ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল একুশে ফেব্রুয়ারি; ভাষাশহীদের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। এ দেশের মানুষের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের বড় এক অধ্যায় জুড়ে রয়েছে মহান একুশের চেতনা। ১৯৫২ সালের এই দিনে মায়ের মুখের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় বুকের তাজা রক্তে পিচঢালা কালো পথকে লাল রক্তে রঞ্জিত করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বাংলার যুবারা, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। বৃথা যায়নি তাঁদের রক্ত। বিশ্ব মানচিত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি, যা পরিণত হয়েছে আপসহীন সংগ্রামের অনন্য এক প্রতীকে। একুশের অনন্ত চেতনা আর প্রেরণার উৎস থেকেই নির্মিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।
অবস্থান
সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারক এই স্থাপনাটির অবস্থান রাজধানীর কাকরাইল চৌরাস্তাসংলগ্ন ১/ক সেগুনবাগিচা শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণিতে। অপরূপ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মাণ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে।
উদ্বোধন ও নির্মাণের নানা কথা
২০০১ সালের ১৫ মার্চ রাজধানী ঢাকার সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ১২ তলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের নয় বছর পর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রবেশদ্বার। এতে শুধু বাংলা ভাষা নয়, সংরক্ষণ করা হয়েছে পৃথিবীর নানা দেশের বিচিত্র সব ভাষা। ১ দশমিক ৩ একর জায়গার ওপর ভবনটি নির্মিত। এর নির্মাণব্যয় প্রায় ৫৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভবনের স্থপতি এ আর মাসুদ খান। ভবনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বসত আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড।

কাজের ধরন
মাতৃভাষার চর্চা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও সুরক্ষা প্রদানই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রধান কাজ। পৃথিবীর নানা ভাষার বৈচিত্র্যময় উপাদান সংরক্ষিত আছে প্রতিষ্ঠানটির ডেটাবেইসে। অডিও ভিজুয়াল পদ্ধতির দৃশ্যমানতায় ফুটিয়ে তোলা হয় বিলুপ্ত বা প্রায় লুপ্ত ভাষাগুলোকে। প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে রয়েছে ভাষার ওপর লিখিত সব ধরনের বই, ব্যাকরণসমৃদ্ধ বিশ্বমানের গ্রন্থ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে পরিচালিত হয় ভাষা জাদুঘর ও এর আর্কাইভ। ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে আর জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের শহীদ মিনারের ছবি সংযুক্ত হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
- দেশে ও দেশের বাইরে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।
- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, ভাষাবিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা।
- বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা ও ইউনেসকোর সদস্য দেশসমূহের মধ্যে এ সংক্রান্ত ইতিহাস প্রচার।
- বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।
- বাংলা ভাষার উন্নয়নে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা।
- ভাষা ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ।
- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন।
- ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণ, বিভিন্ন ভাষা বিষয়ে অভিধান বা কোষগ্রন্থ প্রকাশ এবং হালনাগাদকরণ।
- পৃথিবীর সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার লেখ্যরূপ প্রবর্তন।
- বাংলাসহ পৃথিবীর সব ভাষার বিবর্তনবিষয়ক গবেষণা।
- ভাষা বিষয়ে গবেষণা-জার্নাল প্রকাশনা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন।
- ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য দেশি ও বিদেশিদের ফেলোশিপ প্রদান, ভাষা ও ভাষাবিষয়ক গবেষণায় অবদানের জন্য দেশি ও বিদেশিদের পদক ও সম্মাননা প্রদান, ভাষা বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান।
- ভাষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে কোনো রাষ্ট্র, দেশি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর। বিভিন্ন ভাষা, বর্ণমালার জন্য একটি আর্কাইভ নির্মাণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা। ভাষা বিষয়ে জাদুঘর নির্মাণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা।
- আন্তর্জাতিক মানের গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা।
- ভাষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া চ্যানেল স্থাপন।
- পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার ইতিহাস, নমুনা ও তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন।

জনবল কাঠামো
ইনস্টিটিউটের জন্য বিভিন্ন পদমর্যাদার মোট ৯১ জনের জনবল কাঠামোর সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত। বর্তমানে একজন মহাপরিচালক, দুজন পরিচালক, দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালক ও একজন সংযুক্ত কর্মকর্তা রয়েছে। এ ছাড়া তৃতীয় শ্রেণীর দুজন এবং চতুর্থ শ্রেণীর তিনজন কর্মচারী কর্মরত আছে। অবশিষ্ট জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। ইনস্টিটিউট মহাপরিচালক হিসেবে এখন দায়িত্বরত অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী।
প্রকাশিতব্য গ্রন্থ
মহান একুশ বাঙালির জাতিসত্তায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের সফল প্রকাশে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আশ্রয় করে স্তরীভূত হয়েছে আমাদের উদার, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের সংস্কৃতি। বিশ্ববাসীর কাছে একুশের চেতনা উপস্থাপিত হলে আমাদের জাতিকে আদর্শে উজ্জীবিত হবে ভিনদেশিরাও। এ লক্ষ্যে একুশের কবিতাবলি, একুশের প্রবন্ধাবলি, একুশের নাট্য সংগ্রহ, একুশের উপন্যাস, একুশের ছোটগল্প ও একুশের ছড়া শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে নিজস্ব দুটি ম্যাগাজিন বাংলায় মাতৃভাষা আর ইংরেজিতে Mother Language প্রকাশের উদ্যোগও পরিকল্পনাধীন। ভাষা-সমীক্ষা পরিচালনা বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশের নৃভাষাতাত্ত্বিক সমীক্ষা (Ethnolinguistic Survey of Bangladesh) পরিচালিত হবে এখান থেকেই। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি অব্যাহত আছে।
যা দেখবেন
জাদুঘরটিতে সংরক্ষিত আছে উপমহাদেশের সব ভাষা আর সংস্কৃতিবিষয়ক তথ্যচিত্র। বাংলা লিপির উৎপত্তি ও বিবর্তন, ব্যঞ্জনবর্ণ, স্বরবর্ণ, বাংলা সংখ্যা লিপির উৎপত্তি ও বিবর্তন, বিভিন্ন কালের বাংলা ভাষার নমুনা, এশিয়ার প্রধান ভাষাসমূহ প্রভৃতি। আছে বাবাকে লেখা কিছু চিঠি, ভাষা আন্দোলনের দুর্লভ সব ছবি। ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত নানা ডকুমেন্টারিও এখানে পাওয়া যায়। এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে আনুমানিক আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগের মিসরীয় চিত্রলিপি। সংগ্রহশালাটির প্রবেশপথে রয়েছে ফাইবার গ্লাসের দরজা। সহজে আলো ঢোকার জন্য ঘরের দুই পাশে ব্যবহার করা হয়েছে ফাইবার গ্লাস। এর ফলে সহজে সকালের প্রথম রোদ ঢুকতে পারে ঘরে। ভেতরের সাদা গ্রানাইট পাথরের মেঝে ঘরটিতে আলোর ঝলকানি সৃষ্টি করে, যা রূপ নেয় অপূর্ব নান্দনিকতায়।

