দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহমেদ

একজন স্থপতির দায় অসীম। মানুষের জন্য স্থাপত্য! তাই একজন স্থপতিকে একদিকে যেমন মানুষের স্বপ্ন ও চাওয়ার বাস্তবায়ন ঘটাতে হয়, তেমন অন্যদিকে প্রকৃতি, সমাজ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিও সমান দায়িত্ববান হতে হয়। আর এসব দায়িত্ববোধকে স্থাপত্যচর্চার ভিত্তি মনে করেন স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহমেদ। স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘স্থাপতিক’-এর কর্ণধার ও প্রধান স্থপতি তিনি।

সম্প্রতি বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহমেদের প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৪ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘সিস্টেম আর্কিটেক্টস’-এ বেশ কিছু দিন স্থাপত্যচর্চা করেন। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নিজস্ব স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘স্থাপতিক’। বিগত এক দশকের যাত্রায় স্থপতি শরীফ উদ্দিনের কাজে পরিস্ফুটিত হয় স্বদেশীয় স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের অবয়ব। কিন্তু বিবর্তন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সময়ের সমসাময়িক চাহিদাকেও স্থাপত্যচর্চায় সংমিশ্রণ ঘটান তরুণ এ স্থপতি।

কোনো স্থাপনাকে একটি একক বিচ্ছিন্ন কাঠামো হিসেবে দেখাননি, বরং প্রতিটি ভবন একটি ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে স্থান পায় তাঁর চেতনা ও স্থাপত্যকর্মে। ধারাবাহিকতার মানে স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহমেদের কাছে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, একটি শহর বা অঞ্চলের সর্বাঙ্গীণ কাঠামোর ধারাবাহিকতা অথবা জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা। স্থাপত্যে এমনই ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটান স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহমেদ, যার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর নকশাকৃত অধিকাংশ স্থাপনায়।

সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরা আবাসিক এলাকায় অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD)-এ আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি স্কুল ডিজাইন করেছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল শিশুদের জন্য যথোপযুক্ত খোলামেলা পরিসর তৈরি করা, যা কি না শিশুদের মানসিক বিকাশে সহায়ক হবে। বর্তমান অবকাঠামো পরিবর্তন না করে, যেমন- জমিতে একটি পূর্ববর্তী স্থাপনার সঙ্গে ছিল কিছু গাছ, সবকিছুকে নকশার আওতাভুক্ত করে কিংবা বিবেচনায় এনে নতুন এ নকশাটি করেন। উল্লেখযোগ্য, স্কুলের বাইরে উত্তর পাশের জমিতে একটি নয়তলা বহুতল ভবন রয়েছে, যেটাকে আসলে স্কুলের ব্যাকড্রপ হিসেবে ভাবা হয়েছে। একই সঙ্গে যেন পর্যাপ্ত সূর্যালোক বহুতল ভবনে বিকীর্ণ হয়ে শ্রেণিকক্ষে ঢুকতে পারে সে কারণে ছাদকে সমতল না রেখে হেলানো হয়েছে। বর্তমান অবকাঠামোকে পরিবর্তন না করে নকশাটি করার প্রধান উদ্দেশ্য খরচ কমানো এবং নির্ধারিত নির্মাণ সময় কমিয়ে আনা। উল্লেখ্য, এই ভবন নির্মাণের সময়সীমা মাত্র দুই মাস।

লিটল ওয়ান্ডার স্কুলের (উত্তরা) গেমস জোন

ঢাকা শহরের স্কুল বলতে আজকাল আমরা কোনো মাঠ ছাড়া শুধু শ্রেণিকক্ষ বুঝি। কিন্তু এই প্রকল্প শুরুর আগে তাঁকে চিন্তা করতে হয়েছে খেলার মাঠকে কেন্দ্র করে কীভাবে জোনিং করা যায়। সবচেয়ে ভালো জোনিং করার ক্ষেত্রে যে প্রযোজ্য বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, জলবায়ু, আশপাশের স্থাপনা ও গাছপালা, জমিতে বিদ্যমান স্থাপনা ওং গাছপালা এবং মাঠের প্রভাব থাকে এমন একটি স্কুলের নকশা প্রণয়নের।

