এয়ারকন্ডিশনার বা ফ্যানের বাতাস, টিউবলাইটের আলো, এয়ার ফ্রেশনারের সুগন্ধী আর কলবেলে পাখির ডাক এসবে অনেকটাই বন্দী স্কয়ারফিটের নগরজীবন। প্রকৃতির মাঝে বাস করেও ক্রমেই কৃত্রিম উপকরণ নির্ভর হয়ে পড়ছি আমরা। আবাসন মানেই এ নগরে কংক্রিটের বিস্তৃত পরিসর। এমনকি মাটির ওপরটাও কংক্রিটে মোড়া। তাই ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে না বৃষ্টির পানিও। নেই কোথাও সবুজের ছোঁয়া কিংবা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। এভাবেই প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে আমাদের প্রিয় আবাস ও যাপিত নগরজীবন। প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন এমন জীবন থেকে মুক্তি দিতে অনেক স্থপতিই চান তাঁর সৃষ্ট স্থাপত্যকর্মটি হোক সবুজেঘেরা; পরিবেশবান্ধব। এমনই স্বাপ্নিক তরুণ এক স্থপতি জয়ন্ত কুমার রায়, যিনি আবাসকে শুধু কংক্রিটেই আবদ্ধ রাখতে চাননি, সেখানে মাখাতে চেয়েছেন প্রকৃতির রং। নিজ স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘কেন্দ্রবিন্দু স্থাপত্য’-এর মাধ্যমেই তিনি অব্যাহত রেখেছেন তাঁর স্বপ্নময় এই স্থাপত্য চর্চা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর স্থাপত্যে পড়াকালীনই সবুজ স্থাপনা নির্মাণের প্রয়োজনীয় চিন্তাটা মাথায় আসে স্থপতি জয়ন্তর। তা ছাড়া একজন স্থপতি হিসেবে অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশের যতটা সম্ভব কম ক্ষতি করে স্থাপত্য নির্মাণও তাঁর মূল কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। পড়ালেখা শেষ করে ২০১১ সালে পুরকৌশলী রিপন কর্মকারকে সঙ্গী করে গড়ে তোলেন কনসালট্যান্সি ফার্ম। প্রতিষ্ঠার পরপরই এখান থেকে করেছেন একের পর এক বেশ কিছু প্রকল্প। চলছে এখন বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ। এর কিছু স্থাপনা ঢাকায়, বাকিটা ঢাকার বাইরের। যার মধ্যে অন্যতম মাদারীপুরে ফুলবাড়িয়া ডুপ্লেক্স ভবন, পাবনায় চারতলা আবাসিক ভবন, টাঙ্গাইলে তিন তলা আবাসিক স্থাপনা, কুমিল্লায় ডুপ্লেক্স ভবনের ইন্টেরিয়র ও পাঁচ তলা অ্যাপার্টমেন্ট ও আরও কিছু আবাসিক স্থাপনার কাজ। যার কাজ এরই মধ্যে সফলভাবে শেষ হয়েছে। চলমান প্রকল্পের মধ্যে সাভারের ট্রিপ্লেক্স ভবন, মাদারীপুরের শিবচরে ছয়তলা আবাসিক ভবন, কোম্পানীগঞ্জে চ্যারিটি হাউস ‘আশ্রম’, কুমিল্লায় একটি ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্ট এবং গাজীপুরে একটি ভ্যাকেশন হাউস, যা নির্মিত হবে রিসোর্ট ও আবাসিক স্থাপনার মিশেলে।

