স্থাপত্য সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। স্থাপনার নির্মাণশৈলীই কোনো দেশ বা জাতির রুচি, সংস্কৃতিবোধ ও সমৃদ্ধতা তুলে ধরে। তাই স্থাপত্যের সঙ্গে সভ্যতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। স্থাপত্যের রূপকার একজন স্থপতি, যিনি তাঁর জ্ঞান, মেধা ও সৌন্দর্যবোধের মিশেলে গড়ে তোলেন একটি স্থাপনা। তিনি শুধু স্থাপনাই নয়, গড়েন সভ্যতাও। কালে কালে রাজা-বাদশা, জমিদার, বিত্তবান, করপোরেট প্রতিষ্ঠান স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। তাদের চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে অনেক স্থপতিই ভুলতে বসেছেন দেশীয় ঐতিহ্য। যার ছাপ এ দেশের স্থাপনায় লক্ষণীয়। তবে কেউ কেউ আধুনিক স্থাপত্যেও ফুটিয়ে তোলেন চিরচেনা দেশজ আদল। এ রকমই একজন স্থপতি জালাল আহমেদ, যিনি তাঁর কাজকে শহরের চৌহদ্দিতে বন্দী না রেখে ছড়িয়ে দিয়েছেন গ্রাম-গঞ্জে, নগর ও জনপদে। মানুষকে শিখিয়েছেন স্বল্পব্যয়ের আবাসন নির্মাণকৌশল। বাংলাদেশের স্থাপত্যকলার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি।
স্বনামধন্য এই স্থপতির জন্ম ১৯৫৯ সালের ১৭ মার্চ, সিলেটের আম্বরখানায়। বাবা প্রয়াত আনোয়ার উদ্দিন আহমেদ ও মা মাছুমা বেগম। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট। জন্মস্থান সিলেট হলেও বাবার পুলিশে চাকরির সুবাদে বেশি দিন থাকা হয়নি সেখানে। চলে আসেন পুরোনো ঢাকায়। ছেলেবেলাও কেটেছে এখানে। আরমানিটোলা সরকারি বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে এসএসসি ও নটর ডেম কলেজ থেকে ১৯৭৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যে গ্র্যাজুয়েশন করেন ১৯৮৩ সালে। স্নাতক শেষে শুরু করেন স্থাপত্যচর্চা। তিন বন্ধু যৌথ প্রয়াসে গড়ে তোলেন ডায়াগ্রাম আর্কিটেক্টস নামক স্থাপত্য ফার্ম। বুয়েটে পড়াকালীন বেশ কিছু কাজ করলেও এই ফার্মটির একজন অংশীদার হিসেবেই শুরু পেশাদারির। স্থাপত্যচর্চার পাশাপাশি ফার্মটি থেকে বিভিন্ন ডিজাইন কম্পিটিশনেও অংশ নিতেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৮৪ সালে ‘মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ ওপেন ডিজাইন কম্পিটিশন’। বন্ধুরা মিলে স্থানটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ডিজাইন করেন সৌধ ও এর পরিসর। আমবাগানের বিশাল এলাকাকে স্থাপত্য ডিজাইনের আওতায় নিয়ে আসেন, যা বাংলাদেশের স্থাপত্য নকশায় আগে দেখা যায়নি। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের তাৎপর্য ও ভাবগাম্ভীর্য বিবেচনায় ইট-কংক্রিটের কাঠামো, বিভিন্ন তথ্যসংবলিত ফলক, ছবি, মিউজিয়াম, সেমিনার হল ইত্যাদি ডিজাইনে রাখা হয়, যাতে আগত দর্শনার্থীরা স্থানটির ইতিহাস জানতে পারেন। স্থাপত্যবোদ্ধাদের মধ্যে ডিজাইনটি সৃষ্টি করে চমক। আর তাই তাঁরা কম্পিটিশনে যুগ্মভাবে অ্যাওয়ার্ড জেতেন। এই সাফল্যমণ্ডিত স্বীকৃতি তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি করে ব্যাপক প্রেরণার। দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করতে থাকেন অন্যান্য প্রকল্পের। মিরপুর ল্যাবরেটরি গার্লস স্কুলের গেইটের ডিজাইন, আবাসন প্রকল্প, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পসহ বিভিন্ন স্থাপত্যিক কাজ করে চলেন একের পর এক। ১৯৯৭ সালে স্থপতি আতিকুল হক/স্থপতি সাইফুলকে/অন্য একজন পার্টনারকে সঙ্গে নিয়ে পৃথকভাবে ডিজাইন ওয়ার্কশপ নামক নতুন ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটির নাম দেওয়া হয় জে এ (জালাল আহমেদ) আর্কিটেক্টস। এরপর ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। স্থপতি নিজেই হন প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট।

