প্রকৃতি তার আপন সৌন্দর্যে সাজিয়েছে এ পৃথিবীকে। প্রকৃতির সন্তান হওয়ায় আমাদের অস্তিত্বের বড় একটি অংশজুড়েই রয়েছে প্রকৃতি। আর তাই বসতবাড়ি, অফিস, সড়কদ্বীপ, পাবলিক পার্ক- সব ধরনের নিদর্শনেই থাকা চাই প্রকৃতির ছোঁয়া। তাই তো বনের রাজা বাঘ, সিংহ, হাতি, ময়ূর; ঈগল, দোয়েল, সাগরের নীল তিমি, ডলফিন, ইলিশসহ নানা রকম জীবজন্তু, পাখি, মাছ ইত্যাদির ভাস্কর্যকে রয়েছে প্রকৃতির অকৃত্রিম ছোঁয়া। নগর সভ্যতার অংশ হয়ে ওঠা ভাস্কর্যগুলোই ইট-কংক্রিটের এ নগরকে করেছে জীবন্ত। যার নেপথ্যে রয়েছে ভাস্করশিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়া। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও স্বশিক্ষিত ভাস্কররা তাঁদের শৈল্পিকতার সর্বোচ্চ দিয়ে নির্মাণ করছেন নান্দনিক সব ভাস্কর্য। স্থাপানার অনিন্দ্য সৌন্দর্যবর্ধনে যাঁদের অবদান অনন্য।

ঢাকার আমিনবাজার-নবীনগর মহাসড়ক ধরে এগোলে রাস্তার দুপাশে মাঝেমধ্যেই চোখ আটকে যাবে ভাস্কর্য তৈরির সাদামাটা কিছু দোকানে। কোনো দোকান বাঁশের চাটাই আর টিনের তৈরি, কোনোটা আবার পাকা। দোকানের ভেতরে ও সামনের খোলা জায়গায় এলোমেলোভাবে রাখা হরেক রঙের ভাস্কর্য। বাঘ, হরিণ, ময়ূর, বক, ঘোড়া, ডাইনোসর, হাতি, প্রস্ফুটিত শাপলা আরও কত কী! কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়; আবার কোনোটা মাঝারি মানের। একেকটার একেক রং ও নকশা। কখনো কখনো ভাস্কর্যকে জীবন্ত বলে ভ্রম হবে। এই বুঝি ভয়ঙ্কর রয়েল বেঙ্গলটা হামলে পড়ল; পেখমমেলা ময়ূরটা এক্ষুনি নাচতে শুরু করবে; শূন্যে পা তোলা টাট্টু ঘোড়াটা দিল দে-ছুট; পাশে দাঁড়িয়ে দেখার অনুভূতিটা হবে অনেকটাই এমন। সম্প্রতি চাহিদা বেড়েছে ভাস্কর্যের। আর তাই বিকিকিনিতে সরব হয়ে উঠেছে দোকানগুলো। এমন দোকান শুধু যে সাভার-আমিন বাজারেই তা কিন্তু নয়, বরং ছড়িয়ে রয়েছে দেশজুড়ে। এসব দোকানের দেখা মিলবে ঢাকা-চিটাগাং, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুই পাশেও।

কর্মব্যস্ত মানুষ শত ব্যস্ততার ফাঁকে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটছে প্রকৃতির সান্নিধ্যে গড়ে ওঠা বিনোদন পার্কে। দর্শনার্থীদের চাহিদার কারণে বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে একের পর এক গড়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের থিম পার্ক। নানা রাইডের পাশাপাশি পার্কের আকর্ষণ ও সৌন্দর্য বাড়াতে স্থাপন করা হচ্ছে নানা ধরনের ভাস্কর্য। জলাশয়ে ফোটা শাপলা-পদ্ম, উড়ন্ত বকের ঝাঁক, বিশালাকার সাপ, মায়াবী হরিণ, দুষ্টু বাঘের গলা থেকে বকের হাড় বের করার চেষ্টা, এ রকম বিভিন্ন ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে বিনোদন পার্কগুলোতে। শুধু পার্কে নয় বাড়ি ও অফিসের ল্যান্ডস্কেপে, কমিউনিটি সেন্টার প্রভৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও স্থাপন করা হচ্ছে ভাস্কর্য। ফলে সময়ের পরিক্রমায় চাহিদা বাড়ছে ভাস্কর্যের। স্যানিটারি ও নির্মাণপণ্যের দোকানেও বিক্রির জন্য নির্মিত হচ্ছে ভাস্কর্য। এ ছাড়া প্রতিমার তৈরির কারিগরেরাও তাঁদের মূর্তি তৈরির দক্ষতায় ভাস্কর্য নির্মাণে যুক্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ ভাস্কর্য গড়াকেই নিচ্ছেন পেশা হিসেবে।
ভাস্কর্য তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় নুড়িপাথর, সিমেন্ট ও বালু। প্রথমে ভাস্কর্যের ওজন ও সাইজ অনুযায়ী রড দিয়ে জালি তৈরি করা হয়। এরপর মিশ্রিত কাঁচামাল দিয়ে আস্তে আস্তে জালির ওপর আস্তরণ দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে যখন এটি প্রকৃত আদল পায় তখন চলে একে নিখুঁতভাবে তৈরির প্রক্রিয়া। এরপর শুকানোর জন্য রোদে রাখা হয়। এরপর নিয়ম করে দেওয়া হয় পানি। রোদে শুকানোর পর যখন এটি শক্ত হয়ে আসে তখন এতে রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। রং ভালোভাবে শুকাতে সময় নিয়ে আরও কিছুদিন রেখে দেওয়া হয়। এভাবে চলে দফায় দফায় রঙের প্রলেপ দান। এরপর এটি বিক্রির জন্য দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়।

