শহরকে গড়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত তাপ থেকে মানুষকে স্বস্তি দিতে আমরা নিজেরাই কিন্তু কিছু সহজ পদক্ষেপ নিতে পারি। যেমন ধরা যাক, আমাদের এখানকার কমিউনিটির বাড়িগুলো খেয়াল করলে দেখা যাবে ঘরের সব দেয়ালে সব সময় তাপমাত্রা এক থাকে না। এ ক্ষেত্রে বাতাস চলাচলের গতিপথ লক্ষ করা যেতে পারে। সূর্যের তাপ কোন দিক থেকে বেশি আসছে, সেটি পর্যবেক্ষণ করে কমিউনিটির সবাই মিলে সেই অনুসারে কিছু গাছ লাগিয়ে সহজেই ছায়া তৈরি করা যেতে পারে বাড়িটিকে ঘিরে। হংকংয়ে কিছু কমিউনিটি ২০১৩-১৪ সালে এ ধরনের কাজের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে সহনশীল পর্যায়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল, তাপমাত্রা ১.৫০-৪০C পর্যন্ত কমাতে পেরেছিল দুটি বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে; ১. Sky View Factor ও ২. Wind Path Design. আর এমনই তথ্য দিয়েছেন দ্য চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের বিজ্ঞানীরা, যা এনার্জি অ্যান্ড বিল্ডিং নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তা ছাড়া শহরের জনসংখ্যা বাড়ার কারণে গাছ লাগানোর জায়গা যেহেতু দিন দিন ব্যাপক হারে কমছে, সেহেতু গাছ লাগানোর সময় তার পরিবেশগত প্রভাব খেয়াল রাখতে পারলে স্বল্প পুঁজিতেই সম্ভব অধিক আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
নাইজেরিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকায় পরিচালিত আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত বাসা অনাচ্ছাদিত বাসার চেয়ে শক্তির দিক থেকে মাসে প্রায় ২১৮ মার্কিন ডলার (প্রায় ১৭ হাজার টাকা) সাশ্রয় করতে পারে। অন্যদিকে সম্প্রতি প্রকল্পিত আরেকটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীর গবেষণায় দেখা গেছে, নিকটস্থ পার্কের গাছপালা বাইরের তাপমাত্রা কমায় ২০C এবং তাপের তারতম্য ০.৫-১০C রুখে দিতে পারে সহজেই। দিন এবং রাতে এবং সেই সঙ্গে…..সারফেস (পৃষ্ঠ) যদি বিশেষ বিবেচনায় বানানো সম্ভব হয়, তবে মোটের ওপর তাপমাত্রা ২.৯০C কমে যাবে সামগ্রিকভাবে অনাচ্ছাদিত এলাকা থেকে। ধারণা করা হয়, গবেষণার মাধ্যমে একটি ৯.৬ মিটার লম্বা গাছ কমপক্ষে ৮ শতাংশ হিটিং-কুলিং লোড কমাতে সক্ষম।

বাড়ি কিংবা যেকোনো স্থাপনা তৈরি কিংবা নকশা প্রণয়নের সময় ভেতরের সাজসজ্জার সঙ্গে বাহ্যিক অবকাঠামো সর্বক্ষেত্রেই স্থপতিরা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। স্থাপত্য নকশা শুধু স্থাপনাটি কতটা সুন্দর হচ্ছে সে দিক বিশেষভাবে বিবেচনায় নেয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, স্থপতির কাছে অধিকাংশ গ্রাহকের চাওয়া বাড়িটি যেন হয় সুন্দর ও নান্দনিক। বিষয়টিকে অন্যভাবেও কিন্তু দেখা যায়, যেমন যদি ক্লায়েন্ট নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়। বাড়িতে আলো কতটুকু ঢুকবে? তাপমাত্রা সহনশীল পর্যায়ে থাকবে তো? বাতাস চলাচল পর্যাপ্ত হবে তো? বাড়ির বারান্দায় গাছে পাখি এসে বসবে তো? অনেকেই বাড়ি নির্মাণে এখন এসব বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন। কারণ, একটি বাড়ি শুধু বাড়ি নয়, এখানে জড়িত থাকে স্বাস্থ্য ভালো থাকা আর মন্দ থাকার ভবিষ্যৎও। আরেকটা বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, স্থাপনার আচ্ছাদন ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এমন যদি হতো, স্থাপনার চেহারাও যদি পাল্টে যেত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে, বিষয়টি তবে সত্যিই হতো অন্য রকম। আর স্থপতিদের এখন চিন্তা আর গবেষণার বিষয় এগুলোই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে আচ্ছাদনের পরিবর্তন হবে পরিবেশকে ঠিক রেখে, সাশ্রয়ী হবে কিংবা কমে যাবে শক্তি ব্যবহারের মাত্রা। এমনকি আমাদের দেশে ধুলোবালু থেকে বাসাবাড়িকে রক্ষার করতে জানালায় এমনকি কোনো বিশেষ ধরনের স্বচ্ছ নেটিং ব্যবহার করা যায়, যা একদিকে ধুলোবালুকে অভ্যন্তরে ঢুকতে বাধা দেবে, অন্যদিকে সূর্যের আলো আর বাতাস চলাচলের কোনো বাধাই সৃষ্টি করবে না। এমনকি ওই নেটিংয়ে কোনো ধরনের ময়লা বসবে না। আপনাআপনিই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এমন ভাবনা কিন্তু দিবাস্বপ্ন নয়, অনাগত আগামীর বাস্তবতা।

বর্তমানে আমাদের এখানকার শহরে এত বেশি স্থাপনা যে সবুজযুক্ত জায়গা আর নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় প্রতিবছর আরও নতুন নতুন স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে দ্রুতালয়ে। আমরা সব সময় সবুজায়নের কথা বলি, বলি শক্তি সঞ্চয়ের কথা কিন্তু সব সময় নতুন পরিবেশবান্ধব সবুজ স্থাপনা তৈরির কথা ভাবি কি? সত্যই কি সম্ভব বর্তমানের স্থাপনাগুলোকে ভেঙে নতুন করে সবকিছু চিন্তা করা! এমন চিন্তা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। এখন আমাদের ফিরে তাকাতে হবে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। পুরোনো স্থাপনাগুলোকে তাদের অবস্থানে রেখে সেগুলোকে নতুন রূপ দেওয়া যেতে পারে, ভাবা যেতে পারে সেগুলোর Climate Responsive Facade/envelope/shell নিয়ে। নিজস্ব একটা পরিবেশগত রূপরেখা আছে আমাদের। আমরা একটু ইচ্ছা করলেই এমন অস্বাস্থ্যকর স্থাপনাগুলোতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পারি। শহরটাকে সুন্দর আর স্বাস্থ্যকর করে গড়ে তোলা কিন্তু অসম্ভব নয়। প্রতিটি স্থাপনা ধরে ধরে রেট্রোফিটিং (পুনঃসংস্কার) করা যেতে পারে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা হিসেবে। এমনকি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে, জানালায় কাচের পরিবর্তে শক্তির ব্যবহার কমাতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে লাগানো যেতে পারে সোলার প্যানেল আর আমাদের বর্তমান নগরকেন্দ্রিক মেয়ররা এ ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে তো কথাই নেই।
– স্থপতি সজল চৌধুরী
শিক্ষক, জলবায়ু এবং পরিবেশ গবেষক
(বর্তমানে জাপানের হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিউম্যান এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেম’-এর ওপর গবেষণারত)
ই-মেইল: [email protected]
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭১ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৬