স্থপতি জালাল আহমেদের স্থাপত্যে রয়েছে নিজস্ব ঢং। স্থাপত্যিক উপাদানের বাহুল্য নেই বললেই চলে। তাঁর স্থাপত্যে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতিফলন লক্ষণীয়। দেশীয় জলবায়ু, পরিবেশ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ফুটে ওঠে তাঁর স্থাপত্যকর্মে। বাড়ির ভেতরে উঠোনের আদলে খোলা জায়গা, প্রশস্ত বারান্দা, কোটইয়ার্ড, প্রশস্ত সিঁড়ি, স্থাপনার কোথাও পুকুর বা পানি ব্যবহারের চেষ্টা- এসবই তাঁর ব্যতিক্রমী চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন। স্থাপনায় বাড়তি কিছু না চাপিয়ে সেখানে ইট, ফেরোসিমেন্ট ব্লক, পোড়ামাটির টালি, কাঠ, বাঁশ, বাঁশের চাটাই, ভেন্টিলেটর হিসেবে জালি ইত্যাদি দেশীয় উপাদানের ব্যবহারই বেশি। অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে গতানুগতিক ধাঁচের বাইরে প্রকাশ পায় ব্যতিক্রমী আধুনিকতা। দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে বাঁচতে থাকে প্রশস্ত বারান্দা, যা ক্রমেই হারিয়ে নগরের ফ্ল্যাটবাড়িতে। কিন্তু এটাই শহরের বুকের বহুতল ভবনের একমাত্র সেমি ওপেন স্পেস। এর আবেদন কিন্তু প্রাসঙ্গিক। যেখানে পরিবারের সবাই মিলিত হয়ে ভাগাভাগি করা যায় আনন্দ-বেদনা। যেখানে রোদ উঁকি দেয়, বৃষ্টির ছাঁট আসে, বাতাস বয়, কিছুটা হলেও থাকা যায় প্রকৃতির কাছাকাছি। শহর বা গ্রাম, যেখানেই হোক তিনি চেষ্টা করেন দেশীয় ঐতিহ্যবাহী উপকরণগুলোকে প্রাধান্য দিতে।
স্থপতির উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে বিল্ডিং প্রজেক্ট, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, করপোরেট অফিস ভবন, অ্যাপার্টমেন্টস, লো-কস্ট হাউজিং, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, বন্যাপ্রবণ জনপদের কাঠামোগত উন্নয়ন প্রভৃতি। প্রতিটি প্রকল্পে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। যেমন রাজধানীর উত্তরার একটি লিডিং প্রাইভেট স্কুল স্কলাস্টিকার ক্যাম্পাস ডিজাইন। ১৯৯৭ সালে তিনি এই প্রকল্পটির কাজ হাতে নেন। কাজটি তাঁর জন্য ছিল দারুণ চ্যালেঞ্জিং। জমির উচ্চমূল্যের কারণে স্কুল কর্তৃপক্ষ মাত্র এক একর জমি প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেয়। কিন্তু সে তুলনায় ক্লায়েন্টের দাবি ছিল বেশি। স্বল্প পরিসরের মধ্যেও শিক্ষার্থীরা যাতে সুন্দর পরিবেশে লেখাপড়া নিশ্চিত করতে পারে, সে জন্য তিনি সব ধরনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। ভবনের মধ্যে উঠোনসদৃশ খালি জায়গা রাখেন শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও হাঁটাচলার জন্য। এর চারপাশ ঘিরে গড়ে তোলেন ভবনগুলোকে। কোলাহল ও শব্দে যেন সমস্যা না হয় তাই প্রশাসনিক ভবন, ল্যাবরেটরি ও মাল্টিপারপাস হলকে রাস্তার পাশে