পুরো প্রকল্পকে একটি প্যাভিলিয়নের মতো করে চিন্তা করা হয়েছে, যা খোলা উদ্যানের একটি অবিচ্ছিন্ন অংশ যেন। আর এ জন্যই শ্রেণিকক্ষগুলোকে এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ স্থানগুলোকে এককভাবে একটি বিস্তৃত উদ্যান হিসেবে শিশুরা ব্যবহার করতে পারে। শ্রেণিকক্ষের দুই পাশে দেয়ালের পরিবর্তে বিশেষভাবে একটি দরজা ডিজাইন করা হয়েছে, যা অপসারণ করে অভ্যন্তরীণ উঠোন এবং বাইরের উদ্যানের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের প্রবাহের কারণে কক্ষগুলো হয়ে ওঠে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই স্কুল নকশা করার সময় একটি মাঠের কথা চিন্তা করা হয়েছে, সেই সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট জায়গাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। যেমন- এখানে একটি Sand Court-এর সঙ্গে Amphitheatre আসনবিন্যাস রয়েছে, সঙ্গে আরও রয়েছে একটি কলাগাছ Court, যা লাইব্রেরি ও পিয়ানো কক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত। স্কুলের সেট ব্যাক স্পেসগুলোকে নকশার মাধ্যমে এমনভাবে কাজে লাগানো হয়েছে, যা শ্রেণিকক্ষের বাইরের জায়গার প্রসার হিসেবে ভাবা হয়েছে।

পুরো স্কুলকে একটি ‘খ’ আকারের কাঠামো এবং একই সঙ্গে একটি অভ্যন্তরীণ খেলার মাঠকে স্থান দিতে পারে সে হিসেবে চিন্তা করা হয়েছে। এখানে জলবায়ু শর্তকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক আলো প্রবেশের জন্য এবং ছাদ থেকে বিকীর্ণ আলো আনা হয়েছে এবং বাতাস চলাচলের গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে এমন কোনো দেয়াল রাখা হয়নি। এর পরিবর্তে বিশেষভাবে নকশাকৃত ফোল্ডিং দরজা বানানো হয়েছে। এই অপসারণকৃত দরজাগুলোকে একত্রে খুলে দিলে শ্রেণিকক্ষগুলোকে অনেক বড় মনে হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো প্রাকৃতিক ধারণক্ষমতার যে প্রক্রিয়াগুলো রয়েছে Reduce, Reuse, Recycle-কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিশেষভাবে।

স্কুলে বিভিন্ন অংশে দেশীয় নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার

প্রকল্পের উদ্যোক্তা স্কুলের এই জমিটি পাঁচ বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন, যার কারণে প্রথম থেকেই এই প্রকল্পকে একটি অস্থায়ী স্থাপনা হিসেবে চিন্তা করা হয়েছে। সেখানে থেকেই আসলে বাঁশ ব্যবহার করার ভাবনাটা আসে। বাঁশ ব্যবহারের বিষয়কে তিনি আসলে কোনো চল হিসেবে চিন্তা করেননি। এই উপাদানটি স্থানীয়, সেই সঙ্গে সুলভ এবং পরিবহন খরচ এবং নির্মাণে সবচেয়ে সহজ, তাই এটিকে নির্মাণ উপকরণ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

দেয়ালপৃষ্ঠ ইট, ছাদটি সম্পূর্ণ বাঁশ দিয়ে এবং সঙ্গে G.I Sheet-এর আবরণ, জানালা স্টিল এবং কাচ, দরজা কাঠ দিয়ে করা হয়েছে। মেঝে চলাচলের অংশগুলো অনাবৃত ইট এবং শ্রেণিকক্ষে রঙিন NCF দিয়ে করা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতিটি উপাদানের রূপায়িত শক্তি খুবই কম। যেহেতু শিশুদের স্কুল তাই স্বদেশি উপকরণ ব্যবহার করে একটি পরিবেশবান্ধব প্রকল্প তৈরির চেষ্টা লক্ষণীয়, যা তাদের স্বদেশীয় চিন্তা বিকাশে সহায়ক হবে।

ব্যতিক্রমী এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহমেদের বেশ কিছু প্রকল্প জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। এমন একটি প্রকল্প অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। এই প্রকল্পটি জাতীয় পর্যায়ে, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট কর্তৃক আয়োজিত ডিজাইন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছেন।

