মিক্স ডিজাইন

মিক্স ডিজাইন এমন একটি প্রক্রিয়া, যা আগেই কংক্রিটের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণকারী উপাদান মিশ্রণের অনুপাত নির্দিষ্ট করে। মিক্স ডিজাইনের মাধ্যমে আমরা চাহিদামতো বৈশিষ্ট্যর কংক্রিট তৈরি করতে পারি। কংক্রিট মিক্স ডিজাইন অবকাঠামো নির্মাণে বিশ্বে বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত পদ্ধতি। উন্নতসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশ তাদের দেশের চাহিদা অনুযায়ী কংক্রিট মিক্স ডিজাইন পদ্ধতির গাইডলাইন অনুসরণ করে। পদ্ধতিটি অনেকাংশে নির্ভর করে পরীক্ষালব্ধ উপাত্ত তথা তথ্য, চার্ট, ডায়াগ্রাম ও টেবিলের ওপর। যেগুলোর উন্নয়ন করা হয়েছে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর উপাত্ত তদন্তের ভিত্তিতে।

প্রচলিত কয়েকটি কংক্রিট মিক্স ডিজাইন পদ্ধতি-

  • এসিআই মিক্স ডিজাইন (ACI Mix Design Method) 
  • ইউএসবিআর মিক্স ডিজাইন (USBR Mix Design Practice)
  • বিট্রিশ মিক্স ডিজাইন (British Mix Design Method)
  • আইএসআই রিকমান্ডেড গাইডলাইন (ISI Recommended Guide Line)

তবে এ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অঈও মিক্স ডিজাইন বহুল প্রচলিত ও সমাদৃত। ১৯৯১ সালে আমেরিকান কংক্রিট ইনস্টিটিউট (ACI) স্বাভাবিক ভারী ওজন ও ম্যাস বা স্তূপ কংক্রিটের মিক্স ডিজাইন গাইডলাইন প্রকাশিত করে। মিক্স ডিজাইনে কাজের ধরন, কংক্রিটের প্রয়োজনীয় স্ট্রেন্থ, সহজলভ্য উপাদানের সমন্বয় ঘটিয়ে উপাদানগুলোর সঠিক অনুপাত নির্ণয় করা যায়।

ঢালাইয়ে রেডিমিক্সের ব্যবহার
ঢালাইয়ে রেডিমিক্সের ব্যবহার

ভালো কংক্রিটের মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলো যেসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে-

  • সিমেন্টের গুণাগুণ
  • পানি-সিমেন্ট অনুপাত
  • ফাইন ও কোর্স এগ্রিগেটের বৈশিষ্ট্য
  • কংক্রিটের উপাদানের অনুপাতিকরণ
  • উপাদানসমূহের পরিমাণকরণ
  • কংক্রিট মিশ্রণ
  • কংক্রিট স্থানান্তর ও স্থাপন
  • কিউরিং।

ACI মিক্স ডিজাইনের ধাপসমূহ-

  • মালামালের প্রয়োজনীয় তথ্য
  • স্ল্যাম্প বা নতি নির্ধারণ
  • এগ্রিগেটের আকার নির্ধারণ
  • মিশ্রিত পানি ও বাতাসের পরিমাণ নির্ণয়
  • পানি-সিমেন্টের অনুপাত নির্ধারণ
  • সিমেন্টের পরিমাণ নির্ণয়
  • কোর্স এগ্রিগেটের পরিমাণ নির্ণয়
  • ফাইন এগ্রিগেটের পরিমাণ নির্ণয়
  • এগ্রিগেটের আর্দ্রতা সমন্বয়করণ
  • নমুনা পরীক্ষা।

মালামালের প্রয়োজনীয় তথ্য
ফাইন ও কোর্স এগ্রিগেটের চালুনি বিশ্লেষণ বা গ্রেডিং, একক ওজন, আপেক্ষিক গুরুত্ব ও শোষণক্ষমতা, কংক্রিটের প্রত্যাশিত কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ।

স্ল্যাম্প বা নতি নির্ধারণ
সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য আলাদা আলাদা স্ল্যাম্প নির্ধারণ করা হয়। তবে সাধারণ নিয়ম হলো, সর্বনিম্ন স্ল্যাম্প নির্ধারণ করা, যেটা দ্বারা পর্যাপ্ত কার্যোপযোগিতা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যোপযোগিতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রকার অ্যাডমিক্সারের ব্যবহার প্রায়ই লক্ষ করা যায়। কংক্রিটের কনসিসটেন্সি মাত্রা ও ওয়ার্ক অ্যাবিলিটি স্ল্যাম্পের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়।