ইনস্টিটিউটের ভেতর-বাহির
ভবনের তিন পাশেই প্রশস্ত রাস্তা। লোহার গ্রিলের নান্দনিক প্রাচীরে ঘেরা এই সংগ্রহশালায় ঢুকতে আপনাকে বেশ কটি নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। দর্শনার্থীদের ভেতরে প্রবেশের আগে সঙ্গে থাকা ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র বাইরে রাখতে হয়। এ জন্য রয়েছে ইনস্টিটিউটের অভ্যর্থনা ডেস্ক। দ্বিতল ভবনের পুরোটায় গ্লাস আর দেয়ালের নিবিড় সংমিশ্রণ। ইচ্ছে হলেই ভেতর থেকে বাইরে সব দেখা যাবে। তবে দ্বিতীয় তলার দৃশ্যপট একেবারেই ভিন্ন। ইনস্টিটিউটের এক কোণে রয়েছে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় যাওয়ার সিঁড়ি। প্রথম তলায় রয়েছে একটি বড় ব্যালকনি; এর সামনেই আছে বড় লাইব্রেরি, যেখানে রয়েছে পড়ালেখার সুযোগ। রয়েছে প্রচুর আলো-বাতাস প্রবেশের সুব্যবস্থা। এখানে দেখা যাবে নান্দনিক সৌন্দর্যের কিছু নিদর্শন। দ্বিতল ভবনের ওপর তলায় রয়েছে একটি পাঠাগার। পাঠাগারে আছে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত নানা বই। লাইব্রেরির সামনের জায়গায় খোলা ছাদ, ছাদটি শক্ত এবং স্বচ্ছ টিনে আচ্ছাদিত, যাতে সহজেই চলাচল করতে পারে পরিমিত আলো-বাতাস। লাইব্রেরিটির চারপাশে ফাইবার গ্লাসের জানালা। লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ার জন্য রয়েছে সুদৃশ্য চেয়ার টেবিল। নিরিবিলি ও চমৎকার পরিবেশে মনোযোগসহকারে পড়াশোনা করা যায়। আরও রয়েছে লাইব্রেরিসংলগ্ন একটি ড্রয়িংরুম।
পরিদর্শনে গাইড
দেশ বা বিদেশ থেকে যাঁরা এই ইনস্টিটিউট পরিদর্শনে আসেন, তাঁদের জন্য রয়েছে একজন গাইড। যিনি পুরো ইনস্টিটিউটি দর্শনার্থীদের ঘুরিয়ে দেখান। এ জন্য দিতে হয় না কোনো টাকা। লাইব্রেরি সম্পর্কে আগ্রহীদের লাইব্রেরির তত্ত্বাবধায়ক সুন্দরভাবে সার্বিক বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানান।
প্রদর্শনী গ্যালারি
ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য রয়েছে গ্যালারি সুুবিধা। বিশেষ দিনে প্রদর্শিত হয় ভাষা আন্দোলনের ওপর নানা দেশের বহুমাত্রিক তথ্যচিত্র। এবারের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের ওপর অঙ্কিত তেলরঙে আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীটি চলবে দিনব্যাপী।

প্রতিদিনের দর্শনার্থী
প্রতিদিন প্রায় ৪০-৫০ জন দর্শনার্থী আসে ইনস্টিটিউটটি দেখতে। ইনস্টিটিউটে আসা নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী প্রান্তিক জানালেন, এখানে আসার পর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পরিপূর্ণভাবে জানতে পারলাম। জানলাম অনেক না-জানা বিষয়ও। তাঁর মতে, প্রতিটি শিক্ষার্থীর উচিত এই ইনস্টিটিউটে এসে ’৫২-এর চেতনাকে অন্তরে লালন করা। তবেই না আমরা আমাদের ভাষার ঐতিহ্যকে মূল্যায়ন করতে শিখব।
পার্কিং ব্যবস্থা
অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এই ইনস্টিটিউটে আগত দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বিশেষ পার্কিং-সুবিধা। যেহেতু ভবনটির তিন দিকে রয়েছে প্রশস্ত রাস্তা, সেহেতু গাড়ির চাপ স্বভাবতই একটু বেশি। আর এই চাপ সামলাতে একসঙ্গে প্রায় ২৫-৩০টি গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা করা হয়েছে নিজম্ব ব্যবস্থাপনায়। এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য কোনো টাকা লাগে না।
শামস আহমেদ