তরুণ এ স্থপতির কাজের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কেনো স্লোগান না থাকলেও চেষ্টা করেন প্রকৃতির পাশাপাশি নির্মাণে ব্যবহৃত সামগ্রীর স্বকীয়তা বজায় রাখতে। সাইট ডেভেলপমেন্ট, পোর্টফোলিও, স্থাপনায় ব্যবহৃত উপকরণের নিজস্বতা বজায় রাখতে নির্মাণের আগেই ইন্টেরিয়র ডিজাইন কিংবা ভবনের ডিজাইনকৃত থ্রিডি ভিজিয়্যুলাইজেশন ক্লায়েন্টের কাছে তুলে ধরেন যেন গ্রাহক পুরো স্থাপনা সম্পর্কে পায় স্বচ্ছ ধারণা। চেষ্টা থাকে স্থাপনার বাসিন্দারা যেন প্রকৃতির আলো-বাতাস পায় এবং ঘরে অতিরিক্ত গরম না থাকে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই স্থাপনা নির্মাণের। সমসাময়িক নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করলেও কাঠের ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, কেননা নির্মাণ উপকরণ হিসেবে এটি বেশ স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব। এ ছাড়া যেসব নির্মাণ উপকরণে স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই কিংবা তুলনামূলক কম, সেসব সামগ্রী ব্যবহারেই তাঁর আগ্রহ বা ঝোঁকটা বেশি।
একজন তরুণ স্থপতি হিসেবে অন্যদের মতোই তাঁরও প্রচেষ্টা শতভাগ গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জনের। সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করলেও আবাসিক স্থাপনা নির্মাণেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য। কারণ, এ ধরনের স্থাপত্যকর্মের মাধ্যমে সরাসরি গ্রাহকের ভাবনাটা জানা যায়। গ্রাহকের স্বপ্নের আবাসস্থল তৈরিতে থাকে ভিন্ন ভিন্ন কল্পনা আর নানা রকম চাহিদার সমন্বয়। গ্রাহক যেহেতু টেকনিশিয়ান নন, সে ক্ষেত্রে তাঁর কল্পনার ওপর ভিত্তিতে বাস্তবরূপে অবকাঠামো সাজানো এবং কাজ শেষে প্রায় কাছাকাছি রূপদান করতে পারার বাহবা বেশ উপভোগ্য। তা ছাড়া একটি আবাসিক স্থাপনা শুধু পরিবারে বসবাসের ক্ষেত্রই নয়, বরং স্থাপনাটি ওই এলাকা বা সমাজের অংশও বটে। স্থাপনাটি নির্মাণে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ছাদটাকে গুরুত্ব দেন বিশেষভাবে। পাশাপাশি আবাসিক ভবনের ছাদের সঙ্গে মিলিয়ে নির্মিত ছাদের কম্বিনেশন এমনভাবে করেন, যাতে অপরাপর ছাদে যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হয়। একটি কমন ছাদ থাকলে সেখানে সবাই সহজেই একত্র হতে পারে। নগরজীবনে এ মিলন প্রয়াস খুবই জরুরি। কারণ, গ্রামে যৌথ পরিবারের পরিপূর্ণ শিক্ষাটা শহরে এককেন্দ্রিক পরিবারের শিশুরা পাচ্ছে না। ফলে বাড়ছে কিশোর অপরাধসহ নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতা। হরহামেশাই পাশাপাশি ভবনে ঘটছে চুরি-ডাকাতি কিংবা প্রতিবেশী গুরুতর অসুস্থ হলেও তা জানা হয়ে ওঠে না কিংবা এ ব্যাপারে আগ্রহ ও নজরও কম। ফলে অবক্ষয় হচ্ছে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের। তাই তরুণ এ স্থপতির নকশাকৃত স্থাপনায় এমন দিকেও নজর থাকে সব সময়ই, যেখানে পরিবেশের পাশাপাশি স্থাপনার মাধ্যমে সুযোগ ঘটে সামাজিক যোগাযোগেরও। তাঁর কাজের বেশির ভাগই আবাসিক স্থাপনা ও এর নির্মাণসংশ্লিষ্ট।

