কয়েক দিন পরই কোরবানির ঈদ। উৎসবের এ আনন্দে মিলবে কয়েক দিনের ছুটি। নানা কারণে যাঁদের রোজার ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়নি, পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপনে এবারের ছুটিটা তাঁরা কোনোভাবেই মিস করতে চাইবেন না। উৎসবকালীন তাই রাজধানীসহ বড় শহরগুলো হয়ে পড়ে অনেকটাই ফাঁকা। ফাঁকা শহরের মতোই পড়ে থাকে আপনার ফাঁকা বাসাটা। কিছুটা অরক্ষিত ও নিরাপত্তাহীন। এ সুযোগে বাসাবাড়িতে ঘটতে পারে মারাত্মক সব দুর্ঘটনা। যেহেতু বাড়িতে থাকে মূল্যবান সব সামগ্রী, তাই দুশ্চিন্তায় হয়তো আপনার ঈদ-আনন্দটাই ফিকে হতে পারে। তাই জেনে নিন বাড়িতে কেউ না থাকলেও কীভাবে তা সুরক্ষিত রাখা যাবে। এই তথ্যগুলো শুধু উৎসবকালীন ফাঁকা বাড়ির জন্যই নয়, বরং জানমালের নিরাপত্তায় সব সময়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বাসা ছাড়ার কিছুদিন আগে
বাড়িকে ঘিরে উজ্জ্বল আলোর বলয় তৈরি করুন। সাধারণত দেখা যায়, বাসার ভেতরে ঝলমলে আলো থাকলেও বাইরে থাকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনে রাখবেন, অন্ধকারেই অপরাধ বেশি হয়। তাই রাতে বাসার চারপাশ আলোকিত রাখার ব্যবস্থা করুন, যাতে চোর আসতে ভয় পায় এবং অপরাধ করতে কেউ এলেই সহজেই সবার চোখে পড়ে।

দেখুন তো আপনার বাড়ির পার্শ্ববর্তী ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম বা টিউব লাইটটি পর্যাপ্ত আলো দিচ্ছে কি না! অনেক সময় এগুলো নষ্ট থাকে আবার ভালো থাকলেও তা ঝাপসা বা পিটপিট করে জ্বলে। এমন হলে দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ করে ঠিক করিয়ে নিন।
অনেক বাড়িতে দেখা যায় ছাদের চিলেকোঠার দরজা থাকে না, আর থাকলেও তা ভাঙা। এমন হলে আগেই মেরামত করিয়ে নিন।
ফ্ল্যাটের দরজা পুরোনো হয়ে গেলে তা বদলানোর ব্যবস্থা করুন। এখন বাজারে বেশ শক্তপোক্ত কাঠের বা স্টিলের দরজা পাওয়া যায়, সেগুলোর কোনোটা লাগিয়ে নিতে পারেন ভবনমালিককে অনুরোধ করে।
দরজার লকে বা তালায় কোনো সমস্যা থাকলে আগেই মেরামত করিয়ে নিন। প্রয়োজনে বদলে নতুন তালা লাগান। কালক্ষেপণ করবেন না, পরে হয়তো সময় পাবেন না। অ্যানালগ তালার বদলে ডিজিটাল লকারও লাগাতে পারেন।
ঘরের জানালার কোনো কাচ ভাঙা থাকলে নতুন কাচ লাগিয়ে নিন।
বাসায় যদি বড় কোনো ভেন্টিলেশন জানালা থাকে, তবে তা বন্ধ করুন।
রান্নাঘর ও বাথরুমে ভেন্টিলেশনে ব্যবহৃত এক্সহস্ট ফ্যানের (Exhaust fan) স্ক্রুগুলো সঠিকভাবে লাগানো কি না পরীক্ষা করুন। ভেন্টিলেশন ছিদ্রের আয়তন বেশি হলে সেখানে লোহার ঝাঁপি লাগিয়ে নিতে পারেন।
ঘরে যদি এসি লাগানো থাকে এবং তা যদি উইন্ডো সিস্টেমের হয় তবে এর বহির্পার্শ্বে লোহার জালি লাগিয়ে নিন।
বাসার আশপাশে মই, দড়ি, উঁচু টুল ইত্যাদি থাকলে সরিয়ে ফেলুন। বাড়িসংলগ্ন কোনো বড় গাছ থাকলেও তার ডালপালা ছেঁটে দিন। সাধারণত চোর ওপরে উঠতে এগুলো ব্যবহার করে।
অতিরিক্ত টাকা-পয়সা, গয়না, দলিলপত্র ও মূল্যবান জিনিসপত্র এ সময়ে বাসায় রাখা উচিত নয়। এসব ব্যাংক ভল্টে বা বিশ্বাসযোগ্য কোথাও রাখলে অনেকটাই নিরাপদে থাকবে।

