স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভবন ও এর নিরাপত্তা

আমরা যারা এ নগরের বাসিন্দা বুঝে কিংবা না বুঝেই ফ্ল্যাট বা বসতবাড়ির সম্মুখপাশ হোক দক্ষিণে-এটাই পছন্দ করি। কিন্তু কেন? যদি তা হয় উত্তর, পূর্ব কিংবা পশ্চিমে, ক্ষতি কী তাতে? হ্যাঁ পাঠক, আসুন জেনে নেই ভবন ওরিয়েন্টেশন, জনস্বাস্থ্য ও বাসস্থানে নিরাপত্তা সম্পর্কিত দরকারি কিছু নিয়মকানুন। বাংলাদেশে ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু ও আবহাওয়াজনিত কারণে আলো ও বাতাসের প্রবাহ ফ্ল্যাট বা বসতবাড়ির সম্মুখপাশ দক্ষিণ দিকেই হওয়া উত্তম। কেননা, বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ুর কারণে বায়ু প্রবাহিত হয় উত্তর-দক্ষিণে। তাই উত্তর ও দক্ষিণের দরজা-জানালা বা যেকোনো ওপেনিং স্পেস দিয়ে ফ্ল্যাটে খুব সহজেই প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেশন পাওয়া সম্ভব।

কোনো নির্দিষ্ট দিকে ভবনের সম্মুখ দেখিয়ে প্ল্যান করতে হয়, যাতে বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক দান উপভোগ করতে পারে। ভবনের ওরিয়েন্টেশন এমন হওয়া উচিত, যাতে ভবনে সর্বাধিক বা সর্বনিম্ন আলো বা বাতাস প্রবেশ না করে। এ ক্ষেত্রে প্লটের আকার, আয়তন, রাস্তার দিক ও অবস্থান প্রভৃতি নিয়ামক বিবেচনা করে স্ব-স্ব ভবনের দিকস্থিতি স্থির করা হয়। ভবনের সঠিক অবস্থান নির্নয়ে যথাসম্ভব কক্ষের ব্যবহারগত প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। আমাদের জানা সূর্যের আলো স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি। সকাল ও বিকেলে সূর্যের তাপ থাকে কম, তাই তা ভবনে প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা উচিত। বায়ুপ্রবাহ, সূর্যের অবস্থান ও ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় ভবন স্থাপনের অপর নাম দিকস্থিতি। ভবনে বায়ুপ্রবাহ-সূর্যকিরণ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তির ক্ষতিমুক্ত সুবিধা লাভই দিকস্থিতির উদ্দেশ্য। সাধারণত বিল্ডিং ওরিয়েন্টেশনের সময় যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা উচিত-

  • শীতের সময় সবচেয়ে বেশি আর গরমের সময় সবচেয়ে কম সূর্যের তাপ যেন ভবন পায়।
  • গ্রীষ্ম প্রধান দেশে লিভিংরুম দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে হওয়া উচিত। কিন্তু বারান্দা, বাথরুম, স্টোর ইত্যাদির মাধ্যমে উষ্ণতা প্রতিরোধের জন্য শেষ প্রান্তে বারান্দা, বাথরুম বা স্টোর করা যেতে পারে। দক্ষিণে বারান্দা হবে; থাকবে সানশেড বা সানব্রেকার।
  • বহিঃস্থ দেয়ালে সূর্যের কিরণের তীব্রতা কমাতে ডালপালযুক্ত গাছ লাগানো যেতে পারে।
  • গরম ও আর্দ্র এলাকায় বাতাস প্রবাহের দিকে ওরিয়েন্টশন হওয়া উচিত।
  • ওরিয়েন্টশনের জন্য কক্ষের অবস্থান, বিশেষ আকৃতি, বহিঃস্থ পৃষ্ঠ ও সঠিক ভেন্টিলেশন বিবেচ্য।

ভবনে বসবাসের জন্য স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এ দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সব ভবনের স্বাস্থ্য ও জননিরাপত্তা সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নীতিমালা- 

ডিজাইনকৃত ভবনে বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা
ডিজাইনকৃত ভবনে বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা

