রং-আলোর ইন্দ্রজালিক স্রষ্টা স্থপতি লুইস বারগেন

স্থাপত্যের ক্রমবিকাশে একটি বিশেষ ধারা মডার্ন আর্কিটেকচার। মডার্ন আর্কিটেকচারের নান্দনিকতা বলতে আগে শুধু ভবনের ব্যবহারের উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তার সংকুলানকেই বোঝানো হতো। কিন্তু চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তার পরেও স্থাপত্যের রয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা, যা মানসিক উৎকর্ষতা ও অনুভূতির দেয়ালে আলোড়ন তোলে। স্থাপত্যে রং, আলো, ল্যান্ডস্কেপ, পানি বা ফোয়ারার মতো উপকরণের দ্বারা মানসিক উৎকর্ষতা ও নান্দনিকতাকে এক নতুন মাত্রা দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিদর্শন সৃষ্টি করে মেক্সিকোর সমসাময়িক বিপ্লবী স্থাপত্যবিদ লুইস রেমিরো বারগেন মরফিন। বারগেন তাঁর স্থাপত্য চর্চার মাধ্যমে মেক্সিকোর ঐতিহ্যে আধুনিকতার এক চাক্ষুষ সংমিশ্রণ তৈরি করেছিলেন। স্থাপত্য চর্চায় তাঁর এই অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে স্থাপত্যের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘প্রিটকজার আর্কিটেকচার’ পুরস্কারে ভূষিত হন।

স্থপতি লুইস বারগেনের জন্ম ১৯০২ সালে গুয়াদালাজারা, মেক্সিকোতে। ১৯৩১ সালে পুরকৌশলে পেশাগত প্রশিক্ষণ নেন। স্থাপত্যে তাঁর দক্ষতা প্রতিষ্ঠান-নির্ভর ছিল না, বরং স্বশিক্ষিত ছিলেন বারগেন। স্থপতি লি করবুসিয়ার এবং ব্যাক উভয়ই ছিল তাঁর কাজের অনুপ্রেরণা। নিজেকে মূলত ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট হিসেবে দাবি করেন এই স্থপতি।

লুইস বারগেনের স্থাপত্যকর্ম দার্শনিক ও নান্দনিক মানসমৃদ্ধ। তাঁর প্রস্তাবনায় আঞ্চলিক এবং ঐতিহ্যগত জ্ঞান অন্তর্নিহিত। তাঁর প্রতিটি স্থাপত্যকর্মের মূলে রয়েছে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জলবায়ু, সময় ও উপকরণের যথাযথ বিবেচনা। তিনি ‘সমালোচনামূলক আঞ্চলিকতা’ নামে একটি স্কুল অব থট প্রতিষ্ঠা করেন। বারগেন মনে করেন, একজন স্থপতি হিসেবে করণীয় হলো অপরিহার্য নির্মাণ উপকরণ শনাক্তকরণ এবং পরে এটিকে সমসাময়িক চিত্রায়নে রূপান্তরের চেষ্টা করা। তাঁর স্থাপত্যকর্মে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম আলো ও রঙের ব্যবহার।

পাবলিক পরিসর, বারগেন হাউস, মেক্সিকো

বারগেনের নকশার বিশাল একটা অংশজুড়ে রয়েছে দিনের আলোর যথাযথ ব্যবহার। প্রাকৃতিক আলো বছরের বিভিন্ন সময় একই স্পেসকে ভিন্ন ধরনের চরিত্রে রূপায়িত করে, তাই তিনি তাঁর কাজে অতি দক্ষতার সঙ্গে প্রাকৃতিক আলোর পরিমাণকে নিয়েই শুধু চিন্তাই করেননি, বরং আলোর মান নিয়ন্ত্রণেও রেখেছেন ভিন্ন এক মাত্রা। অন্যদিকে কৃত্রিম আলোকায়ন সাধারণত প্রাকৃতিক আলোর সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। এবং একটা স্পেসকে সম্পূর্ণ ভিন্ন উপলব্ধি দিতে সাহায্য করে। বারগেনের স্থাপত্যকর্মে সিলিং লাইটের অনুপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। বেশির ভাগ সময় কৃত্রিম আলোর উৎসের কেন্দ্র হিসেবে বারগেন বেছে নিতেন মেঝে অথবা আসবাব এবং দেয়াল ও সিলিং এ সৃষ্টি করতেন কোমল কিন্তু পরোক্ষ পরিবেশ। কৃত্রিম আলোকে তিনি প্রাকৃতিক আলোর পরিপূরক নয় বরং একটি স্পেসের রহস্যময় ধারণা দিতে ও অন্তরঙ্গতা তৈরি করার উপকরণ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

বারগেন প্রকল্পে রং নির্বাচনের বিষয়টিও দেখতেন খুবই গুরুত্বের সঙ্গে। অভ্যন্তরের দেয়ালের অধিকাংশেই সাদা ব্যবহার করেছেন এবং ভবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোকে করেছেন তীব্র গোলাপি, হলুদ বা কমলা রং। বারগেন রং নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একধরনের ইফেক্ট আবিষ্কার করেছিলেন, যাকে বলা হয় ‘কালারড লাইট’। আলোক উৎসগুলোকে গোপন রেখে স্টেইন্ড গ্লাসের সাহায্যে শয়নকক্ষগুলোকে মৃদু আলো এবং অন্যান্য স্পেসে উষ্ণ আলোর মাধ্যমে নকশায় এক চমৎকার সংমিশ্রণ তৈরি করতেন, যা অভ্যন্তরীণ স্পেসের মান এবং সেই স্পেসে আগমনকারী একজন ব্যক্তির অনুভূতির দেয়ালে শীতল, স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়, সৃষ্টি করে অপূর্ব এক ইন্দ্রজাল। এ ছাড়া বারগেন মেক্সিকোর আবহাওয়াকে বিবেচনা করে সর্বপ্রথম টেরাস, রুফ স্পেস, পোরচের মতো পেসিভ স্পেসের ব্যবহার এনে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মেক্সিকোর সমসাময়িক স্থাপত্যে এক নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেন।

গিলারদি হাউস, মেক্সিকো, রঙের বিসদৃশ্যতা এবং সংমিশ্রণ, বারগেন হাউস, মেক্সিকো, গিলারদি হাউসে প্রাকৃতিক আলোর সঞ্চার ও কুয়াদ্রা সান ক্রিসটোবাল, মেক্সিকো (উপরে বা থেকে)

লুইস বারগেন তাঁর স্থাপত্যকর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন কীভাবে ঐতিহ্যকেন্দ্রিক একটি নকশাও সমসাময়িক হতে পারে। যদি ফ্যাশনকে আর্কিটেকচার থেকে আলাদা করে রাখা হয়, তবে স্থাপত্যের লক্ষ্য হলো সময় নিরপেক্ষতা অর্জন, যা প্রতিফলিত হয়েছে বারগেনের চেতনা ও স্থাপত্যকর্মে। ১৯৮৮ সালে মহাপ্রয়াণ ঘটে মহা এ স্থপতির।

আঞ্জুমান আফসারি নিসা, শিক্ষার্থী, স্থাপত্য বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৫ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top