ক্রেতার প্রয়োজন ও চাহিদা মোতাবেক কারিগরেরা ভাস্কর্য নির্মাণ করে থাকেন। সাধারণত বিভিন্ন সাইজের ভাস্কর্য রেডিমেট বিক্রি হলেও অর্ডার দিলে ক্রেতার অর্ডার মোতাবেক কারিগরেরা কাজ করেন। প্রথমে সময় নির্ধারণ করা হয়। এটি নির্ভর করে কোন ভাস্কর্যের মাপ কত তার ওপর। বড় আকৃতির ভাস্কর্যে সময় লাগে বেশি; অনেক সময় এক বছরের ওপরও লেগে যায়। রিসোর্ট বা পার্কে বা দেয়ালে ভাস্কর্য করতে সময় বেশি লাগে। আবার ছোট কোনো মূর্তিতে করতে সময় লাগে কম। ছোট আকৃতির ভাস্কর্য যার ওজন ১৫ থেকে ২০ কেজি এবং সাইজ পাঁচ-সাত ফুট তৈরিতে খরচ পড়বে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ১৫-২০ দিন। মাঝারি অর্থাৎ যেগুলোর ওজন ২০-৩৫ কেজি এবং সাইজ ৮-১২ ফুট খরচ হবে ৭ থেকে ১২ হাজার টাকা। এগুলো তৈরিতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। সাধারণত বড় ভাস্কর্য, যার ওজন ৪০ কেজির অধিক; সাইজ ১২ ফুটেরও বেশি, খরচ পড়বে ২০ হাজার থেকে লাখ টাকা; সময় লাগবে ২ মাস। ভাস্কর্য তৈরিতে প্রায়ই সাধারণ রঙের বদলে ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিক ইমালশন। তবে চাইলে দেয়ালের ভাস্কর্যে বাচ্চাদের পছন্দের ডোরেমন কার্টুন বা আপনার পছন্দের কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির আত্মপ্রতিকৃতির ভাস্কর্য তৈরি করতে পারবেন। এগুলোর দাম নির্ভর করে সাইজের ওপর, যা আবার নির্ভরশীল পাথরের ওপর। কোনো পার্কে বা রিসোর্টে ব্যক্তিবিশেষের ভাস্কর্য স্থাপনে প্রথমে কারিগরের সঙ্গে কথা বলে আলোচনা করে নিতে হয়।

এসব মূর্তি যাঁরা তৈরি করেন, তাঁরা নিজের হাতের শৈল্পিক নির্দেশনায় এটি করে থাকেন। এটি তাঁদের পেশা নয়। অনেকটাই নেশা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ কাজের কারিগরেরা সঠিক মূল্যায়ন পান না। যা তাঁদের কাছে বেদনাদায়ক। তবুও থেমে নেই তাঁরা। সৌন্দর্যবর্ধনে ভাস্কর্য নির্মাণ করে চলেছেন নিরন্তর।
ভাস্কর্য দেখার বিষয় হলেও এটি মনের কথা প্রকাশ করে; ভাবায়। এটি মানুষের তৈরি কারুকার্যই নয় যেন বাক্সময় এক শিল্প। শৈল্পিক এ শিল্পের কারিগরেরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও কাজের মাধ্যমে স্বশিক্ষিত। তাই তাঁরাও ভাস্কর্যশিল্পী বা ভাস্কর। সামাজিক স্বীকৃতি তাঁদেরও প্রাপ্য।
মো. ওয়ালিউর রহমান (অভি)
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৭ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৪