রেখে সেগুলোতে যুক্ত করা হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। ক্লাসরুমগুলোতে শীতাতপসুবিধা না থাকায় কোলাহল থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখেন। প্রকল্পটি করতে সময় লাগে প্রায় দুই বছর। তৎকালীন ট্রেন্ড অনুযায়ী প্রকল্পটি স্বীকৃতি লাভ করে আধুনিক স্থাপত্যের নান্দনিকতার। স্থপতি এখানে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যতটা সম্ভব বেশি সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। শিক্ষার্থীদের বড় খেলার মাঠ দিতে না পারলেও দিয়েছেন ছোট পরিসরের মাঠ।

এনজিও প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের আওতায় ১৯৯১ সালে একটি ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্স সেন্টার প্রকল্পের কাজ করেন ফরিদপুরে। প্রকল্পটির আওতায় ছিল প্রশিক্ষণার্থীর হোস্টেল ব্লক, শিক্ষকদের ডরমেটরি, ডাইনিংরুম, মাল্টিপারপাস হল, প্রশাসনিক ভবন প্রভৃতি। বাজেটও ছিল কম। বন্যাপ্রবণ এলাকা তাই এর ডিজাইনেও আনা হয় ভিন্নতা। বন্যার কবল থেকে মুক্ত রাখতে সেখানে কাটা হয় একটি বড় পুকুর এবং যা মাটি দিয়ে ভরাট করে উঁচু করা হয়। গতানুগতিক ধারার বাইরে গ্রামীণ সংস্কৃতির আদলে উঠোন করেন। অন্যান্য ট্রেনিং সেন্টারের মতো ভবনগুলোকে লম্বা করিডোরবিশিষ্ট না করে দোতলা বাড়িগুলোকে ছোট ছোট ইউনিট করে তিনি উঠোনের চারপাশে ছড়িয়ে দেন। প্রতিটি বাড়িতে অন্তত ১০ জন যেন থাকতে পারে সে ব্যবস্থা করেন। ফলে সেন্টারটিতে প্রশিক্ষণ নিতে আসা নারী-পুরুষেরা সম্পূর্ণ প্রাইভেসি বজায় রেখে পৃথকভাবে নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তা পায়। স্থাপনাগুলোও তৈরি করেন ইট নির্মিত দেশীয় স্থাপত্যরীতির চৌচালা আকারে। এ ছাড়া বগুড়া ও রংপুরেও প্রতিষ্ঠানটির হয়ে সমধর্মী দুটি প্রকল্প করেন, যেগুলোতেও ফুটে উঠেছে দেশীয় ও মোগল স্থাপত্যরীতির চমৎকার এক সমন্বয়।
স্থপতি গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন নিয়েও কাজ করেছেন। হাতে-কলমে শিখিয়েছেন স্বল্পব্যয়ে আবাসন নির্মাণকৌশল। যশোরের হৈবাতপুরে ১৯৯২-৯৪ সালে ইনস্টিটিউট ফর ট্রেইনিং রিসার্স অ্যান্ড ডেমনেসট্রেশনের অধীনে করেন ‘বাঁচতে শেখা’ নামক একটি এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্ট। প্রকল্পটিতে গ্রামীণ আবাসনসমস্যা সমাধানে স্বল্পব্যয়ে সাসটেইন্যাবল আবাসন নির্মাণকৌশল স্থানীয় বাসিন্দাদের শেখানো হয়। সেখানে তিনি মাটির সঙ্গে সিমেন্ট মিশিয়ে ইটের আদলে বিশেষ ধরনের ব্লক তৈরি করেন। এগুলো তিনি ব্যবহার করেন ঘরের দেয়াল নির্মাণে। তাঁর সৃষ্ট মাটির ব্লকের সাহায্যে কাঠামো নির্মাণ-প্রক্রিয়াটিও আলোড়ন তোলে। ২০০১ সালে কুষ্টিয়ার মিরপুরে করেন ‘পালক পল্লী’ নামক একটি এতিমখানা ও প্রাথমিক বিদ্যালয় (রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার) ডিজাইনের কাজ।

