এখনো কার্যকরভাবে চালু করা যায়নি। নগর অভ্যন্তরের ভয়াবহ যানজট পরিস্থিতি প্রেক্ষিতে অতি সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই নৌ-পথটিকে কার্যকরকরণে আবার একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, কিন্তু বিরাজমান পরিস্থিতিতে (বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে) এই উদ্যোগ কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এ ধরনের আরেকটি আলোচিত পরিকল্পনা হচ্ছে ঢাকার পূর্বদিকে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ কাম Eastern Bypass নির্মাণ। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর নগরের পশ্চিম দিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কাম Circular Road-টি (টঙ্গী ব্রিজ থেকে লালবাগ পর্যন্ত) মোটামুটিভাবে চালু হলেও অদ্যাবধি পূর্বদিকে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ কাম Eastern Bypass নির্মাণে কোনো অগ্রগতি নেই। ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর ২০০০ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে এই বহুল আলোচিত প্রকল্পটির প্রকল্প সারপত্র (DPP) অনুমোদিত হলেও অদ্যাবধি সরকারের পক্ষ থেকে এটির বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দ না করায় বা দাতা সংস্থার কাছ থেকে কোনো অনুদান না পাওয়ায় প্রকল্পটি ঝুলে আছে। তবে সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্রকল্পটি নিয়ে আবারও শুরু হয়েছে তোড়জোড়। আর এর মধ্যে প্রকল্পটি সংশোধিত মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় চারগুণ অর্থাৎ ২০০০ সালের প্রাক্কলিত মূল্য দুই হাজার কোটির স্থলে বর্তমানে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা (যার বেশির ভাগই ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় বৃদ্ধি বাবদ)।

বাস্তবতা হলো, বর্তমানে ঢাকায় জমির অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধিতে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই সময়মতো বাস্তবায়ন বা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। MRT-6 ও Elevated Expressway নির্মাণের কাজও এই একই কারণে এগোচ্ছে না। DMDP ও STP-তে প্রস্তাবিত বিভিন্ন ধরনের অন্যান্য অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে কিছু জনগুরুত্ব প্রকল্পের বাস্তবায়নে Fast Track Development এপ্রোচ/প্রচেষ্টা চালিয়েও অদ্যাবধি তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অনুরূপ বিভিন্ন কারণে, সরকারের পক্ষ থেকে PPP-এর মাধ্যমে ঢাকায় ও দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে ভালো ধরনের Concessions প্রদানের আশ্বাস দিয়ে বিনিয়োগকারী পাওয়া যাচ্ছে না। এহেন পরিস্থিতিতে বর্তমানে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সাহায্যপুষ্ট ‘সিটি রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান’ (CRDP/RDP)-এর আওতায় ‘মেট্রো ঢাকা’র নতুন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। বরাবরের মতো এই পরিকল্পনাটির মুখ্য উপদেষ্টারাও বহিরাগত। তবে আগে সব মহাপকিল্পনা প্রণয়নে কাজ করেছে ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা, আর এবার কাজ করছে এশিয়ান’রা। প্রথম মহাপরিকল্পনা (১৯৫৯ সালের) প্রণয়নে ছিল ব্রিটেনের ‘মিনোপ্রিয়ো, স্পেন্সলি ও পি-ডব্লিয়ু ম্যাকফার্লেন’ নামক উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান; দ্বিতীয় মহাপরিকল্পনা (১৯৫৯ সালের) প্রণয়নে ছিল ব্রিটিশ-আমেরিকান ‘মট ম্যাকডোনাল্ড অ্যান্ড কার্লপিন’ নামক প্রতিষ্ঠান, আর এবারকার মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘স্যামওয়াং করপোরেশন’ অ্যান্ড ‘হ্যান আরবান ইনস্টিটিউট’ নামক একটি কনসোর্টিয়াম। তাই অপেক্ষার পালা এবার এশিয়ার বিশেষজ্ঞরা মেগাসিটি ঢাকার জন্য কী ধরনের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা দেখার!   

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একাংশ
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একাংশ

কিছু সুপারিশ
ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের পরিবেশ, জলবায়ু, জীবনপদ্ধতি ও আর্থসামাজিক অবস্থার বিবেচনায় ঢাকার উন্নয়নের জন্য প্রণীত পরিকল্পনাগুলোর দর্শন ছিল- ‘Live with Floods’. কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বিশাল জনস্রোতের প্রবাহে ওই দর্শনটি আর থাকেনি। নগরের পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তীর্ণ জলাভূমি ও খাল-নালাগুলোর অনেকাংশ ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে বসতি। এর জন্য অন্য যে বিষয়টি দায়ী তা হলো- দেশের সবকিছু ঢাকামুখী করে ফেলা। ফলশ্রুতিতে ঢাকার প্রথম মহাপরিকল্পনার অকাল মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মহপরিকল্পনারও (DMDP) একই পরিণতি। অবশ্য এর জন্য  দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতার অভাবও দায়ী। স্বাধীনতার আগে ঢাকায় যেখানে জনসংখ্যা ছিল পাঁচ লাখের মতো। ২০ বছরের প্রথম মহাপরিকল্পনা প্রণয়নকালে ধারণা করা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে ঢাকা জনসংখ্যা হবে আট-নয় লাখের মতো, সেখানে ১৯৭৪-৭৫ সালে ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫-২০ লাখ। এই অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে বর্তমানে ঢাকায় জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে দেড় কোটির ওপর। নির্মাণযোগ্য জমির স্বল্পতায় এখন সর্বত্র বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে। নগরের পরিসীমা গিয়ে দাঁড়িয়েছে আশপাশের জেলা অবধি।