একজন তরুণ স্থপতি হিসেবে কাজ করতে কিছু প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিক‚লতার সম্মুখীন হয়েছেন স্থপতি জয়ন্ত। যেমন অনেক গ্রাহকই রয়েছেন, যাঁরা স্থাপত্যের অনেক কিছুই বোঝেন না। অনেকে আবার স্থপতির পরামর্শকে বাড়তি খরচ বলে মনে করেন। খোলা পরিসরের বদলে বাড়তি দু-একটি রুমের আশা করেন, কখনো আবার নির্দেশও দেন। বিধি অনুযায়ী জায়গা ছাড়তে চান না। গাছ থাকলে কাটতে চান তাও। স্থানীয় ঠিকাদার, প্রকৌশলী কিংবা মিস্ত্রির পরামর্শ নিয়েই অনেকে ভবন নির্মাণ করেন। এ ধরনের নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য থেকেও অন্য সব স্থপতির মতো তিনিও কাজ করছেন। আর তাঁর সহযোগিতায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী অংশীদার একঝাঁক সুদক্ষ কর্মী বাহিনী।
কেন্দ্রবিন্দু স্থাপত্য থেকেই রয়েছে ভবিষ্যতে কিছু প্রকল্প নির্মাণ পরিকল্পনা। এ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সাভারের আমিনবাজারে থ্রি স্টার হোটেল, চারুতা প্লাসের অধীনে বনানীতে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সিঙ্গেল ইউনিট এবং পঞ্চমাত্রা প্রতিষ্ঠান থেকেও রয়েছে বেশ কিছু প্রস্তাবনা। বাধা থেকেই শিখছেন আর এগোছেন প্রতিনিয়ত। তবে যতই প্রতিবন্ধকতা আসুক, স্থাপত্য দিয়েই তা দূর করে নিজের আদর্শে অটল থাকতে চান, ভাবনাকে করতে চান আরও প্রসারিত। প্রকৃতিকে নষ্ট করে নয়, বরং অধিক নিরাপদ রেখে নিজস্ব সৃষ্টিশীলতায় এগিয়ে যেতে চান আগামীর পথে।

স্থপতি-বৃত্তান্ত
জন্ম শেরপুরে ১৯৮৫ সালের ২৭ জুন। কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে ২০০১ সালে মাধ্যমিক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ২০০৩ সালে উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন। এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ২০১১ সালে স্থাপত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। কিশোর বয়সেই ঝোঁক ছিল রংতুলির প্রতি। জাতীয় শিশু পুরষ্কার প্রতিযোগিতার চিত্রাংকন বিভাগে অংশ নিয়ে ১৯৯৯ সালে অর্জন করেন রৌপ্য পদক। পরে ২০০০ সালে একই প্রতিযোগিতায় পেয়েছেন ব্রোঞ্জ পদক। শংকর ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন কম্পিটিশনে অংশ নিয়ে ২০০০ সালে লাভ করেন রৌপ্য পদক। ছবি আঁকাই যেহেতু তাঁর পছন্দ, তাই গুরুজনদের পরামর্শেই জন্ম নেয় স্থপতি হওয়ার বাসনা। বর্তমানে কর্মরত ‘হরাইজন’ নামক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের সহকারী স্থপতি হিসেবে। চারুতা প্লাস, পঞ্চমাত্রাসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়ে কাজ করছেন। স্থাপত্য চর্চার আদর্শ হিসেবে স্থপতি লরি বেকার, জেফরি বাওয়া, চার্লস কোরিয়া, স্থপতির দেশীয় পথিকৃৎ মাজহারুল ইসলামকেই মনে করেন এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। তাঁদের দর্শন মেনেই চেষ্টা করছেন স্থাপত্য চর্চার।
যোগাযোগ
কেন্দ্রবিন্দু স্থাপত্য
১৯৬ গ্রিন রোড (৩য় তলা), পান্থপথ, ঢাকা।
ফোন: ০১৭১৭-৪০০৩৮৬
ই-মেইল: mailto:[email protected], [email protected]
তানিয়া আক্তার
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