স্থপতি জালাল আহমেদ এবং স্থপতি রেজাউল করিম প্রাকটিক্যাল অ্যাকশন এনজিওর উদ্যোগে ২০০৭ সালে গাইবান্ধায় শুরু করেন ‘রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার’-এর স্থাপত্য ডিজাইন ও মাস্টারপ্ল্যান। প্রকল্পটি ছিল ‘ডিজঅ্যাপেয়ারিং ল্যান্ডস হেলপিং কমিউনিটিজ অ্যাফেক্টেড বাই ফ্লাড রিভার ইরোজন’। প্রকৃতপক্ষে এটি গাইবান্ধার বন্যা উপদ্রুত এলাকার আবাসন প্রকল্প। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বিশাল এই এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকে আবার শুষ্ক মৌসুমে হয় খটখটে খরা। খরাপীড়িত এবং বন্যা উপদ্রুত এলাকায় প্রধান জীবিকা কৃষি হওয়ায় সেখানে টিকে থাকা খুবই দুরূহ। ফলে স্থপতির ওপর দায়িত্ব পড়ে তাদের পুনর্বাসন করার। মূলত বন্যার সময় মানুষগুলোকে একটু উঁচু জমিতে বসবাস করার ব্যবস্থা ও তাদের জীবিকা নির্বাহ করার ব্যবস্থাই এই সেন্টারের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়; এর সঙ্গেই আছে বিভিন্ন সময় মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করার জন্য সার্বিক ব্যবস্থাপনাও। ইট, কাঠ, বাঁশ, টিন ইত্যাদির সাহায্যে তৈরি করেন চার ও দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘর, কমিউনিটি হল, স্কুল, মসজিদ, দোকান, গরু-ছাগলের খামার, সম্মিলিত স্নানাগার ও শৌচাগার। পরিবারগুলোর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, জ্বালানিসাশ্রয়ী চুলা ইত্যাদির ব্যবস্থাও করেন। প্রকল্পটিতে বড় পুকুর খনন করে তার মাটি দিয়ে ভ‚মি উঁচু করেন, যাতে বন্যার পানি ঢুকতে না পারে। তবে তিনি জানতেন যদি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে তারা এখানে বেশি দিন থাকবে না। অর্থাৎ তাদের ফিরিয়ে আনলেই চলবে না, ধরেও রাখতে হবে। এসব বিবেচনায় তিনি নানামুখী স্ব-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেই করেন ডিজাইনটি। কুমড়া, বাদামসহ অন্যান্য ফসলের চাষ ছাড়াও খণ্ডকালীন কাজ হিসেবে ভাসমান শাকসবজির খেত, খাঁচায় মাছ চাষ, মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি, হাল চাষ, গরু পালন ইত্যাদি। মহিলাদের জন্য সেলাই, পিঠা বানানো, গরু-বাছুর পালন, হাঁস-মুরগি পালনের মতো নানা ব্যবস্থা রাখেন। গ্রাম্য পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে করেন বিভিন্ন ভেষজ ও ফলদ বাগান। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়েই করা হয় কাজগুলো। প্রকল্পটি এখনো শেষ না হলেও ব্যয়কৃত অর্থ উঠে আসতে শুরু করেছে। নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে স্থানীয় বন্যাপীড়িত মানুষগুলোই নির্মাণব্যয়ের ৩০ শতাংশ ইতিমধ্যেই তুলে এনেছে। এটাই এই প্রজেক্টের সার্থকতা প্রমাণ করে। চর এলাকাতে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের মধ্যে এটাই এ যাবৎকালের শ্রেষ্ঠ আবাসন প্রকল্প।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে আইলাবিধ্বস্ত জনপদে প্রাকটিক্যাল অ্যাকশন এনজিওর আওতায় দুর্যোগ প্রতিরোধক বাড়ির মডেল ও নির্মাণকাজ পরিচালনা করেন স্থপতি। স্থানীয় বাড়িগুলোর প্রকৃতি ও ঐতিহ্য স্টাডি করে কয়েক ধরনের বাড়ির ডিজাইন করেন। গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়েই এই ওয়ার্কশপ করেন ও ট্রেনিং দেন, যেন পরবর্তী সময়ে তারা নিজেরাই তা করতে পারে। সমস্যা যেহেতু জলোচ্ছ্বাস, তাই বাড়ির ভিতকে উঁচু করেন। ফেরোসিমেন্ট ও আরসিসি পিলার, মাটির ব্লক, বাঁশ, কাঠ, টিন ইত্যাদি দিয়েই বাড়িগুলোকে নির্মাণ করেন। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য গোলপাতা বাড়িগুলোর ছাদ বা চাল তৈরিতে ব্যবহার করেন। কিছু কিছু বাড়িতে ব্যবহার করেছেন টিন ও টালি।