আলো ও বায়ুপ্রবাহ

  • প্রতিটি ইমারতে জানালা, স্কাইলাইট (Skylight), ফ্যানলাইট (Fanlight), ও দরজার মাধ্যমে অথবা অন্য যেকোনো প্রাকৃতিক উপায়ে স্বাভাবিক আলো-বাতাসের প্রবাহ রাখতে হবে।
  • আবাসিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত কক্ষের জানালার ক্ষেত্রফল ও কক্ষের মেঝের ক্ষেত্রফল ন্যূনতম ১৫ শতাংশের সমান হতে হবে। যার কমপক্ষে অর্ধেকটা খোলা থাকবে। তবে রান্নাঘর, টয়লেট ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার বিধি ৫৮(ঘ) ও বিধি ৫৮(গ)-এর বিধান মানতে হবে।
  • যদি ইমারতে যথাযথ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, যান্ত্রিক বায়ুপ্রবাহ এবং কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা থাকে, সেসব ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উপায়ে আলো ও বায়ুপ্রবাহের ব্যবস্থা না থাকলে চলবে।
  • বেসমেন্টে সব ধরনের প্রয়োজনীয় আলো, পানি ও বর্জ্য নিষ্কাশন ও বায়ুপ্রবাহ (প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম) ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বায়ুপ্রবাহের ক্ষেত্রে প্রতিটি বেসমেন্টে পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ভবনাভ্যন্তরের খোলামেলা কর্ম পরিবেশ
ভবনাভ্যন্তরের খোলামেলা কর্ম পরিবেশ

দ্রষ্টব্য
যান্ত্রিক বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকলে শ্যাফটের মাপসমূহ যান্ত্রিক ডিজাইনের প্রয়োজনের ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে।
ভবনের বহিরাঙ্গনে সংস্থানকৃত এয়ারওয়েল বা লাইট ওয়েলের ক্ষেত্রে এবং আবশ্যিক উন্মুক্ত স্থানের সঙ্গে সংযুক্ত এয়ার ওয়েল বা লাইট ওয়েলসমূহের জন্য এই ন্যূনতম পরিমাপ প্রযোজ্য হবে না।

ভবনের চারপাশের উন্মুক্ত পরিসর

সীমানা দেয়াল
আবাসিক ভবনের ক্ষেত্রে সীমানা দেয়ালের উচ্চতা তিন মিটারে অধিক হতে পারবে না, যা সংলগ্ন রাস্তার সর্বোচ্চ বিন্দু থেকে পরিমাপ করা হবে এবং সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৭৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত নিরেট ও বাকি অংশ বায়ু চলাচলের জন্য জালি অথবা গ্রিল করা যাবে।
সরকারি ও বিশেষ ভবনের ক্ষেত্রে সীমানা দেয়ালের প্রয়োজন হলে দৃষ্টি নিক্ষেপণের সুবিধার্থে প্রাথমিকভাবে জালি বা গ্রিল ব্যবহার করতে হবে।
উপবিধি (১) ও (২) ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে উচ্চতা ২ দশমিক ৭৫ মিটারের বেশি হতে পারবে না, যা সংলগ্ন রাস্তার সর্বোচ্চ বিন্দু থেকে পরিমাপ করা হবে, যাতে পার্শ্ব ও পশ্চাতের দিকে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৭৫ মিটার পর্যন্ত নিরেট এবং বাকি অংশ বায়ু চলাচলের জন্য জালি বা গ্রিল ব্যবহার করা যাবে। সম্মুখ অংশে সর্বোচ্চ এক মিটার পর্যন্ত নিরেট করা যাবে। বাকি অংশ বায়ু চলাচল ও দৃষ্টি নিক্ষেপণের জন্য জালি বা গ্রিল ব্যবহার করতে হবে এবং
পাহাড় বা আসমান সাইটে সীমানা দেয়ালের উচ্চতা প্রতিটি স্থানের মধ্যবর্তী বিন্দু থেকে হিসাব করতে হবে এবং এ রকম স্থানের আনুভূমিক দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ০ মিটারের বেশি হবে না।