রেডিমিক্সের কার্যোপযোগিতা পরীক্ষা
রেডিমিক্সের কার্যোপযোগিতা পরীক্ষা

এগ্রিগেটের সাইজ নির্ধারণ

  • এগ্রিগেটের সর্বোচ্চ আকার নির্ধারণের শর্তাবলি- 
  • অবকাঠামোর সর্বনিম্ন মাপের ১/৫ গুণের বেশি হবে না।
  • স্ল্যাব পুরুত্বের ১/৩ গুণের বেশি হবে না।
  • রিইনফোর্সমেন্ট বার ও ফর্মের মধ্যবর্তী হবে।
  • দূরত্বের ৩/৪ গুণের বেশি হবে না।

তবে বেশির ভাগ এলাকায় সর্বোচ্চ, সহজলভ্য ও প্রচলিত এগ্রিগেটের আকার ৩/৪ ইঞ্চি থেকে ১ ইঞ্চি। এ ছাড়া মালামালের সহজ প্রাপ্যতা, খরচ, কংক্রিট স্থাপনপদ্ধতি, প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতার ওপর এগ্রিগেটের সর্বোচ্চ আকার নির্ভর করে।

ছাদ ঢালাইয়ে রেডিমিক্স

পানি ও বাতাসের পরিমাণ নির্ণয়
কংক্রিটে পানির পরিমাণ সিমেন্টের বৈশিষ্ট্যর চেয়ে এগ্রিগেটের বৈশিষ্ট্যর ওপর বেশি নির্ভরশীল। কার্যত, কংক্রিটে পানির পরিমাপ এগ্রিগেটের সর্বোচ্চ আকার, কংক্রিটের প্রকারভেদ (এয়ার এনট্রেনভ ও নন-এয়ার এনট্রেনভ) ও সুনির্দিষ্ট স্ল্যাম্পের ওপর নির্ভর করে নির্নয় করা হয়। কার্যক্ষেত্রে এটি প্রায়ই দৃশ্যমান। কংক্রিটের কর্মক্ষমতা বাড়াতে অতিরিক্ত পানি মিশানো হয়। কিন্তু অতিরিক্ত পানির দরুন কংক্রিটের স্ট্রেন্থ কয়েক গুণ কমে যায়। মূলত কংক্রিটের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কংক্রিটের উপাদানের পুনরায় মিক্স ডিজাইন করা উচিত।

সাধারণত শীতপ্রধান ও যেখানে প্রচুর হিমবাহ, তুষারপাত হয়, সেসব এলাকায় এয়ার এনট্রেনভ কংক্রিট ব্যবহৃত হয়। কংক্রিটকে এয়ার এনট্রেনভ করার জন্য সাধারণত এয়ার এনট্রেনভ অ্যাডমিক্সার ব্যবহার করা হয়। কংক্রিট যখন পানি ও রাসায়নিক পদার্থের সরাসরি সংস্পর্শে থাকে, সে ক্ষেত্রেও এয়ার এনট্রেনভ কংক্রিট ব্যবহৃত হয়। এয়ার এনট্রেনভ কংক্রিটে শত কোটি অণুবীক্ষণিক এয়ার সেল থাকে, যেগুলো কংক্রিটের বরফ ক্রিয়া প্রতিরোধ করে।

বিভিন্ন স্ল্যাম্প ও এগ্রিগেটের সর্বোচ্চ আকারের প্রেক্ষিতে কংক্রিটে পানি (16/yd3) (পাউন্ড/গজ৩) ও বাতাসের পরিমাণ:

পানি সিমেন্ট অনুপাত নির্ধারণ
কংক্রিটের শক্তি ও টেকসই ক্ষমতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে পানি সিমেন্টের অনুপাতের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পানি সিমেন্ট অনুপাত এমন হওয়া উচিত, যাতে কংক্রিটের কার্যকর কনসিসটেন্সি সৃষ্টি হয়। পানি সিমেন্টের অনুপাতের সঙ্গে কংক্রিটের স্ট্রেন্থ ব্যস্তানুপাতিক অর্থাৎ সর্বনিম্ন পানি সিমেন্ট অনুপাত সর্বোচ্চ স্ট্রেন্থের কংক্রিট উৎপন্ন করে। এ ছাড়া কংক্রিট সমুদ্রের পানি, সালফেট, ঠান্ডা আবহাওয়ায় অথবা মুক্ত অবস্থায় থাকলে পানি সিমেন্টের অনুপাত সমন্বয় করা প্রয়োজন।

পানি সিমেন্ট অনুপাত ও কংক্রিটের কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থের মধ্যকার সম্পর্ক-

কোর্স এগ্রিগেট
কোর্স এগ্রিগেট
রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়া
রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়া

কোর্স এগ্রিগেট কর্তৃক দখলকৃত আয়তন = কোর্স এগ্রিগেটের অনুপাত X কংক্রিটের আয়তন
এগ্রিগেটের ওভেন ড্রাই (OD) ওজন = এগ্রিগেটের দখলকৃত আয়তন X এগ্রিগেটের একক ওজন (ড্রাইরোলড অবস্থায়)
এগ্রিগেটের স্যাচুরেটেড সারফেস ড্রাই (SSD) ওজন = এগ্রিগেটের ওভেন ড্রাই ওজন [১ + এগ্রিগেটের শোষণ সমতা (AC)]