অন্যদিকে, বহুদিন পর ঢাকার উন্নয়নের জন্য একটি Detailed Area Plans (DAP) প্রণীত হলেও রাজউকের প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা ও নগরের উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এটির যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। এই অবস্থায় ২০১৫ সালে এই DAPটির কার্যকাল শেষ হতে চলেছে। তবে অনেক নগরবাসীর অভিযোগ, এই DAP-এর কিছু অসামঞ্জস্য প্রস্তাবনার কারণে নগরের সম্প্রসারণ আটকে গেছে। প্রত্যাশিত ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র না পেয়ে যেখানে যা হওয়ার নয়, বিনা অনুমতিতে তা-ই হয়ে চলেছে। STP-এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। রাজউকের পরিকল্পিত নতুন/উপশহরগুলোর (পূর্বাচল/উত্তরা ৩য় পর্ব/ঝিলমিল) উন্নয়নও কাঙ্খিত গতিতে হয়নি। ফলে মূল শহরের ওপর আগের মতো ছাপ অব্যাহত রয়েছে। সার্ভিসেসের স্বল্পতায় ওয়াসা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষ তাদের সংযোগ দিতে পারছে না। সম্প্রতি এক জরিপ বলছে, ঢাকার ৭৩ শতাংশ উন্নয়নই অপরিকল্পিত এবং শহরের ভেতর-বাইরে মারাত্মক পরিবেশদূষণের কারণে মানুষ নানা ধরনের রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে। ফরমালিনের গণব্যবহারে মাছির সঙ্গে এখন মশাও অদৃশ্য প্রায় (দৈনিক বার্তা, ৭ জুলাই ২০১৪)। এসব বিভিন্ন কারণে, কয়েক মাস আগে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষায় ঢাকাকে ‘বসবাসের অযোগ্য’ শহর হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার এই দুর্নাম ঘোচাতে তথা ভবিষ্যতে আমাদের নিজস্ব আঙ্গিকে একটা পরিকল্পিত রাজধানী গড়ার প্রয়াসে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে-

  • ঢাকার নতুন মহাপরিকল্পনা (CRDP/RDP) প্রণয়ন শেষ হওয়ার আগেই নগর উন্নয়ন আইনকে যথাযথভাবে সংশোধন করে সংশ্লিষ্ট ধারা-উপধারায় প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিবর্তনসহ রাজউকে পর্যাপ্ত নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী ও অন্যান্য কারিগরি জনবল নিয়োগ করে নগরের পরিকল্পিত বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
  • ঢাকার অভ্যন্তর হতে অনেক কিছুকে বাইরে পাঠিয়ে (Decentralized) দিতে হবে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, বিমান, নৌবাহিনী, রাইফেলস (বিজিবি) এর সদরদপ্তর নগরের বাইরে স্থানান্তর করে জায়গাগুলোর Re-Planning/Re-Development করা যায়। একইভাবে পূর্বাচল নতুন শহর এলাকাকে মালয়েশিয়ার ‘পুত্র-জায়া’র মতো ঢাকার বিকল্প প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া যায়। 
  • STP-এর প্রস্তাবনা মোতাবেক ঢাকায় পরিবহনব্যবস্থা সচল করার জন্য MRT, BRT, LRT চালু করার বিকল্প নেই। বিচ্ছিন্নভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিবর্তে সমন্বিতভাবে নগর জুড়ে ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড রোড নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে। 
  • ঢাকার চারদিকের নদীগুলোর বেদখলকৃত জায়গা উদ্ধার ও ড্রেজিং করে ঈরৎপঁষধৎ নৌপথটি সক্রিয় করতে হবে। নদীর ধারে যেসব পানি ও পরিবেশদূষণকারী শিল্প স্থাপনা রয়েছে তার সবগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে Effluent Treatment Plant (ETP) স্থাপন করতে হবে। কালবিলম্ব না করে রায়েরবাজার থেকে ট্যানারি শিল্প এলাকাটি সাভারে নির্ধারিত জায়গায় স্থানান্তর করতে হবে।
  • ঢাকার চতুর্দিকে বাইপাশ সড়ক নির্মাণ করে নগরের ভেতর দিয়ে আন্তজেলা গাড়ি চলাচল বন্ধ করা হলে নগরে যানজট সমস্যা অনেকাংশে নিরসন হবে।
  • মেগাসিটি বিবেচনায় ঢাকার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সমন্বয়ের দায়িত্ব সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে নেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য একজন সিনিয়র মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি Apex Body প্রতিষ্ঠা করা যায়।

সবকিছু নির্ভর করছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর, যিনি পর পর দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। প্রতিনিয়ত রাজধানী ঢাকা ও নগরবাসীর দুরবস্থা নিরসনের কথা বলছেন। এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের নিয়ে একটি Think Tankও গঠন করা উচিত, এভাবেই নিজ দেশের উন্নয়ন করেছে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি-কুয়ান। 

মো. এমদাদুল ইসলাম
প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক।

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৪ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top