বৃহৎ প্রকল্প থেকে ছোট পরিসরের বাড়ি সব ধরনের কাজেই রয়েছে তাঁর সমান পদচারণ। মাল্টিফ্যামিলি অ্যাপার্টমেন্ট করেছেন রাজধানীর বেশ কিছু স্থানে। উপজেলা পরিষদ ভবন, ব্যাংক ভবন, ক্লাব, করপোরেট ভবন ইত্যাদির ডিজাইন, প্ল্যানিং ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে। নান্দনিক এসব কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জয় করেছেন বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড। ফ্রাঙ্কো জার্মান অ্যাম্বাসি কমপ্লেক্স ইন্টারন্যাশনাল ডিজাইন কম্পিটিশনে (২০০৯) তৃতীয়; নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ইন্টারন্যাশনাল ওপেন ডিজাইন কম্পিটিশনে (২০০২) তৃতীয়; উত্তরা ক্লাব কমপ্লেক্স ডিজাইন ওপেন কম্পিটিশনে (১৯৯৫) তৃতীয় এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফেয়ারে বিসিআইসি প্যাভিলিয়ন ডিজাইন কম্পিটিশনে (১৯৮০) দ্বিতীয় অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী হন। তবে এতসব সাফল্যের পেছনে কিছুটা অতৃপ্তিও রয়েছে তাঁর। বিভিন্ন কম্পিটিশনে অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত অনেক ডিজাইনই বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি। প্রকল্পগুলো স্থাপত্যে রূপলাভ না করা কিছুটা মনঃকষ্টে ভোগেন। তবে থেমে থাকেননি। নিজের গতিতেই কাজ করে চলেছেন। বর্তমানে মেরুল বাড্ডায় নির্মাণাধীন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রায় ১২ লাখ বর্গফুটের ক্যাম্পাস প্রকল্পের সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত আগা খান অ্যাওয়ার্ডজয়ী স্থপতি ওহার পাশাপাশি লোকাল অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করছেন। এ ছাড়া কোরিয়ান ইপিজেডে কিছু পরিবেশবান্ধব ফ্যাক্টরি বিল্ডিং ডিজাইনের কাজ করছেন; ইতিমধ্যেই যার হেডকোয়ার্টারের কাজ শেষ হয়েছে। সিলেটে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রকল্পের কাজও করছেন এই সময়ে আলোচিত এই স্থপতি।
স্থপতিদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ একজন ক্লায়েন্টের প্রত্যাশাকে পূরণ করা। অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা আসেন একটি নান্দনিক ভবন পেতে। ভবনে অনেক কিছুই সংযোজন করতে চান। কিন্তু তাঁদের চাওয়া অনুযায়ী ডিজাইন করা হলেও অর্থস্বল্পতা, সীমাবদ্ধতা বা ডিজাইন না বুঝেই প্রকল্পের পরিবর্তন করতে চাওয়ায় ক্লায়েন্ট ভিন্নতা চাইলেও তা বাস্তবায়নের সাহস পান না। এই সমস্যা মোকাবিলা করে মানিয়ে নিয়ে কাজ করতে পারাই একজন স্থপতির সাফল্য। ক্লায়েন্টকে কম বাজেটে ভালো ডিজাইন উপহার দিতে হবে। বাংলাদেশে স্থপতির সংখ্যা অনেক কম। ফলে অভাব রয়েছে মানসম্মত কাজের। দেশের স্বার্থে স্থপতিদের এক হয়ে কাজ করতে হবে। আর তাই স্থপতি জালাল আহমেদের ফার্মে সহস্থপতির দায়িত্বে আছেন স্থপতি আতিকুল হক ও পরিচালক ইসমাইল ইবরাহীম। এ ছাড়া ছয়জন স্থপতি, চারজন ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য মিলিয়ে ১৫-১৬ জনের একটি তরুণ, সৃষ্টিশীল এবং মেধাবী দল প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত থেকে পেশাগতভাবে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সদা প্রস্তুত। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার্নশিপরত শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর থাকে এই ফার্মটি।