ফাইন এগ্রিগেটের পরিমাণ নির্ণয়
ফাইন এগ্রিগেটের পরিমাণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি পদ্ধতি প্রচলিত। একটি ভর পদ্ধতি, অন্যটি আয়তন পদ্ধতি। তবে আয়তন পদ্ধতি বেশি ব্যবহৃত। কারণ, পদ্ধতিটি অধিক নির্ভুল। এ ক্ষেত্রে কংক্রিটের সম্পূর্ণ আয়তন হতে সিমেন্ট, পানি, বাতাস ও কোর্স এগ্রিগেটের আয়তন বিয়োগ করলে ফাইন এগ্রিগেটের আয়তন পাওয়া যায়।

সিমেন্টের বন্ধন-ক্রিয়া এগ্রিগেটের সারফেস এরিয়ার ওপর নির্ভর করে। সিমেন্ট এগ্রিগেট সর্বমোট যে সারফেস এরিয়ায় ক্রিয়া করে সেখানে কোর্স এগ্রিগেটের তুলনায় ফাইন এগ্রিগেটের সহায়ক ভূমিকা বেশি। আর তাই কংক্রিটে ফাইন এগ্রিগেটের পরিমাণ যাতে কম না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া কংক্রিটের সর্বোচ্চ কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থের এ কারণেই তারতম্য ঘটে।

বহুতল ভবনে রেডিমিক্স কংক্রিট উত্তোলন
বহুতল ভবনে রেডিমিক্স কংক্রিট উত্তোলন

এগ্রিগেটের আর্দ্রতা সমন্বয়করণ 
কংক্রিটে পানির পরিমাণ এগ্রিগেটের আর্দ্রতায় প্রভাবিত হয়।
এগ্রিগেটের আর্দ্রতার পরিমাণ (MC) = এগ্রিগেটের শোষণক্ষমতা + এগ্রিগেটের পৃষ্ঠ আর্দ্রতা
ওজন Stock Pile = ওজন OD (1+MC)

নমুনা পরীক্ষা
পূর্ববর্তী ধাপসমূহের মাধ্যমে কংক্রিটের উপাদানের যে অনুপাত নির্ধারিত হয়, সেগুলোর সমন্বয়ে একটি নমুনা মিক্স করতে হবে, সেখানে শুধু ততটুকু পানি ব্যবহার করতে হবে, যেটা চাহিদাকৃত স্ল্যাম্পের জন্য প্রয়োজন কিন্তু যাতে অনুমোদনযোগ্য পানি সিমেন্ট অনুপাত অতিক্রম না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সদ্য প্রস্তুতকৃত কংক্রিটের স্ল্যাম্প একক ওজন বাতাসের পরিমাণ এবং এর সেগ্রিগেশন প্রবণতা, ব্লিডিং ও ফিনিশিং বৈশিষ্ট্যসমূহ পরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া জমাটবদ্ধ কংক্রিটের কম্প্রেসিভ ও টেনসাইল স্ট্রেন্থ পরীক্ষা করতে হবে।

উদাহরণ
ভূমির ওপর অবস্থিত একটি বহিঃস্থ কলামের জন্য অঈও মিক্স ডিজাইন পদ্ধতিতে কংক্রিট ডিজাইন করতে হবে, যেখানে ঘটে প্রচুর তুষারপাত। কংক্রিটের ২৮ দিনের কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ অবশ্যই হবে ৫০০০ ১৬/১১২ ও স্ল্যাম্প ২ ইঞ্চি। এগ্রিগেটের সর্বোচ্চ আকার ৩/৪ ইঞ্চির বেশি হবে না।

মালামালের বৈশিষ্ট্যসমূহ-

  • সিমেন্ট টাইল ১, আপেক্ষিক গুরুত্ব ৩.১৫ কোর্স এগ্রিগেট : বাল্ক আপেক্ষিক গুরুত্ব (SSD) = ২.৭০, শোষণক্ষমতা = ১%, ড্রাই রোলড একক ওজন = 100 1b/ft3 ও সারফেস ময়েশ্চার = ০%
  • ফাইন এগ্রিগেট : বাল্ক আপেক্ষিক গুরুত্ব (SSD) = ২.৬৫, শোষণক্ষমতা = ১.৩%, ফাইননেস মডুলাস = ২-৭০, সারফেস ময়েশ্চার = ৩%
ঢালাইয়ে রেডিমিক্স কংক্রিট

প্রকৌশলী চন্দন কুমার বসু
chandan.duet@gmail.com

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৩ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top