বর্তমানে গাড়ি ও মোটরসাইকেল চোরচক্র অত্যন্ত সক্রিয়। ঈদের ছুটিতে তাদের কার্যক্রম বেড়ে যায়। প্রায় প্রতিটি মহল্লাতেই এ সময়ে ঘটে চুরির ঘটনা। তাই আগে থেকেই সাবধান হোন। গ্যারেজের দরজা ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করুন। গাড়ি গ্যারেজে রেখে গেলে এর কাগজপত্র সরিয়ে রাখুন। গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি রোধে বাড়ির গার্ডকে সতর্ক করুন। এ ছাড়া চুরি রোধে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম, স্টিয়ারিং লক ও জিপিএস ব্যবহার করতে পারেন।
এখন অনেক বাসা বা ফ্ল্যাটে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) লাগানো থাকে। কিন্তু অনেক সময়ই তা থাকে নষ্ট। তাই যত দ্রুত সম্ভব তা ঠিক করে নিন।
তবে এতসব ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও চুরির হতে পারে। মোদ্দাকথা বাসা একবারে খালি করে যাওয়া ঠিক নয়। বিশেষ করে রাতে। প্রতিবছর উৎসবকালীন বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ নানা পদক্ষেপ নিলেও প্রতিটি বাড়িতে নজর রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সম্ভব হলে আত্মীয়দের কাউকে বাড়িতে রেখে যান। যদি তা না হয় কোনো আত্মীয়স্বজন আশপাশে থাকলে তাঁকে বাসায় এসে মাঝেমধ্যে দেখে যেতেও বলতে পারেন। এ ছাড়া বিশ্বস্ত প্রতিবেশীদের বাসার প্রতি নজর রাখতে অনুরোধ করুন এবং তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ রাখুন। ভাড়াটিয়া হলে অবশ্যই বাসার মালিককে জানিয়ে বাড়ি যাবেন। প্রয়োজনে বাড়িওয়ালাকে একটু বিশেষভাবে ঈদের কয়েকটি দিন পাহারার ব্যবস্থা করতে বলুন। বাসার গার্ডকে সতর্ক করবেন, যেন অপরিচিত কাউকে অনুমতি ছাড়া ঢুকতে না দেয়। কোনো সমস্যা হলে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে জানান। এ জন্য নিকটস্থ সেবাধীন থানার ফোন নম্বর সংগ্রহে রাখুন।
বড় শহরগুলোতে বিশেষ করে ঢাকায় বাসাবাড়িতে চুরির মতো যত অপরাধ সংঘটিত হয় তার অন্যতম কারণ অপরিচিত গৃহকর্মী, গাড়িচালক, নিরাপত্তারক্ষী বা কেয়ারটেকার। একটি সংগঠিত চক্র আছে, যারা বিভিন্ন বেশে চাকরি নেয় এবং সুযোগ বুঝে লুটে নেয় সবকিছু। কখনো কখনো এরা সরাসরি জড়িত না থাকলেও তথ্য পাচার করে সর্বনাশ করে। কারণ, কাজের সূত্রে ওরা ব্যক্তিগত ও গোপনীয় অনেক কথাই জেনে যায়। তাই তাদের নিয়োগের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। কোনো বাসায় কাজ করার সুবাদে তারা পরিচিত হয়ে যায়, এ জন্য বাড়িতে প্রবেশে কেউ বাধা দেয় না। কোনো সময় হয়তো আপনার অজান্তেই নকল চাবি বানাতে পারে এবং তা দিয়েই ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান সামগ্রী লুট নিতে পারে। তাই এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। প্রয়োজনে যাওয়ার আগে নতুন একটি তালা লাগিয়ে যেতে পারেন।

বাসাবাড়ির নিরাপত্তাজনিত ব্যাপারে মেট্রোপলিটন পুলিশের পরামর্শও মানার চেষ্টা করুন। পরামর্শসমূহ-
গৃহকর্মী, গাড়িচালক বা নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিলে পার্শ্ববর্তী থানায় তার সব তথ্য প্রদান করুন।
প্রদানকৃত তথ্য, যেমন স্থায়ী-অস্থায়ী ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, সুপারিশকারীর পরিচিতিসহ বিস্তারিত সঠিক কি না তা যাচাই করুন।
সম্ভব হলে তাদের নামে স্থানীয় থানায় কোনো মামলা বা জিডি আছে কি না তা জেনে নিন।
গৃহকর্মী ও গাড়িচালকদের অনেকেই বাসা পরিবর্তন করে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে কাজ করতে আসে। তাই নিয়োগের সময় আগের স্থান ছাড়ার কারণ জানার চেষ্টা করুন।
এদের কারও উপস্থিতিতে ব্যক্তিগত বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলবেন না। মনে রাখবেন, এরা যদি এসব জানে তাহলে শুধু চুরিই নয়, পরবর্তী সময়ে আপনাকে ব্ল্যাকমেলও করতে পারে। তবে অযথা কাউকে সন্দেহ করবেন না। যা-ই করবেন নিজে নিজ বিবেচনাসহকারে করবেন। কারণ, বিশ্বস্ত মানুষ পাওয়াই দুষ্কর এ যুগে।
নিরাপত্তায় আধুনিক প্রযুক্তি
চুরি-ডাকাতি প্রতিরোধে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হলেও নতুন কৌশলে অপরাধ করছে অপরাধীরা। তাই এসব প্রতিরোধে নিত্যনতুন প্রযুক্তি হতে পারে আপনার সহায়ক। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) নিরাপত্তার পুরোনো প্রযুক্তিই বলা চলে। কারণ, বাজারে এখন নানা আধুনিক যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়। যেমন- ডিজিটাল ডোর লকিং সিস্টেম, বেল, অ্যালার্ম ইত্যাদি। ‘ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম’ নামে একধরনের অ্যালার্ম বা বেল সম্প্রতি বাজারে এসেছে, যা সরাসরি গ্রাহকের মোবাইলে যুক্ত করা সম্ভব। বাড়িতে অনাকাক্সিক্ষত কেউ প্রবেশ করলেই যন্ত্রটি সঙ্গে সঙ্গে আপনার মোবাইলে সংকেত পাঠাবে। তখন নিকটস্থ থানায় ফোন করে বিষয়টি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। ইতিমধ্যেই এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। আপনিও চাইলে প্রযুক্তিগত সহায়তা দানকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে অথবা বাজার থেকে বিশেষ এই ডিভাইসটি সংগ্রহ করে ব্যবহার করতে পারেন।