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ্য করে তুলেছেন। বেড়াতে ভালো লাগে তাই সুযোগ পেলেই দেশ-বিদেশ ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। অবসরে পরিবারকে সময় দেন। তাঁর স্ত্রী ড. আফরোজা আহমেদ একজন স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ। জে এ আর্কিটেক্টের বর্তমান চেয়ারপার্সনও তিনি। এই স্থপতি দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা বিদেশে পড়ছে। মেয়ে মায়িশা মালিহা মৌ আমেরিকার নিউইয়র্কে পেইস ইউনিভার্সিসিটিতে কমিউনিকেশনে এবং ছেলে জাহিন আনোয়ার আহমেদ কানাডার অটোয়া কার্লটান ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস লতে পড়ছে। পাঠ্য বিষয় এবং কাজের ক্ষেত্র স্থাপত্য হওয়ায় নিজেকে সৃজনশীলতার অংশ মনে করেন তিনি। মানুষ হিসেবে সংস্কৃতিমনা। নটর ডেম কলেজে পড়াকালীন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক ‘ফোকাস’ দেয়াল পত্রিকা বের করতেন। এ জন্য তাঁকে কর্তৃপক্ষ ম্যান ইন ফোকাস উপাধিতে ভূষিত করে। অ্যাওয়ার্ডও পান। কলেজে বিতর্ক করতেন। স্কুলের বাস্কেটবল দলে ছিলেন। তাঁর প্রিয় খেলা বাস্কেটবল। একসময় জড়িত ছিলেন ‘উন্মাদ’ পত্রিকার সাথে। তাঁর ডিজাইনকৃত বিভিন্ন স্থাপত্য নিয়ে আর্কিটেকচার এশিয়া, ওপেন হাউস, আর্কিটেক্ট প্লাস, ইন্ডিয়ান আর্কিটেক্টট অ্যান্ড বিল্ডার, নিউইয়র্কের আর্কিটেকচার লিগ, দ্য ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, স্থাপত্য ও নির্মাণসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এখনো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সেমিনার, রেডিও এবং টেলিভিশন প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে বক্তৃতা ও প্রেজেনটেশন পেপার উপস্থাপন করেন।
কাজের প্রয়োজনে ছুটে চলেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তারপরও সমাজের প্রতি অনুভব করেন দায়বদ্ধতা। এ থেকেই তিনি ও তাঁর সহধর্মিণী ২০০৬ সালে রাজধানীর রায়েরবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রিক্রিয়েশন সেন্টার’ নামক সেবামূলক ট্রাস্ট। পথশিশুদের কল্যাণার্থে কাজ করছে সংগঠনটি। প্রায় ১৫০ পথ শিশু নিবন্ধিত আছে এখানে। সমাজের অবহেলার শিকার এসব পথশিশু কোনো না কোনোভাবে আয় করলেও তাদের নেই কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা টাকা গচ্ছিত রাখার নিরাপদ জায়গা। ফলে তারা যা আয় করে তা খরচ করে, চুরি হয় বা পুলিশে নেয়। তাই সংগঠনটি তাদের আয়কৃত টাকা জমা রাখে। শিশুরাও যখন ইচ্ছে তা উঠিয়ে কাজে লাগাতে পারে। এ ছাড়া তাদের সুস্থ রাখতে স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতামূলক ট্রেনিং দেওয়া হয়, টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখানো হয়। কিছুটা চিত্তবিনোদনের লক্ষ্যে প্রায়ই আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাতে তাদের কেউ কেউ সেখানেই থাকে।