বৃহদায়তন প্রকল্পেও স্বদেশীয় ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আধুনিক স্থাপত্যের ভাষাকে রপ্ত করেছেন স্থপতি। অগ্রণী ব্যাংক প্রকল্পে মূল ধারণা ছিল বাংলাদেশের স্বদেশীয় বসতবাড়ির বিন্যাস ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করা। পাবলিক স্পেস ও প্রাইভেট স্পেসকে অভ্যন্তরীণ উঠানের মাধ্যমে যুক্ত করে এই ভাষার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে অগ্রণী ব্যাংক প্রকল্পে। একই সঙ্গে আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খোলা জায়গা, গাছ ও প্রয়োজনীয় শেডিং ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা শহরের উন্মুক্ত জায়গার ঘাটতিকে মাথায় রেখে বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় তৈরি করা হয়েছে সবুজ ও গাছসমৃদ্ধ ওপেন টেরাস।

স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহমেদ প্রতিটি প্রকল্পে স্বকীয়তা অর্জনের চেষ্টা করেছেন সব সময়। তাঁর অন্যতম ব্যতিক্রমী একটি কাজ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য ডিজাইন করা, স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার। এই প্রকল্পটির কাজ শুরুর প্রাক্কালে স্থপতি নতুন নকশার ভিত্তি হিসেবে উপকূলীয় ঘরবাড়ির নির্মাণকৌশল ও উপকরণ পর্যবেক্ষণ করেন। এই আঞ্চলিক নির্মাণজ্ঞানই নতুন প্রকল্পের জন্য অভিনব ও টেকসই স্থাপত্যের মূল ধারণা হিসেবে কাজ করে। উপকূলীয় অঞ্চলের ভবন ডিজাইনে রয়েছে নানা দুর্বোধ্যতা। লবানক্ত পানি কংক্রিটের ভবনের দীর্ঘস্থায়িত্বতা নষ্ট করে, অন্যদিক ঝড় ও বন্যার প্রকোপে সম্পূর্ণ আঞ্চলিক নির্মাণকৌশল অনেক ক্ষেত্রেই নাজুক ও দুর্বল। তাই গবেষণার প্রাপ্ত কাঠামোগত কৌশলের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে আঞ্চলিক নির্মাণজ্ঞান ও উপকরণকে, যার ফলে এই সাইক্লোন শেল্টার প্রকল্পটি গতানুগতিক ধারার বাইরে, ব্যতিক্রমী একটি প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। শুধু ব্যবহার উপযোগিতাই এই প্রকল্পের সার্থকতা নয়, বরং নান্দনিকভাবেও অত্যন্ত ভিন্ন ধারার বৈশিষ্ট্য বহন করে। গবেষণার প্রাপ্ত কাঠামোগত কৌশলের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে আঞ্চলিক নির্মাণজ্ঞান ও উপকরণের। এসব বৈচিত্র্য ও ব্যতিক্রমী ধারণার প্রতিফলনের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হয়েছে দারুণ সমাদৃত। ওয়ার্ল্ড আর্টিটেকচার কমিউনিটি অ্যাওয়ার্ড সাইকেল ৫-এ নির্বাচিত হয়েছে সাইক্লোন শেল্টার প্রকল্পটি।

লিটিল ওয়ান্ডার স্কুলের একটি সেকশন ড্রয়িং স্কেচ ও উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য ডিজাইনকৃত স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টারের ড্রয়িং স্কেচ

দীর্ঘ ১২ বছরের স্থাপত্যচর্চায় এমন ছোট-বড় অসংখ্য প্রকল্পের কাজ করেছেন স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহমেদ। স্থাপত্যচর্চায় নিজস্ব ধারণার পাশাপাশি তিনি বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন পথপ্রদর্শক প্রবীণ স্থপতিদের কাজ, নির্মাণকৌশল ও চেতনাকে। প্রতিনিয়ত গ্রহণ করেছেন সমসাময়িক প্রযুক্তি ও বিবর্তনকে। কিন্তু স্বদেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করেই তাঁর স্থাপতিক চিন্তাধারা আবর্তিত হয়েছে। একই সঙ্গে পরিবেশ ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধকে স্থাপত্যচর্চার অনুপ্রেরণা মনে করেন স্থপতি শরীফ উদ্দিন আহমেদ।

স্থপতির সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও লেখা
স্থপতি শফিক রাহ্‌মান
প্রভাষক, স্থাপত্য বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৬ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top