কৌশলী হন
সাবধানতা নিরাপত্তার প্রথম শর্ত হলেও অপ্রীতিকর কিছু ঘটবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিছুটা গড়বড় থাকতেই পারে। যেখানে অপরাধীরা নিরাপত্তার ফাঁক গলে ঢুকে পড়ছে ব্যাংকের সুরক্ষিত ভল্টে; চুরি করছে বিপুল অর্থ, সেখানে আপনার বাড়িটি শতভাগ সুরক্ষিত তা কীভাবে বলবেন! সেক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী হলে হয়তো নিশ্চিত করা যাবে শূন্য বাড়ির নিরাপত্তা। এই কৌশলগুলো প্রয়োগ করে হয়তো বা চোরকে বোকা বানাতে পারেন। জেনে নিন নিরাপত্তার সহজ কিছু কৌশল-
ঘরের ভেতর সেন্সরযুক্ত একটি ডিভাইস যুক্ত করুন, যা একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সংক্রিয়ভাবে আলো জ্বালিয়ে দেবে; হঠাৎ করেই উচ্চ শব্দে কথা বলে উঠবে (রেকর্ড করা কণ্ঠ হতে পারে)। তাহলে ভেতরে কেউ আছে এই ভেবে চোর ভুল করতে পারে। এ রকম ডিভাইস আপনি একজন যন্ত্র প্রকৌশলীকে দিয়ে তৈরি করে নিতে পারেন অথবা বাজার থেকেও সংগ্রহ করতে পারেন।
সম্ভব হলে দরজায় আরও একটি নকল তালা যুক্ত করুন।
সাধারণত প্রতিটি বাড়িতেই ভবনের দেয়ালসংলগ্ন পানি, গ্যাস বা টয়লেটের পাইপ লাগানো থাকে, যা বেয়ে সহজেই কেউ ওপরে উঠতে পারে। তাই এ সব পাইপে মাটি থেকে আট ফুট ওপরে অ্যান্টি ক্লাইম্বিং রং বা গ্রিস-জাতীয় পিচ্ছিল কিছু লাগিয়ে দিন।

‘কুকুর হতে সাবধান’ এই ভয় জাগানিয়া পঙ্ক্তিটি লিখে দরজায় টানিয়ে দিতে পারেন।
বাড়ি ছাড়ার ঠিক আগে
- বাসা থেকে বেরোনোর আগেই সব দরজা-জানালা ঠিকভাবে বন্ধ করে তালাবদ্ধ করুন। প্রয়োজনে একাধিক তালা ব্যবহার করুন।
- বাসার ছাদের গেটটি বন্ধ করেছেন কি না শেষবারের মতো পরীক্ষা করুন।
- লাইট, ফ্যান, বৈদ্যুতিক সংযোগ লাইন, পানির ট্যাপ ও গ্যাসের চুলা বন্ধ আছে কি না নিশ্চিত হোন।
- প্রতিবেশী ও বাসার মালিককে জানিয়ে যান এবং নজর রাখতে অনুরোধ করুন।
- দারোয়ানকে সতর্ক করে যান।
- বাড়ির চাবিগুলো যত্ন করে রাখুন।

সম্প্রতি বাসাবাড়িতে চুরির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। লোহার গ্রিল কেটেও ঘটছে ভয়াবহ চুরি। তাই মনে হতে পারে এতসব ব্যবস্থা কি আদৌও উপকারে আসবে! হলফ করে বলা না গেলেও অন্তত এটুকু নিশ্চয়তা দেওয়া যায়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের তাবৎ পুলিশ এবং নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো এসব পরামর্শই দিয়ে থাকে তাদের নাগরিকদের নিশ্চয়তা বিধানে। তাই আলোচ্য সবকিছু মেনে চলার চেষ্টা করুন। সর্বদা সাবধান থাকুন। মনে রাখবেন তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন সংসারের প্রতিটি জিনিস। এসবের মূল্য আপনি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। তাই একটি সূচও যেন খোয়া না যায়।
মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৪ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৪