স্থাপত্য জালাল আহমেদের সৃষ্টির উৎস দেশের মানুষ, জলবায়ু, প্রকৃতি, ঐতিহ্য। তাঁর আইকন দেশের স্থাপত্যকলার পুরোধা স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। তাঁর কাজ, স্থাপত্যের নীতিবোধ, দেশাত্মবোধ, কাজের প্রতি উৎসর্গতা- সবকিছুই তিনি অনুসরণ করতে চেষ্টা করেন। লুই আই কান, তোশি, চার্লস কোরিয়া, জেফরি বাওয়া, পল রুডলফ এসব বিশ্বখ্যাত স্থপতির কাজ তাঁকে মুগ্ধ করে। তাঁরা যেমন তাঁদের কাজের মাধ্যমে নিজের দেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেন, তেমনি তিনিও চান সবাই মিলে দেশকে এগিয়ে নিতে। একটি আদর্শ দেশ গড়তে দরকার মহাপরিকল্পনা। নিশ্চিত করতে হবে সুন্দর পরিবেশ। দেশকে বিকেন্দ্রীয়করণের মাধ্যমে প্ল্যানমাফিক আবাসন, শিল্পকারখানা, কৃষি জমি ইত্যাদি করতে হবে। আবাসন সমস্যা সমাধানে হাউজিং পলিসি করতে হবে। এসব শুধু চিন্তা করলেই চলবে না, তার বাস্তবায়নও প্রয়োজন। তাই ব্যক্তিগত পেশাদারির পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবেও জড়িত আছেন কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। বিশেষ করে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে খুব নিবিড়ভাবে জড়িত। ১৯৯৩ সালে মেম্বার এডুকেশন হিসেবে যোগ দেন। ২০০৩ সালে মেম্বার প্রফেশন এবং পরবর্তী সময়ে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ২০১১ সালে জেনারেল সেক্রেটারি হন; এখনো একই পদে বহাল আছেন। এ ছাড়া তিনি সংগঠনটির নির্বাহী কমিটির সদস্য। দায়িত্বরত আছেন কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেকচারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। আর্কিটেক্ট রিজিওনাল কাউন্সিল অব এশিয়ার অনারারি সেক্রেটারি ও অল্টারনেট ভাইস প্রেসিডেন্ট পদেও তিনি বহাল। তিনি এশিয়া প্যাসিফিক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের একজন খণ্ডকালীন ফ্যাকাল্টিও ছিলেন। রাজউকের একজন তালিকাভুক্ত স্থপতি ও রোটারি ক্লাবের সদস্য। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করা আর্কিটেকচার রিসার্চ গ্রুপ ও স্থাপত্য উন্নয়ন সংস্থা ‘চেতনার’ প্রারম্ভকালীন সদস্য।

দেশকে ভালোবাসেন আর সে টানেই পড়ে আছেন এ দেশটিতে। বিদেশে যাওয়ার অনেক সুযোগ পেলেও দেশ, মাটি ও স্থাপত্যের টানে রয়ে গেছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য কাজ করতে পেরে তিনি গর্বিত। তিনি মনে করেন, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি এগুলো অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এগুলো করতে গিয়ে তিনি অর্থের কথা চিন্তা করেন না। ইনস্টিটিউটের প্রতিও তিনি দায়বদ্ধ। পেশাগতভাবেও। পেশাজীবীদের দক্ষ করে তোলা, তাঁদের কাজকে সম্প্রসারণ করা, তাঁদের সচেতন করে তোলা। অ্যাওয়ার্ড বা স্বীকৃতির জন্য কাজ করেন না, করেন নিজের আত্মতৃপ্তির জন্য। তারপরও স্বীকৃতি পেলে ভালো লাগে। যত দিন বাঁচবেন, তত দিন কাজ করবেন, এমনই প্রত্যয় তাঁর। বাংলাদেশে আর্ট গ্যালারি থাকলেও স্থাপত্য ডিজাইনের কোনো গ্যালারি নেই। তাই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এ রকমই একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন তাঁর।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪২ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৩