পানি সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালি ও নর্দমা

  • সব ইমারতের পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্য বিধানের যথাযোগ্য সুবিধা থাকতে হবে।
  • যেখানে সরকারি পয়ঃপ্রণালির ব্যবস্থা রয়েছে, ইমারতের সব পয়ঃপ্রণালি এবং ময়লা পানি বা ওয়েস্ট ওয়াটার নির্গমন পথের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।
  • যেখানে কোনো সাধারণ পয়ঃপ্রণালি নেই অথবা থাকলে কর্তৃপক্ষ যদি বহির্নির্গমন পথসমূহকে তার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হতে না দেয়, তাহলে নির্দিষ্ট আকার এবং অবস্থানে সেপটিক ট্যাংক ব্যবহার করে বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করতে হবে। সোকপিট ব্যবহার করে নোংরা পানি নিষ্কাশন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ অনুমোদনের জন্য প্রস্তুতকৃত লে-আউট নকশায় সেপটিক ট্যাংক ও সোকপিটের অবস্থান প্রদর্শন করতে হবে।
  • ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি এবং ভূমি থেকে পানি রাস্তার নর্দমায় অথবা অন্য কোনো নির্গমন প্রণালিতে নির্গমন (অথবা পুনর্ব্যবহরের জন্য সংরক্ষণ)-এর জন্য পর্যাপ্ত সুব্যবস্থা ইমারতে থাকতে হবে, যা ইমারতের এবং ইমারতসংলগ্ন অন্যান্য ইমারতের দেয়াল অথবা ভিত্তিতে কোনো ধরনের আর্দ্রতা অথবা ক্ষতি ঘটাবে না এবং ছাদ থেকে নির্গত পানিসংলগ্ন সম্পত্তি বা সাধারণ জনগণের ব্যবহৃত জায়গায় বা সড়কে পড়তে পারবে না।
সূর্যালোক প্রবেশের জন্য সুবিন্যস্ত ছাদ
সূর্যালোক প্রবেশের জন্য সুবিন্যস্ত ছাদ

বর্জ্য নিষ্কাশন

  • সাইটের আঙ্গিনায় গৃহস্থালি ও অন্যান্য বর্জ্য সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট করে জায়গা রাখতে হবে।
  • হাসপাতাল, পরীক্ষাগার, শিল্পকারখানা-জাতীয় যেসব প্রতিষ্ঠান কঠিন, রাসায়নিক ইত্যাদি বর্জ্য তৈরি করে, সেসব জায়গায় তা সংগ্রহ ও নিরাপদ নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  • কোনো প্রকার বর্জ্য সরাসরি জলাশয় বা খাল, বিল ও নদীনালায় ফেলা যাবে না এবং
  • রাসায়নিক বা বিষাক্ত বর্জ্য শোধন না করে নর্দমা, ড্রেন, ডাস্টবিন, পয়োনালা, জলাধার এবং উন্মুক্ত স্থানে নিষ্কাশন বা মাটির নিচে পুঁতে রাখা যাবে না।

খোলা বৈদ্যুতিক তার অন্যান্য ইউটিলিটি
খোলা বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য ইউটিলিটির ক্ষেত্রে  যে ছক অনুসরণ করতে হবে-

যদি এসব ইউটিলিটির লাইন জমির ওপর দিয়ে মাটি ঘেঁষে বা জমির নিচ দিয়ে যায় এবং এই লাইনগুলো নির্মাণকাজের সুবিধার্থে পরিবর্তন করতে হয়, তবে এই পরিবর্তনের খরচ আবেদনকারীকে বহন করতে হবে এবং এই ক্ষেত্রে ঢাকা সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত সড়ক খনন এবং পুনর্নির্মাণবিষয়ক নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।

এলইডি আলোয় আলোকিত ভবন
এলইডি আলোয় আলোকিত ভবন

অগ্নি নিরাপত্তা

  • ইমারত ব্যবহারকারীদের সঠিক নিরাপত্তার জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অগ্নি নির্বাপণ নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পরিশিষ্ট-১ অনুযায়ী নিশ্চিত করতে হবে।
  • সব ইমারতে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) জরুরি প্রস্থান প্রদর্শনকারী দিক চিহ্ন থাকতে হবে এবং
  • যন্ত্রচালিত ওঠানামার ব্যবস্থা (লিফট) ফায়ার এক্সিট (Fire Exit) হিসেবে ব্যবহৃত হবে না।

প্রকৌশলী সুবীর কুমার সাহা
engr_subir.bandhan@gmail.com

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৩ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top